অনন্য একজন – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

দৈনিক প্রথম আলো

স্যামসন এইচ চৌধুরীকে আমি প্রথম দেখি গত শতাব্দীর ষাটের দশকে, আমাদের র‌্যাংকিন স্ট্রিটের বাসায়। তিনি আমাদের বাসায় আসতেন বাবার প্রেসিডেন্সি কলেজের এক বন্ধুর সঙ্গে। যত দূর মনে পড়ে, বাবার সেই বন্ধুর কোম্পানির সঙ্গে স্যামসন এইচ চৌধুরীর এডরুক কোম্পানির একটি কারিগরি সহযোগিতার ব্যাপার ছিল।
ষাটের দশকের শেষের ভাগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি বৈরী রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশ ছিল, বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে ঢাকার বাইরে একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু ব্যক্তি শিল্পে বিনিয়োগ করছেন—এটি অত্যন্ত চমৎকৃত হওয়ার মতো উদাহরণ ছিল। আমার বাবা প্রয়াত বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য আমাদের স্যামসন এইচ চৌধুরীর উদাহরণে উৎসাহিত করতেন।
আশির দশকের মাঝামাঝি আমি পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে এসে শিল্প খাতের গবেষণায় নিয়োজিত হই। তখন থেকে স্যামসন চৌধুরীর সঙ্গে আমার নতুন করে যোগাযোগ ঘটে। স্যামসন চৌধুরী পরবর্তী দশকগুলোতে শিল্প-প্রচেষ্টায় যে বিকাশ লাভ করেন, সেটি সর্বদাই আমার পেশাগত দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিশেষ আকর্ষণের জায়গা ছিল। তাঁর ব্যবসায়িক সাফল্য ও সামাজিক জীবনাচরণ আমাকে বাংলাদেশের শিল্পবিকাশ তথা উন্নয়নধারার বিশ্লেষণে বিশেষ উৎসাহিত করে।
সর্বপ্রথম যে বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হলো, আশির দশকে ব্যক্তি-উদ্যোগে শিল্পায়নে অন্যতম নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য ছিল, সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেওয়ার প্রবণতা। স্যামসন চৌধুরী এই ঋণখেলাপি সংস্কৃতির বাইরে থেকে শিল্পবিকাশ ঘটিয়েছেন। প্রমাণ করেছেন, ব্যাংকের টাকা তছরুপ করে প্রাথমিক পুঁজি সঞ্চয় করতে হবে—এটা ঠিক নয়। এই ঋণখেলাপি সংস্কৃতির বাইরে থাকার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, তা তিনি ধারাবাহিকভাবে প্রায় তিন দশক ধরে রেখেছেন। বাংলাদেশের শিল্পবিকাশে আর একটি নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য হলো, সরকারি ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে লাভবান হওয়া অথবা সরকারি ঠিকাদারির মাধ্যমে বিপুল অর্থ উপার্জন করা। আমার জানামতে, স্যামসন চৌধুরীর কোনো মূল উদ্যোগই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়নি বা সরকারি ব্যবসা সূত্রে লাভবান হয়নি। শিল্পবিকাশ বাংলাদেশে গতি লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে প্রথম প্রজন্মের ও দ্বিতীয় প্রজন্মের শিল্পপতিরা ক্রমান্বয়ে বিত্তশালী হয়ে ওঠেন। কিন্তু লক্ষণীয়, তাঁরা অনেকেই সরকারের ন্যায্য রাজস্ব পরিশোধের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। এটি প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ কর—উভয় ক্ষেত্রেই সত্য। স্যামসন চৌধুরী ও তাঁর শিল্পগোষ্ঠী স্কয়ার গ্রুপ ধারাবাহিকভাবে অনেক বছর সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কর ফাঁকির প্রবণতার ঊর্ধ্বে থেকেছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পপতি বিভিন্ন সময় আমাদের পুঁজিবাজারে নিজেদের নিবন্ধন করেছেন। তাঁদের একটি অংশ পুঁজিবাজারকে অপব্যবহার করেছেন যতখানি না পুঁজি বাঁচানোর জন্য, তার চেয়ে বেশি অবাঞ্ছিত উপায়ে তাঁদের ব্যক্তিগত আয় বৃদ্ধি করার জন্য। কিন্তু স্যামসন চৌধুরীর নিবন্ধিত কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারের নিয়মনীতির ভেতরে থেকেছে এবং বিনিয়োগকারীদের বাজারভিত্তিক মুনাফাও দিয়েছে। সেই দিক থেকেও তিনি একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
আমি আরেকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই—তাঁর নিজস্ব শিল্পোদ্যোগের ধারা। তাঁর শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ভিতের দুটি ধারা আছে। শিল্পের সংগঠনশাস্ত্রের ভাষায় একটি ধারা হলো ভার্টিক্যাল ইন্টিগ্রেশন। অর্থাৎ একই খাতের ভেতরে একটি শিল্পের থেকে আরেকটি উচ্চতর সংযোগ-শিল্প গড়ে তোলা। আমরা দেখেছি, তিনি আধুনিক ওষুধশিল্পের সঙ্গে সেবাশিল্পের হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন। এটিকে বলা হয় প্রলম্বন বিকাশ। শিল্প সংগঠনের বিকাশে আরেকটি ধারা হলো, হরাইজনটাল ডাইভারসিফিকেশন বা শিল্পে বহুধাকরণ। যেমন, উনি হয়তো গৃহস্থালি ও প্রসাধনশিল্পে গেছেন। তারপর হয়তো খাদ্যপণ্য প্রস্তুতে গেছেন এবং তারপর দেখেছি তিনি শিল্প থেকে সেবা খাতে, মানে মিডিয়ায় গেছেন। এই যে বিকাশের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম—দুভাবে চলাফেরা করেছেন, এটা শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে খুব কম দেখা যায়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আজকে আমরা যাঁকে শিল্পে করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বা ব্যবসায় সামাজিক দায়বদ্ধতা বলে অভিহিত করি, তা বহু পূর্বেই প্রচলন করা হয় তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, তাঁর শিল্প-কলকারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুপুরবেলা বিনা মূল্যে মধ্যাহ্নভোজ পান।
আমার মনে হয়, তাঁর ক্ষেত্রে এসব এসেছে আমাদের এই অঞ্চলের সামাজিক, মানবিক মূল্যবোধকে আত্মস্থ করার মাধ্যমে। এখানে যতখানি না মালিক-শ্রমিকের বৈরী সম্পর্কের মধ্যে শিল্পে পুঁজি সঞ্চয় হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে সামাজিক সৌহার্দ্যের ভেতরে।
কিন্তু তাঁর দৃষ্টিতে এগুলো ছিল স্বাভাবিক মানব আচরণ। এর মধ্যে জটিল কোনো ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না।
স্যামসন চৌধুরী যেমন একদিকে শিক্ষিত ও নান্দনিক মানুষ ছিলেন, তেমনি একই রকমভাবে খুবই আধ্যাত্মিক মানুষও ছিলেন। তাঁর আধ্যাত্মবোধের একটি উৎস হলো খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধের দানশীলতা। কিন্তু তাঁর দানশীলতা কোনো দিনই সীমিত সাম্প্রদায়িক চিন্তার মধ্যে ছিল না। তাঁর অখণ্ড অভিন্ন মানবতাবোধের জন্যই তিনি বাকি কাজগুলো করেছেন।
ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়েছিল ২০০৬-০৭ সালে; যখন আমরা সিপিডির উদ্যোগে নাগরিক কমিটি তৈরি করি। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার ও চ্যানেল আই-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ছিল। নাগরিক কমিটির উদ্যোগে আমরা রূপকল্প-২০২১ তৈরি করি। সেই রূপকল্পের বিভিন্ন বিষয়, বিশেষ করে শিল্পবিকাশ, বাংলাদেশকে একটি মধ্য আয়ের দেশ করতে হলে কী ধরনের শিল্পায়ন করতে হবে, সেটা আমরা অনেক গভীরভাবে আলোচনা করেছি। আমরা এই নাগরিক কমিটির উদ্যোগে সংলাপ করার জন্য পাবনায় গেছি। সেখানে তাঁর আতিথেয়তা ও সমর্থন পেয়েছি। এ কারণে খুব জটিল স্থানীয় পরিবেশের ভেতরেও আমরা সভাটা করতে পেরেছি।
আমার কাছে মনে হয়, ব্যবসায়িক সত্তা বা মানবিক সত্তার সঙ্গে তাঁর একটা আধুনিক সত্তাও ছিল। এই আধুনিক চেতনাটা বিভিন্ন সময় তাঁকে বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেছিল।
আমরা জানি, তিনি একসময় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সভাপতি ছিলেন। দুর্নীতি ধরা যে প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ, সেই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হওয়া মানে সহজেই বোঝা যায়, একজন ব্যবসায়ীর জন্য এটা কতটা ঝুঁকির কাজ। তবে তিনি সেটা সম্মানের সঙ্গে পালন করেছেন।
তিনি আমার সঙ্গে গত কয়েক বছরে একটা বিষয় নিয়ে প্রায়ই কথা বলেছেন। সেটা হলো, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মেধাস্বত্ব আইনের প্রয়োগ।
যখন জেনেভায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলাম, তখন তিনি আমার অতিথি হয়েছেন। তখনো এই বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের সভা হবে, এটি মনে রেখে কয়েক মাস আগেও ফোনে তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘ওটার কী হলো, তোমরা এটার কী করছ?’ তিনি সর্বদা এটি মনের মধ্যে রাখতেন। তিনি আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশের শিল্প কীভাবে আধুনিক রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে দাঁড়াতে পারে, সেটার ব্যাপারে চিন্তাশীল ছিলেন। এটা কোনো সময়ই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক লাভের চিন্তা থেকে করেননি বলে আমি মনে করি। তিনি জগতের স্বাভাবিক নিয়মে চলে গেছেন, কিন্তু উদ্যোগী চেতনাবান ব্যক্তি হিসেবে রেখে গেছেন একটি গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য থেকে সমগ্র দেশ, জাতিও নতুন প্রজন্মের গভীর শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ আছে। অনুপ্রাণিত হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা এ রকম ক্ষণজন্মা দুর্লভ মানুষদের মেধা, অভিজ্ঞতা ও চেতনাকে সামগ্রিক জাতি গঠন-প্রক্রিয়ায় কার্যকরভাবে প্রায়ই যুক্ত করতে পারিনি। (অনুলিখিত)