অর্থনীতিতে হঠাৎ চাপ: ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Published in সমকাল  on Saturday, 16 September 2017

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে হঠাৎ করে এক ধরনের অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পরপর কয়েকটি বছর আমরা সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে স্থিতিশীলতা দেখে আসছি, হঠাৎ করেই যেন তাতে ছেদ পড়ার শঙ্কা। এর শুরু এপ্রিল মাসে হাওরাঞ্চলে অকাল বন্যা থেকে। প্রতি বছরই সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার ও কিশোরগঞ্জের হাওরগুলোতে অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে বোরো ফসলের কিছু না কিছু ক্ষতি হয়। তবে এবারে ক্ষতির মাত্রা ছিল অভাবনীয়। একের পর এক হাওর তলিয়ে যেতে থাকে। কেবল প্রকৃতির রোষের কারণে এমনটি হয়নি। অভিযোগ ওঠে যে, বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণ সময়মতো হয়নি কিংবা কাজ হয়েছে নিম্নমানের। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। দুদকের মামলায় দেখা যায়, ঠিকাদারদের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পদস্থ কর্মকর্তারাও এসব আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডে যুক্ত।

হাওরের এ বন্যায় ফসলহানি যতটা ঘটেছে, তার চেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে খাদ্যশস্যের বাজারে। এ সময়ে মোটা ও সরু সব ধরনের চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করে। বহু বছর ধরে আমাদের খাদ্যশস্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে সরকারি খাদ্যভাণ্ডারে চালের মজুদ বড় ভূমিকা রেখে আসছে। বাজার অস্বাভাবিক চড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিলে সরকার এ ভাণ্ডার থেকে তুলনামূলক কম দামে চাল বিক্রি করে। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে সরকারের গুদামে চালের মজুদ স্বাভাবিক মাত্রার তুলনায় কম ছিল। একদিকে খাদ্য সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া এবং পাশাপাশি আমদানির পদক্ষেপ গ্রহণ করায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বন্যা ও ব্লাস্টের আক্রমণে বোরো চাল উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ লাখ টন কম হবে_ এমন একটি ধারণা দায়িত্বশীল মহল থেকে দেওয়া হয়। আমাদের চাল, গম ও ভুট্টা উৎপাদন বছরে প্রায় চার কোটি টন। এর মধ্যে সাড়ে তিন কোটি টনের মতো চাল। কেবল বোরো চাল উৎপাদনই এক মৌসুমে এক কোটি ৯০ লাখ টনের মতো। কিন্তু সরকারের গুদামে আপদকালীন চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত মজুদ বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে কারসাজি করছে, এমন অভিযোগ উঠছে।

বাংলাদেশে আর্থিক বছর জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত। প্রতি বছর জুনের প্রথম দিকে সংসদে বাজেট পেশ করা হয় এবং প্রায় এক মাস আলোচনা চলে। এবারে অর্থমন্ত্রী চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন। এ বাজেট উচ্চাভিলাষী এমন অভিমত বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলেছেন। বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে কর আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয় দুই লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৯১ হাজার কোটি টাকা। গত বছর ভ্যাট আদায়ে মূল টার্গেট ছিল প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা। নতুন বছর থেকে মাল্টিপল হারের পরিবর্তে একক ভ্যাট হার চালু করা হলে রাজস্ব আয় বাড়বে, এটাই ছিল অর্থমন্ত্রীর প্রত্যাশা। কিন্তু শুরু থেকেই ব্যবসায়ীরা এতে আপত্তি প্রকাশ করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত এ নতুন পদ্ধতি চালু দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখা হয়। ফলে নতুন বছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হয়। ভ্যাট থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার মতো বাড়তি আদায় হবে, এমন প্রত্যাশা ছিল। অর্থমন্ত্রী বাজেট পাসের সময় প্রদত্ত সমাপনী ভাষণে ভ্যাট আদায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হওয়ার কারণে বাজেটে যে রদবদল করতে হবে, সে বিষয়ে ধারণা দিয়েছিলেন। এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, রাজস্ব আদায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কম হলে সরকারের ব্যয়ও সেই পরিমাণে কম করতে হবে। নতুবা ব্যয় ঠিক রাখার জন্য সরকারের ধার বাড়াতে হবে।

বাজেট পাস হতে না হতেই আসে বন্যা। আশঙ্কা ছিল, ১৯৮৮ বা ১৯৯৮ সালের মতো বড় ধরনের বন্যা হবে। সে বিপদ কেটে গেছে। কিন্তু বন্যার কারণে অনেক জেলায় আমন চাষ বিঘি্নত হয়েছে। কৃষকদের দ্বিতীয়বার চারা রোপণ কিংবা বীজ ফেলার কারণে ব্যয় বেড়ে যাবে। বিলম্বে চাষের কারণে ধানের ফলন কম হতে পারে, এমন শঙ্কাও রয়েছে। বোরো মৌসুমের ক্ষতির পর আমনেও উৎপাদন কম হবে, এমন শঙ্কা থেকে চালের বাজার আরও ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। এটা সামাল দিতে সরকারের নিজস্ব মজুদ থেকে যে বাজারে কম মূল্যে চাল ছাড়া হবে, তারও উপায় নেই। কারণ সরকারের আমদানি পরিকল্পনা শুরু হয় বিলম্বে। বেসরকারি খাতেও চাল আমদানি তেমন গতি পায়নি। ব্যবসায়ীরা চালের ওপর সব মিলিয়ে ২৮ শতাংশ শুল্ককরকে এ জন্য দায়ী করেন। সরকার বাস্তবতা উপলব্ধি করে এবং দুই ধাপে শুল্ককর কমিয়ে মাত্র দুই শতাংশে নামিয়ে আনে। কিন্তু চালের বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা তাতে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। সরকারের নিজস্ব মজুদ বাড়ানোর লক্ষ্যও এখন পর্যন্ত তেমন পূরণ হয়নি। তদুপরি ভারতে বন্যা হওয়ায় সেখানেও চালের দাম বেড়েছে। বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, এমন শঙ্কা রয়েছে।

বন্যার কারণে কেবল ধানের উৎপাদন বিঘি্নত হয়নি, সবজির ফলনও কম হয়েছে। যোগাযোগ বিঘি্নত হওয়ার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েক ধরনের পণ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী। এর ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে, বিশেষ করে খাদ্যপণ্য খাতে। সরকার সাধারণভাবে বন্যার্তদের জন্য কম দামে কিংবা ত্রাণ সাহায্য হিসেবে চাল প্রদান করে থাকে। কিন্তু এবারে নিজস্ব মজুদ কম থাকায় এ ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া বন্যার কারণে অনেক এলাকায়, বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতি কর্মসংস্থানের সমস্যা বেড়েছে। একদিকে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী, অন্যদিকে আয়ের সুযোগ কমে যাওয়ার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সমস্যা বাড়বে_ এটাই স্বাভাবিক। সরকার গত বছর কয়েক লাখ লোককে ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ করেছে। এবারেও এ পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, মজুদের পরিমাণ পর্যাপ্ত না থাকা। একই কারণে ওপেন মার্কেট সেলও চালু করা যাচ্ছে না।

এবারে বন্যা ও অতিবৃষ্টির প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টির প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। এ সমস্যা নিয়ে বিশ্বের সর্বত্র আলোচনা চলছে। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী দেশ হিসেবে আমাদের জন্য সমস্যা জটিল এবং এ জন্য আগামী দিনগুলোতে মানবসম্পদ ও অর্থ বরাদ্দে বিশেষভাবে মনোযোগী হতে হবে। বন্যায় কেবল কৃষি নয়; সড়ক, সেতু, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। এসব সংস্কার-মেরামতে সরকারকে বাড়তি ব্যয় করতে হবে। অথচ অর্থবছরের শুরুতে এ জন্য বরাদ্দ রাখা ছিল না।

বাংলাদেশের জন্য বাড়তি সমস্যা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উপস্থিতি। আগস্টের শেষ দিকে দলে দলে শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে। এরা স্বল্প সময় অবস্থান করে মিয়ানমারে নিজ নিজ ঘরে ফিরে যেতে পারবে- এমন সম্ভাবনা কম বলেই বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের ধারণা। যখন এক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল, তখন জাতিসংঘ প্রায় আট কোটি ডলার ত্রাণ সাহায্য প্রয়োজন বলে হিসাব করেছিল। এখন এর চার-পাঁচ গুণ কিংবা বেশি সহায়তা প্রয়োজন পড়বে। কয়েক মাসে ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক সহায়তা যা-ই পাওয়া যাক না কেন, বাংলাদেশের বাজেটে যে বাড়তি চাপ পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কীভাবে মিলবে সেই অর্থ? কেবল বাজেটের ওপর চাপ নয়, বাংলাদেশকে আরও সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে। কক্সবাজার-পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাতেই রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিচ্ছে। ওই এলাকাই আমাদের প্রধান পর্যটন এলাকা। রোহিঙ্গাদের চাপ যেভাবে বাড়ছে তাতে পর্যটন খাতে বিরূপ প্রভাব পড়বেই। পরিবেশের ওপরও চাপ পড়বে। পাহাড়-বনাঞ্চলের গাছ কাটা হবে। স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে। নিরাপত্তা নিয়েও কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। স্বল্প মেয়াদে আমাদের ওপর চেপে বসা অনাকাঙ্ক্ষিত এ সমস্যার সমাধান হবে_ এমন আশা খুব কম পর্যবেক্ষকই করতে পারেন। এমনটি যাতে না হয় সে জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি চাই দেশের ভেতরে সমন্বিত উদ্যোগ।

সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতিতে এক ধরনের অশুভ সংকেত। অর্থমন্ত্রী এ পরিস্থিতিতে বাজেট মেলাবেন কী করে? খাদ্য আমদানির জন্য বাড়তি চাপ পড়বে। ইতিমধ্যেই আমাদের চলতি হিসাবে নেতিবাচক প্রবণতা ছিল। এখন তা আরও বাড়বে। চাল আমদানিতে বেশি ব্যয় পড়বে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের প্রবাহ আগের মতো নেই। রফতানিতেও ওঠানামার চিত্র। অর্থমন্ত্রী কি বাজেটের আয়-ব্যয় নিয়ে তার পরিকল্পনা উপস্থাপন করবেন? দ্রুতই এ কাজটি করা ভালো। তাতে বছরের বাকি ৯ মাসের জন্য এখন থেকেই পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হওয়া যাবে।

গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)