ঋণের আওতায় নেয়া প্রকল্পের পণ্য সরবরাহকারী যেন একক কোম্পানি না হয়ঃ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Published in যুগান্তর  on Friday, 6 October 2017 

অর্থনীতিবিদদের অভিমত

শর্তের জালে ভারতীয় ঋণ

নানা শর্তের বেড়াজালে ভারতের তৃতীয় ঋণের ৪৫০ কোটি ডলার (৩৬ হাজার কোটি টাকা)। এই অর্থে বাস্তবায়িতব্য প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নও হবে বিলম্বিত। শুধু তা-ই নয়, পরোক্ষভাবে ঋণের সুদের হারও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের। তাদের মতে, এর আগে নেয়া (সম্প্রতি নয়) বিভিন্ন দেশের ঋণের তুলনায় এ ঋণে শর্ত বেশি এবং পরিশোধের সময়সীমাও কম। পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে স্বস্তিকরও নয়।

অর্থনীতিবিদরা আরও জানান, ভারত থেকে লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় নেয়া আগের দুটি ঋণের (তিনশ’ কোটি ডলার) সার্বিক কার্যক্রম সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে থাকলে পুনরায় একই ধরনের ঋণ নেয়ার প্রয়োজন ছিল না। কারণ সেটি ইতিবাচক ছিল না। ২০১৬ সালে চুক্তি হওয়া দ্বিতীয় ঋণের ২০০ কোটি ডলার এখনও ছাড় হয়নি। আর প্রথম ঋণের ১০০ কোটি ডলারের মধ্যে সাত বছরে ছাড় হয়েছে প্রায় ৩৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি বা ইকোনমিক রিলেশন্স ডিভিশন) সূত্রে জানা গেছে, তৃতীয় ঋণের অর্থে ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। আর পর্যায়ক্রমে প্রকল্পভিত্তিক ঋণ চুক্তি হবে। অর্থছাড় হবে এরপর। তৃতীয় ধাপের ঋণের শর্ত আগের দুটির মতোই হবে। এর মধ্যে বাস্তবায়িতব্য সরবরাহ প্রকল্পের (সাপ্লাই প্রজেক্ট) ৭৫ ভাগ পণ্য অবশ্যই ভারত থেকে আমদানি করতে হবে। পাশাপাশি প্রকল্পের সেবাও (পরামর্শক নিয়োগ) নিতে হবে সেই দেশ থেকে। এছাড়া ভৌত অবকাঠামো প্রকল্পের ৬৫ ভাগ পণ্য কিনতে হবে ভারত থেকে। প্রকল্পের অবশিষ্ট পণ্য ভারতের বাইরে বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশ থেকে আমদানি করা যাবে।

সূত্র আরও জানায়, নতুন ঋণের সুদের হার নির্ধারণ করা হয়েছে ১ শতাংশ, দণ্ড সুদ (পেনাল সুদ) ২ শতাংশ ও প্রতিশ্রুতি ফি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া বাস্তবায়িতব্য প্রকল্পে ভারতের ঠিকাদার নিয়োগের শর্ত রয়েছে। আর প্রকল্পগুলোর জন্য জমি অধিগ্রহণ, দরপত্র প্রণয়ন, প্রকল্পের নকশা তৈরি এবং দরপত্র চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে নিতে হবে। এ ঋণ পরিশোধের মেয়াদ হবে ২০ বছর। তবে গ্রেস পিরিয়ড (রেয়াতকাল) হবে আরও পাঁচ বছর।

ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি তিন দিনের ঢাকা সফরকালে বুধবার লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) আওতায় ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণদানে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, এ ঋণের অর্থে বাস্তবায়িতব্য প্রকল্পের পণ্যের ৭৫ শতাংশই কিনতে হবে ভারত থেকে। সেক্ষেত্রে তাদের নির্ধারিত মূল্যেই পণ্য কিনতে হবে। যে কারণে এ ধরনের ঋণের সুদের হার কম থাকলেও পণ্যের দাম বেশি চার্জ করা হয়। এতে সুদের হার পরোক্ষভাবে বেশি হয়।

তিনি বলেন, এ ঋণ নেয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার কোনো ঘাটতি নেই। ভারত থেকে নেয়া আগের দুটি ঋণও ব্যবহার করতে পারিনি। পাইপলাইনে অনেক ঋণের প্রতিশ্রুতির পাহাড় জমে আছে।

তবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব কাজী শফিকুল আযম যুগান্তরের কাছে দাবি করে বলেন, ভারত পণ্যের দাম বাড়াতে পারবে না। কেননা সেখানে বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে দরপত্রে প্রতিযোগিতা হবে। মান ও দাম যাচাই করেই কেনাকাটা করা হবে। তিনি আরও বলেন, শর্তের চেয়ে বেশি পণ্য বা সেবা অন্য কোনো দেশ থেকে কেনার প্রয়োজন হলে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে তা নির্ধারণের সুযোগ আছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, লাইন অব ক্রেডিটের অর্থ হল, এই ঋণের অর্থ খরচ করবে বাংলাদেশ, তবে তা বিশেষ কিছু শর্তের আওতায়। বিশেষ কিছু প্রকল্পেই কেবল এ অর্থ ব্যয় করা যাবে এবং সেই ব্যয়ের সিংহভাগই ঋণদাতা দেশের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে অবকাঠামো ও মানব উন্নয়নে বেশ কিছু প্রকল্পে ঋণের অর্থ ব্যয় হবে। কিন্তু শর্তের ক্ষেত্রে কতটুকু নেগোসিয়েট (দরকষাকষি) করতে পারছে সরকার, সেটি দেখার বিষয়। চীন, ভারত ও রাশিয়া থেকে সম্প্রতি নেয়া ঋণের শর্ত অনেক বেশি। এমনকি পরিশোধের সময়ও কম এবং স্বস্তিকর নয়। এক্ষেত্রে আগে বিভিন্ন দেশ বা সংস্থা থেকে নেয়া ঋণের শর্ত ছিল তুলনামূলক কম। ফলে আগের প্রকল্পের তুলনায় ঋণভারও বেশি হবে। ঋণ হবে ব্যয়বহুল। সরকারের উচিত হবে ঋণের নানা শর্ত নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে কমিয়ে আনা। প্রকল্পের পণ্য কেনাকাটার ক্ষেত্রে যতটুকু সম্ভব স্বস্তিদায়ক অবস্থায় রাখা। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যের সামঞ্জস্য রেখে পণ্য কিনতে হবে। প্রয়োজনে দরপত্র দিয়ে কেনাকাটা করতে হবে। এক্ষেত্রে পণ্য সরবরাহকারী যেন একক কোম্পানি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

একই শর্তে আগে নেয়া দুটি ঋণের বাস্তবায়নের অগ্রগতি ভালো নয়। এরপরও নতুন ঋণ নেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা ঠিক দ্বিতীয় ঋণ চুক্তির আওতায় টাকা ছাড় হয়নি। নতুন ঋণের অর্থ দ্রুত ছাড় দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করতে প্রকিউরমেন্ট শুধু ভারত নয়, আন্তর্জাতিক বিডিংয়ের মাধ্যমে কেনা যায়, তা নিয়ে সরকার আলোচনায় এগিয়ে যেতে হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। ওই সময় ১১ জানুয়ারি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরদিন ১২ জানুয়ারি ঘোষণা দেয়া হয় ৫০ দফা ইশতেহার। সেখানে বাংলাদেশকে লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) আওতায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ভারত সরকার। এ ঋণের ব্যাপারে একই বছরের ৭ আগস্ট ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের চুক্তি স্বাক্ষর হয়।

পরে এই ১০০ কোটি ডলারের মধ্যে ২০ কোটি ডলার অনুদান দেয়ার ঘোষণা দেন ভারতের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। ওই ঋণের অর্থ দিয়ে ১৫টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। সর্বশেষ তথ্যমতে, ১২টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। বড় তিন প্রকল্পই বাস্তবায়ন হয়নি। এসব প্রকল্পে গত সাত বছরে ঋণের অর্থ ছাড় হয়েছে ৩৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এখনও ৬২ কোটি ৪০ লাখ ডলার ছাড় করার বাকি রয়েছে।

সূত্রমতে, ২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরকালে ২০০ কোটি ডলার ঋণের সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়। এরপর ২০১৬ সালের ৯ মার্চ উভয় দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এলওসির এ ঋণের আওতায় ১৪টি প্রকল্পের ১২টিতে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে ভারত। তবে প্রকল্পগুলোর মাঠপর্যায়ের কাজ এখনও শুরু হয়নি।

বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এমকে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, ভারতের এই তৃতীয় ঋণে অনেক শর্ত আছে। উভয় দেশ একটি প্রকল্পে সব শর্তে একমত হওয়া দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং কঠিন। বাংলাদেশ একটি শর্ত দিলে ভারত রাজি না-ও হতে পারে। একইভাবে ঘটতে পারে ভারতের ক্ষেত্রেও।

তিনি বলেন, একই শর্তে ভারতের সঙ্গে আগেও দুটি চুক্তি হয়েছে। দুটি ঋণের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করলে তৃতীয় চুক্তির অবস্থা একই হবে। তবে এ চুক্তির ফলে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘস্থায়ী হবে। তিনি এই ঋণের কাজগুলো যেন আন্তর্জাতিকমানের হয়, সেদিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।

তৃতীয় ঋণের শর্ত কমানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে নিগোসিয়েশনের সুযোগ থাকবে কিনা জানতে চাইলে এমকে মুজেরি বলেন, জেনেশুনে শর্ত দেখেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করা হয়েছে। নতুন করে সেই সুযোগ আর থাকছে না।