বিনিয়োগ বাড়াতে অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও আইন সহজ করা জরুরি: মোস্তাফিজুর রহমান

Published in যুগান্তর on Thursday, 9 November 2017

ব্যবসায়িক পরিবেশে পিছিয়েছে বাংলাদেশ

বিনিয়োগের জন্য দুঃসংবাদ

সংস্কারের প্রতিফলন নেই বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ব্যবসায়িক পরিবেশে আরও এক ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ আগে যত সহজে ব্যবসা করা যেত, আগামী বছর তা আরও কঠিন হবে। এর মূল কারণ কার্যকর সংস্কারের অভাব। এর ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে প্রভাব পড়তে পারে। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমবে। যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা এ রকম মতামত দিয়েছেন। এছাড়া সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিনিয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাও অর্জন করা অসম্ভব বলে মত তাদের। তবে বিনিয়োগ বাড়াতে ৩টি সুপারিশ করেছেন তারা। এর মধ্যে রয়েছে অবকাঠামো উন্নয়ন, বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং আইন-কানুনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা।

জানা গেছে, সম্প্রতি বিশ্বের ১৯০টি দেশের ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এ রিপোর্টের অর্থ হল কোনো দেশে ব্যবসা করার পরিবেশ কেমন তার মূল্যায়ন। রিপোর্টে চলতি বছরে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬ থেকে ১৭৭-এ নেমেছে। আর ব্যবসা শুরুর সূচক ১২২ থেকে ১৩১-এ নেমে এসেছে। কিন্তু সূচক উন্নয়নের জন্য বেশকিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। তবে এর কোনো প্রভাব পড়েনি বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে। সংস্থাটি বলছে, বিডার উদ্যোগের প্রভাব আগামী বছরের রিপোর্টে দেখা যেতে পারে।

এদিকে উচ্চ করের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত সরকারও স্বীকার করেছে। গতকাল বুধবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘আমরা স্বীকার করছি, বর্তমানে যে হারে কর্পোরেট কর নেয়া হয়, তা ব্যবসা সহায়ক নয়। কিন্তু এখনও বিপুলসংখ্যক লোক না খেয়ে থাকছে। ফলে তাদের জন্যই উচ্চ হারে কর নিতে হচ্ছে। তবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর্পোরেট কর হার কমানো হবে।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে যা বলা হয়েছে তা হল- ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো সংস্কার হয়নি। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ১০টি সূচকের মধ্যে তেমন কোনো উন্নতিও হয়নি। এখনও বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে ভোগান্তি পোহাতে হয়। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো এবং চুক্তি বাস্তবায়নে আমরা পিছিয়ে। কিন্তু অন্য দেশগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের নিয়মিত সমস্যা হল দুর্নীতি। সামগ্রিকভাবে আমাদের অবস্থান ১৭৭। কিন্তু মানদণ্ড পরিমাপের ১০টি সূচকের মধ্যে কোনোটিতে অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১৮৫। এর মানে হল অবস্থান একেবারে নিন্মে। এই স্কোর পরিষ্কারভাবেই বাংলাদেশের বিনিয়োগের জন্য খারাপ বার্তা দেয়। তিনি বলেন, বিডা বেশ কিছু সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০০-এর নিচে নামিয়ে আনতে চায়। এটি অসম্ভবও নয়। কিন্তু এর জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া দরকার তা দেখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, যেসব দেশ থেকে বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তারা ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট বিবেচনা করে। কারণ বিনিয়োগের পরিবেশ আছে কিনা সেটি অবশ্যই তারা বিবেচনায় নেয়।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এমন আশঙ্কা রয়েছে। কারণ যেসব দেশ বিনিয়োগ করবে, তারা ব্যবসায়িক পরিবেশ অবশ্যই দেখে। এসব রিপোর্ট তারা গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করে। এক্ষেত্রে গ্যাস, বিদ্যুতের সংযোগ সমস্যা, ব্যবসা শুরু করতে দীর্ঘসূত্রতা, আইন-কানুনের সীমাবদ্ধতা প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়ার বিষয়গুলো লক্ষ্য করে। মূলত এসব সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে যে দেশ সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে ওই সব দেশেই বিদেশিরা বিনিয়োগ করে। তবে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ক্ষেত্রে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা একেবারে অসম্ভব। বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রেশিও ধরা হয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২৭ শতাংশ। কিন্তু ২০০৫ সাল থেকে বেসরকারি বিনিয়োগ কখনই ২২ শতাংশের বেশি হয়নি। এছাড়া বর্তমানে বিদেশি বিনিয়োগের অনুপাত জিডিপির দশমিক ৮০ শতাংশ। কিন্তু সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় তা ৩ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ ৭ গুণ বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, যেখানে দিন দিন ব্যবসায়িক পরিবেশ খারাপ হচ্ছে, সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ ৭ গুণ বাড়বে, এটি একেবারে অসম্ভব। তার মতে, বিভিন্ন কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব নয়।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগের জন্য এটি নেতিবাচক দিক। কারণ ডুয়িং বিজনেস রিপোর্টে বাংলাদেশের স্কোর আগের মতো। বাংলাদেশের অবস্থান স্থির। অর্থাৎ বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। অথচ অন্যান্য দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। যারা বিনিয়োগ করে তারা এসব র‌্যাংকিংয়ের বিষয়টি দেখে। সঙ্গত কারণে এটি বিনিয়োগে প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে তিনটি বিষয় জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং আইন-কানুন সহজ করা। ড. মোস্তাফিজ বলেন, দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো নয়। কারণ ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি একেবারে কম। এর অর্থ হল বিনিয়োগ হচ্ছে না।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ব্যবসার পরিবেশকে ১০টি বৃহত্তর নির্দেশিকা বা বিষয়ে বিন্যস্ত করে সেগুলোর বিদ্যমান অবস্থা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়ন সূচকে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯তম। ব্যবসা শুরু করার সূচকে গত বছর অবস্থান ছিল ১২২তম। এবার পিছিয়ে ১৩১তম হয়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে সরকারি প্রক্রিয়া বাবদ খরচ আগের চেয়ে বেড়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে অবস্থান গত বছরের ১৮৭তম থেকে কিছুটা উন্নতি হয়ে ১৮৫তম হয়েছে। আগে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে সময় লাগত ৪২৯ দিন। এখন তা কমে ৪০৪ দিন হয়েছে। সম্পত্তি নিবন্ধনে আগের বছরের মতো ১৮৫তম অবস্থান রয়েছে। এখনও সম্পত্তি নিবন্ধনে সময় লাগে ২৪৪ দিন। চুক্তি কার্যকরের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। সংখ্যালঘু বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় ৭০তম থেকে পিছিয়ে ৭৬তম স্থান এবং দেউলিয়াত্ব পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষেত্রে ১৫১ থেকে পিছিয়ে ১৫২তম অবস্থানে গেছে বাংলাদেশ। কর পরিশোধ সূচকে ১৫১ থেকে ১৫২তম এবং ঋণ প্রাপ্তির সূচকে ১৫৭ থেকে ১৫৯তম অবস্থানে নেমেছে বাংলাদেশ।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ যুগান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে কর হার এখনও উচ্চ। তিনি বলেন, কর কমানোর ব্যাপারে আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে কথা বলেছি। ভবিষ্যতে আরও বলব। আমরা বলছি, করের হার কমালে বেশি মানুষ কর দেবে। এতে কর আদায়ের পরিমাণ বাড়বে।’ মাতলুব আহমাদ বলেন, কর দেয়ার পদ্ধতি আরও সহজ করতে হবে, পাশাপাশি করদাতাদের পুরস্কার এবং কর দেয়ার সিস্টেমকে আধুনিক করতে হবে। তবে তিনি দাবি করেন, বিশ্বব্যাংক যে সময়কালে রিপোর্ট করেছে, বর্তমানে তার চেয়ে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হয়েছে।’