উৎপাদনমূলক খাতকে প্রাধান্য দিন – ফাহমিদা খাতুন

দৈনিক প্রথম আলো

অর্থনীতিতে ভর্তুকির প্রয়োজন, ব্যবহার, অবদান ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুসারে, ভর্তুকির ফলে বাজারে অসামঞ্জস্যতা এবং অদক্ষতা দেখা দেয়, সম্পদের অপচয় হয়, কেননা সম্পদের প্রকৃত মূল্য এতে প্রতিফলিত হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভর্তুকি দেওয়া হয়, যাতে করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়। শুধু উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশে নয়, অনেক ক্ষেত্রে উন্নত দেশেও কোনো বিশেষ পণ্য বা সেবার ওপর ভর্তুকি দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বহু বছর ধরেই অর্থনীতিতে ভর্তুকি দেওয়া হয়ে আসছে। মূলত যে খাতগুলোর জন্য আমাদের দেশে ভর্তুকি দেওয়া হয়ে থাকে সেগুলো হচ্ছে খাদ্য, কৃষি, রপ্তানি, জ্বালানি, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে মোট ভর্তুকির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৬২১ কোটি টাকা। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকায়, যা ওই সময় পর্যন্ত সর্বোচ্চ ছিল। এর কারণ ছিল, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের সাত হাজার ৫২৩ কোটি টাকার লোকসান এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০০৮-০৯ এবং ২০০৯-১০ অর্থবছরের ভর্তুকিতে কিছুটা নিম্নমুখিতা দেখা যায়। এর কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের ও অন্যান্য পণ্যের দাম কমে যাওয়া।

কৃষি-উৎপাদনের জন্য কৃষি-উপকরণের মূল্যের ওপর ভর্তুকি দেওয়া একটি সুপরিচিত পদক্ষেপ। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষি-উৎপাদন বাড়ানো। কৃষি খাতে ভর্তুকি সাধারণত চাষের জন্য ডিজেল এবং বিদ্যুৎ, সার, বীজ ইত্যাদি ক্ষেত্রে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে সাধারণভাবে মোট ভর্তুকির ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ যায় কৃষি খাতে। ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে সার ও অন্যান্য কৃষি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল চার হাজার কোটি টাকা। গত মার্চ মাসে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে আরও এক হাজার কোটি টাকা লাগবে। এর একটি কারণ হচ্ছে, ইউরিয়াসহ অন্যান্য সারের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে আমদানি মূল্য বেড়ে যাওয়া।

খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে খাদ্যপণ্য সহজলভ্য করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চাল আমদানি করতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে খাদ্যে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকার বর্ধিত ৪০০ মেট্রিক টন চাল বণ্টন করেছে। যেমন—খোলাবাজারে চাল বিক্রির পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি হয়েছে। খাদ্য বণ্টনের জন্য সরকার আরও কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ন্যায্য মূল্যের কার্ডের মাধ্যমে খাদ্যশস্য বিক্রয়। এ ছাড়া চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীদের জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে রেশনিং ব্যবস্থা চালু হয়েছে।

অন্যদিকে ব্যাপক বিদ্যুৎ-ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যে নতুন স্থাপিত কুইক রেন্টাল এবং রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর জন্য পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। জ্বালানির ওপর ভর্তুকি কয়েক বছর ধরে অর্থনীতির ওপর অনেকটা বোঝার মতো চেপে বসেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির ফলে বেশি দামে জ্বালানি কিনে কুইক রেন্টাল প্রকল্পগুলোকে সরবরাহ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে এদের কাছ থেকে চড়া দামে বিদ্যুৎ ক্রয় করে কম দামে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কারণে সরকারি রাজস্বের ওপর চাপ পড়ছে। জ্বালানির প্রকৃত মূল্য এবং ভর্তুকিকৃত মূল্যের মধ্যে বিরাট ফারাক কমানোর উদ্দেশ্যে সম্প্রতি বিদ্যুতের মূল্য, পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের মূল্য এবং সিএনজির মূল্যের কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী সমন্বয় করা হয়েছে। তাই এই খাতে ভর্তুকির চাপ কিছুটা কমবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের পরবর্তী তিন মাসের জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে তিন হাজার কোটি টাকা চেয়েছে। এর অধিকাংশই ব্যক্তি খাতের রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্পে তরলীকৃত জ্বালানির জন্য ব্যয় হবে।

অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আগামী ২০১১-১২ অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেননা চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি-বহির্ভূত খরচ বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। এই খরচের অনেকটা ভর্তুকি খাতে যাবে। কিন্তু বিবেচনার ব্যাপার হচ্ছে, এই বর্ধিত ভর্তুকি আমাদের অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে। বর্তমান অর্থবছরে ইতিমধ্যেই অর্থনীতি অনেক ক্ষেত্রে টানটান অবস্থায় রয়েছে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ, প্রবাসী আয়প্রবাহে নিম্নগতি, নিট বৈদেশিক বিনিয়োগে স্থবিরতা, বৈদেশিক সাহায্যপ্রবাহে শ্লথগতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে।

খাদ্য, কৃষি ও জ্বালানির বাইরে রপ্তানি খাতেও একটি বড় পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া হয়, যাতে রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদন বাড়ে এবং কর্মসংস্থান হয়। তবে দেখা গেছে, সুযোগ পেলেই বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছ থেকে নানা রকম সহায়তা, আর্থিক প্রণোদনা ইত্যাদির দাবি ওঠে, যেগুলো প্রকারান্তরে ভর্তুকি। কিন্তু যেসব শিল্প বছরের পর বছর ধরে নানা ধরনের সরকারি সহযোগিতা পেয়ে আসছে, তাদের আর্থিক প্রণোদনা বিশেষ সংকটাপন্ন পরিস্থিতি ছাড়া কেন প্রয়োজন, তার কোনো অর্থনৈতিক যুক্তি নেই। অপচয়মূলক ভর্তুকি বন্ধ না হলে সামাজিক সুরক্ষামূলক কর্মসূচিতে পর্যাপ্ত ব্যয় সম্ভব হবে না এবং দারিদ্র্য বিমোচন পরাহত হবে।

তবে ভর্তুকি কীভাবে বিভিন্ন খাতের জন্য বরাদ্দ করা হবে এবং বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বণ্টন করা হবে, এ বিষয়ে দূরদর্শী হতে হবে, যাতে করে যে উদ্দেশ্যে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা হয়, তা যেন পূরণ হয়। এ ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে ভর্তুকি পাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন—সারের ক্ষেত্রে কৃষকদের কাছে ভর্তুকির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ঠিক সময়ে পর্যাপ্ত সার পাওয়া। তা ছাড়া সবার জন্য একই কাঠামোর মধ্যে ভর্তুকি না দিয়ে সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্যই শুধু এই ব্যবস্থাটি থাকা উচিত। যেমন—কৃষি ভর্তুকি সব কৃষকের জন্য একই পরিমাণে না দিয়ে শুধু অসচ্ছল কৃষকের জন্য বরাদ্দ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে আয়, জমির পরিমাণ ইত্যাদির মাধ্যমে ভর্তুকি পাওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করা যেতে পারে। তেমনি জ্বালানির ক্ষেত্রে একই হারে সবার জন্য না দিয়ে আয় ও ব্যবহার অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা উচিত।

আগামী বাজেটে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ভর্তুকির বিষয়টিতে তাই বিশেষভাবে নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা ক্রমাগতভাবে সরকারি বাজেট থেকে ভর্তুকি দিতে গিয়ে তা যদি রাজস্ব-বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে ভালো খাতে ব্যয়ের সুযোগ সংকুচিত হয়ে যায়। প্রকারান্তরে তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোকে শক্তিশালী অবস্থায় রাখতে হলে অর্থনীতিতে সত্যিকার অর্থে ভর্তুকির জন্য কতখানি আর্থিক জায়গা রয়েছে, তা বিবেচনায় রেখে শুধু উৎপাদনমূলক ও প্রবৃদ্ধিসহায়ক ভর্তুকির জন্যই অর্থ বরাদ্দ করা উচিত।