এসডিজি, পৃথিবীর রূপান্তর ও নাগরিকের মনোভঙ্গি – আনিস পারভেজ

Published in Bangla Tribune on Thursday, 7 December 2017

 

হিজড়ারা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত, সরকার তাদের কর্মসংস্থানের চেষ্টা করছে। ঢাকার ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণে পুলিশ বিভাগকে সহায়তা দেওয়ার কথা হয়েছিল। উদ্যোগটি ভালো, এ রকমই হওয়া উচিত। কিন্তু এ উদ্যোগে নাগরিক প্রতিক্রিয়া মোটেই সুখের নয়। ফেসবুক ও নাগরিকের চা-আড্ডায় এ নিয়ে হাসির বন্যা বয়ে গেছে, তামাশার শিকার হলো সমাজ পরিবর্তনের একটি আবশ্যিক উদ্যোগ। এটি মাত্র একটি উদাহরণ। সমাজে এমন আরও অনেক উদাহরণ আছে। যেমন, মুচি, সুইপার, জলদাস, চা-শ্রমিক ও অন্যান্য দলিত সম্প্রদায়—যাদের এড়িয়ে চলে অর্থনৈতিক দ্রুত প্রবৃদ্ধির বাংলাদেশের নাগরিকরা। প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, বাড়ছে বৈষম্য। এ জন্য সরকারকে এককভাবে দায়ী করলে নাগরিক মনোভঙ্গির অচলায়তনই শক্তিশালী হবে, পৃথিবীতে ন্যায়-অধিকারভিত্তিক রূপান্তর সম্ভব হবে না।

গত শতকের তৃতীয় দশক থেকেই উন্নয়নের তত্ত্ব পশ্চিমা আধুনিকতাকে অনুকরণ করার নির্দেশনা দিয়ে প্রকারান্তরে সমাজকে করেছে ভোগবাদী, রাষ্ট্রের অহমকে দিয়েছে পুষ্টি, আর ব্যক্তিকে ঠেলে দিয়েছে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার উন্মাদনায়। ভৌতিক ও অভৌতিক ভোগই লক্ষ্য; তাই ব্যক্তি ও সমাজ চলছে একরৈখিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অনুশাসনে। সমাজের রূপান্তর একটি কাঠামোগত সমস্যার বদল চায়, যার একটি মনস্তাত্ত্বিক উপাদান আছে।

ব্যক্তি ও সমষ্টির মনস্তত্ত্ব ক্রীড়নক যেকোনও পরিবর্তনে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে তো বটেই। আমাদের দেশের সামন্ত মানসিকতা ও তার সঙ্গে ভোগভিত্তিক বস্তুবাদী উন্নয়নের লাগামছাড়া দৌড়-বৈষম্য কেবলই বাড়াচ্ছে। উন্নয়ন সবার অধিকারে আসছে না, বিপন্ন মানুষ আরও বিপন্ন হচ্ছে, প্রান্তজনের স্বর হচ্ছে বিলীন; যদিও সংবিধান অনুসারে এ রকম হওয়ার কথা নয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮(৩)-এ স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে সব ব্যাপারে সব নাগরিকের অন্তর্ভুক্তির। কিন্তু এখনও প্রান্তজন প্রান্তেই আছে, তার কাছে উন্নয়নের রাষ্ট্রীয় ডাক গেলেও অধিকতর সুবিধা পাওয়া নাগরিক তাকে কাছে আসতে দিচ্ছে না। সাধারণ চা-খানায়ও দলিতের প্রবেশ নেই। যিনি নগর ও জনপদকে পরিচ্ছন্ন রাখছেন, তাকে থাকতে হয় সবচে অপরিচ্ছন্ন মানবেতর অবস্থায়।

নাগরিকের মনোভঙ্গি ব্যক্তি বা পরিবারকেন্দ্রিক। এর বাইরে যে বৃহৎ সমাজ—জাতীয় ও আন্তর্জাতিক, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—তা নিয়ে নাগরিক ভাবিত নয়। তাই জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা হিসেবে জানলেও, তা নিয়ে আবশ্যিক কর্তব্য পালনে আমরা নিজেদের গুটিয়ে রাখছি।  মানুষ তার আপাত সুখের জন্য প্রকৃতিকে বিষিয়ে তুলছে, যা বুমেরাং হয়ে আঘাত করছে মানুষকেই। মানবসৃষ্ট বৈরী জলবায়ু প্রসূত বিপন্নতা উন্নয়নের আর সব অর্জনকে ম্লান করে দেবে।  অর্থহীন হবে সব উন্নয়ন প্রচেষ্টা যদি বন্ধু প্রকৃতিকে আমরা শত্রু  বানিয়ে ফেলি।  তাই জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন বা এসডিজি-র একটি অভীষ্ট জরুরি ভিত্তিতে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।  ব্যাপারটি অসম্ভব নয়, কিন্তু জটিল। মানবপ্রকৃতির ভেতর লোভ মজ্জাগত, তাই অধিকাংশ নাগরিকই প্রকৃতি বিধ্বংসী ভোগ থেকে ব্যক্তি উদ্যোগে বিরত নাও হতে পারে।  প্রয়োজন দায়িত্বশীল পরিমিত ভোগ, যার জন্য নাগরিকের মনোভঙ্গির পরিবর্তন অনস্বীকার্য।

রাষ্ট্র আইন করেছে, কিন্তু সে আইনের প্রয়োগ সম্ভব হচ্ছে না নাগরিকের নেতিবাচক মনোভঙ্গির কারণে। এখনই সময় উন্নয়ন আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নাগরিকের নেতিবাচক মনোভঙ্গি বদলানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেয়ার, তা নইলে এসডিজি-র মূল লক্ষ্য রূপান্তরিত পৃথিবী গড়া সম্ভব হবে না। পৃথিবীর কাঙ্ক্ষিত রূপান্তরে ন্যায় ও অধিকারভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। কেউ পিছিয়ে থাকবে না বস্তুগত ও অবস্তুগত উন্নয়ন থেকে। যে জন্য প্রয়োজন বিশ্ব সমাজ, রাষ্ট্র, যাবতীয় বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিকের সম্মিলিত উদ্যোগ। সর্বোপরি প্রয়োজন নাগরিকের মনোভঙ্গির পরিবর্তন।

মনোভঙ্গির পরিবর্তন সহজ নয়। এটি সম্ভব করে তুলতে প্রয়োজন সামষ্টিক উদ্যোগ। বিশেষভাবে আবশ্যক সামাজিকীকরণ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা। সামাজিকীকরণ প্রতিষ্ঠান, যেমন পরিবার, শিক্ষায়তন ও মিডিয়ার সক্রিয় উদ্যোগই কেবল নাগরিকের মনোভঙ্গি পাল্টাতে পারে। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতিও এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখবে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ শুধুই ক্ষমতায় যাওয়া নয়, দলের কর্মকাণ্ড অনেকাংশে দলের অনুসারীদের আচরণ ও মনস্তত্ত্বে প্রভাব রাখে। সুনাগরিক গড়ে তুলতে রাজনৈতিক দলও একটি শক্তিশালী সামাজিকীকরণ প্রতিষ্ঠান। তাই সরকারের পাশাপাশি রাষ্ট্রের সব সংস্থাকেই সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন রূপান্তরিত বিশ্বের অঙ্গীকারকে বাস্তবায়িত করতে।

এ বোধে উদ্দীপ্ত হয়ে সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ সংগঠিত হয়েছে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মে।  প্ল্যাটফর্মের মূল লক্ষ্য হচ্ছে এসডিজি বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারের পাশাপাশি সক্রিয় ভূমিকা রাখা এবং এ প্রক্রিয়ার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।  প্ল্যাটফর্মকে জনচেতনায় সম্পৃক্ত করে নাগরিকের মনোভঙ্গি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নমুখী করার লক্ষ্যে আয়োজন করা হয়েছে ‘নাগরিক সম্মেলন ২০১৭: বাংলাদেশে এসডিজি বাস্তবায়ন’। এসডিজি ঘোষণাপত্রে দেওয়া অঙ্গীকার ‘কাউকে পেছনে রাখা যাবে না’—এ সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য। ন্যায় ও অধিকারভিত্তিক পৃথিবীর রূপান্তরে নাগরিককে দায়বদ্ধ করতে এরকম সম্মেলন একটি আবহ তৈরি করতে পারে।

লেখক: অতিরিক্ত পরিচালক, সংলাপ ও যোগাযোগ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)