এ বছর বৈশ্বিক পরিস্থিতি অনুকূল থাকবে না

সুশাসন, জবাবদিহিতা এবং দক্ষতা অর্জন করতে পারলে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা কঠিন নয়। অর্থনীতির সেই শক্তি রয়েছে। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক সহযোগিতায় বাংলাদেশের সামনে বিরাট বাজার সুবিধা উন্মুক্ত হতে পারে। একে কাজে লাগাতে হবে। বিগত বছরের সামষ্টিক অর্থনীতির অস্থিরতাগুলোও নিয়ন্ত্রণে আসার সম্ভাবনা রয়েছে প্রচুর। ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, সম্প্রতি সমাপ্ত ডবিস্নউটিও’র বৈঠক, আঞ্চলিক সহযোগিতাসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। সংবাদ-এর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন হারাধন গাঙ্গুলী।

সংবাদ : সামষ্টিক অর্থনীতির ফান্ডামেটালসগুলোর অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গত বছরটি আমরা পার করলাম। সেই অস্থিরতাগুলো অর্থনীতিতে এখনো বিরাজমান। মুদ্রাস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা, ডলারের ক্রমাগত তেজিভাব, টাকার অবমূল্যায়ন, ব্যাংকের তারল্য সংকট, রিজার্ভে চাপ এবং নেতিবাচক বৈদেশিক দায় পরিশোধ। এই পটভূমিতে ২০১২-এর অর্থনীতিকে কীভাবে দেখবেন এবং বিশেষ করে দারিদ্র্য বিমোচনমুখী প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিনিয়োগে আপনার কোন বিকল্প ভাবনা আছে কি?

মোস্তাফিজুর রহমান : এটি ঠিক গত বছরের শেষের দিকে আমাদের অর্থনীতি বেশ কিছু ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতির কথা বলতে হয়। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর এই মূল্যস্ফীতি নেতিবাচক প্রভাব রেখেছে। সেটি আবার ব্যাংকের সুদের হারের ওপরও একটা ঊর্ধ্বমুখী চাপ সৃষ্টি করেছে। এর কারণে আমরা পরবর্তীতে দেখেছি ল্যান্ডিং রেটের ওপর ১৩ শতাংশ সুদের হারের যে ঊর্ধ্বমুখী একটা সিলিং ছিল সেটিও তুলে দিতে হয়েছে। কারণ যারা ব্যাংকে টাকা সঞ্চয় করে রেখেছিল তাদের বেশি হারে সুদ দিতে হচ্ছিল। এই মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকৃত সুদের হার বজায় রাখার জন্য এটি বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব রেখেছিল। সরকার ব্যাংকিং নন-ব্যাংকিং খাত থেকে অনেক ঋণ করেছে। বেসরকারি খাতের জন্য ব্যাংকিং খাতের ঋণে বিনিয়োগের যে প্রাপ্যতা তার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আমরা এটিও দেখেছি বাণিজ্যিক খাতের ভারসাম্যে নেতিবাচক পার্থক্য বেড়ে গিয়েছে। যদিও বাণিজ্য ভারসাম্যে পার্থক্য সব সময়ই ছিল। কিন্তু গত বছরে এটি আরও বেড়ে যায়। রেমিটেন্স এবং রপ্তানি আয়ের কারণে কারেন্ট অ্যাকাউন্টে সব সময়ই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার আয় ইতিবাচক ছিল। সময়ই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার আয় ইতিবাচক ছিল। গত বছরে সেটিও নেতিবাচক হয়ে পড়ে। যে কারণে ডলারের জোগান চাহিদার তুলনায় কমে যায়। এ কারণেও টাকার অবমূল্যায়ন ঘটে এবং আমদানিকৃত মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেয়। এসবের বিচারে বর্তমান বছরটি কেমন যাবে সেটি যদি আগাম কিছুটা বিশ্লেষণ করতে চাই, তাহলে বলব বৈশ্বিক পরিস্থিতি খুব একটা অনুকূল থাকবে বলে মনে হয় না এ বছর। ইউরো জোনের বিভিন্ন দেশগুলোতে বিশেষ করে মূল দেশগুলোতে যেমন জার্মানি, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়েছে। সেদিক থেকে বৈশ্বিক পরিস্থিতি অনুকূল থাকছে না। মূলত অভ্যন্তরীণ শক্তির ওপরই আমাদের বড় ধরনের নির্ভর করতে হবে। আমাদের রপ্তানির শতকরা সাড়ে ১৫ ভাগ বৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, বর্তমান অর্থবছরের জন্য সেটি আমরা অর্জন করতে পারব। রেমিটেন্সের যে প্রাক্কলন রয়েছে শতকরা ৯ ভাগ, আমার মনে হয় সেটিও আমরা অর্জন করতে পারব। জিডিপির প্রবৃদ্ধি এ বছরের জন্য ধরা হয়েছে ৭ শতাংশ। সেখানে সাড়ে ৬ থেকে ৭ শতাংশ অর্জন করা সম্ভব হবে। কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সমস্যাটা হলো বণ্টনগত। আপনি দারিদ্র্যের কথা বলেছেন_ সেখানে বণ্টনগত সমস্যার সৃষ্টি হবে। সেক্ষেত্রে কৃষি খাতের উন্নয়নের ওপর আমাদের জোর দিতে হবে। তাহলে বণ্টনগত সমস্যা অনেকাংশে দূর হবে অর্থনীতিতে। এছাড়া সামাজিক সুরক্ষার যেসব কর্মসূচি সরকারের রয়েছে, তার গভীরতা ও পরিধিও বাড়াতে হবে বণ্টনের দিকটি সামাল দেয়ার জন্য। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়ার জন্য।

আগেই বলেছি, প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি আমরা অর্জন করতে সক্ষম হবো। কিন্তু মূল্যস্ফীতির কারণে প্রবৃদ্ধির গুণগত দিকটির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সে কারণেই সরকারের সামাজিক নিরাপত্তার যেসব কর্মসূচি রয়েছে এবং অন্য যেসব উদ্যোগ রয়েছে সেগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।

সংবাদ : আপনি বলেছেন, রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রায় আমরা পেঁৗছতে পারব। প্রশ্ন হচ্ছে সেই আয় কি টাকায় আসবে, বিশেষ করে টাকার অবমূল্যায়নজনিত কারণে না ডলারে? এর সঙ্গে দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো গোটা দৃশ্যপটটি বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ ভাবনায় আপনার কী চিন্তা?

মোস্তাফিজুর রহমান : রেমিটেন্স এবং রপ্তানির কথা যখন বলি, তখন বৈদেশিক মুদ্রায় যে প্রাক্কলন হয় সেটিই বলি। সেটি ডলারেই হবে। এটি ঠিক যে, গত এক বছরে শতকরা ১৬ ভাগের মতো টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। ৭১ দশমিক ১৫ পয়সা ছিল জানুয়ারি ২০১১-তে। ২০১২-এর জানুয়ারিতে তা ৮২ টাকার উপরে চলে গেছে। এই যে ১৬ শতাংশের মতো অবমূল্যায়ন হচ্ছে, এটি একটা প্রণোদনা দিচ্ছে আমাদের রপ্তানি খাত এবং রেমিটেন্সে। মূল বিষয়টি হলো আমাদের রপ্তানি খাতটি মূলত উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপনির্ভর; কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়ার কিছু কিছু দেশে আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। তুরস্ক, ভারত, জাপান এসব দেশে রপ্তানি বাড়ছে। সেখানে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার প্রভাব তেমন একটা পড়ছে না। ভারতে আমরা শূন্য শুল্ক সুবিধা পেয়েছি। সে কারণে ২০০৩-এ যেখানে ১শ’ মিলিয়ন ডলারের কম ছিল রপ্তানি, সেখানে গত অর্থবছরে ৫১২ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হয়েছে। এ বছর সাড়ে ৬শ’ থেকে ৭শ’ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি যাবে বলে আশা করছি। তুরস্ক আর জাপানেও আমাদের রপ্তানি ভালো। ইউরোপীয় ইউনিয়নে রুলস অফ অরিজিন যেটি শিথিল করা হয়েছে, এক স্তরবিশিষ্ট আমরা তারও সুযোগ নিয়েছি। ভারত যে শূন্য শুল্ক সুবিধা দিয়েছে তারও পুরোপুরি সুযোগ এ বছর আমরা নিতে পারব বলে আশা করি।

সব মিলিয়ে ডলার প্রাপ্তির যে প্রাক্কলন আমাদের রয়েছে, তা পুরোপুরি অর্জন করা যাবে। ডলার সংকট হয়তো থাকবে না। বাজারের দিক থেকে সুবিধা এবং বিনিময় হারের সুবিধা দুটিই আমরা পাব আশা করি। রেমিটেন্সের ক্ষেত্রেও আশাবাদী।

অনেকেই ভেবেছিলেন মন্দার কারণে তেলের দাম বেড়ে যাবে। তেলের দাম ঠিকই আছে। তাই মধ্যপ্রাচ্যে যেখান থেকে দুই-তৃতীয়াংশ রেমিটেন্স আসে সেখানে শ্রমিক আবার যাচ্ছে। আমাদের শ্রম চাহিদা সেখানে আবার চাঙ্গা হচ্ছে। গত বছর সাড়ে ৫ লাখের মতো লোক গেছে সেখানে। এর আগের বছরের চেয়ে এটি বেশি। সুতরাং শ্রম রপ্তানির একটা গুণিতক প্রভাব আগামীতে পাব। তবে মন্দা গভীরতর হলে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে যেখানে এক-তৃতীয়াংশ রয়েছে, সেখানে শ্রম রপ্তানি হ্রাস পেতে পারে। সব মিলিয়ে ডলারের হিসাবে শতকরা ৯ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জনের অর্থাৎ ১২ বিলিয়ন ডলার আয়ের যে প্রাক্কলন আমাদের রয়েছে, তার কাছাকাছি আমরা যেতে পারব।

কিন্তু সমস্যা যেটি নিয়ে তা হলো বিনিয়োগ। বিনিয়োগের একটি দিক হলো রপ্তানিমুখী শিল্প। রপ্তানি যদি বাড়ে তবে শিল্পে কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু সার্বিক যে বিনিয়োগ অর্থাৎ আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদামুখী যে বিনিয়োগ এবং এমনকি রপ্তানিমুখী বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েকটি অসুবিধা। একটি হলো মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যবসার ব্যয়ভার বাড়ছে। শিল্পে বিনিয়োজিত হয় এমন সামগ্রীর আমদানি ব্যয় বাড়ছে। ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ সংকুচিত হচ্ছে। সুদের হার বাড়াতে হচ্ছে। সিলিংও তুলে নেয়া হয়েছে এবং যেহেতু সঞ্চয়কে উৎসাহিত করার জন্য প্রকৃত সুদের হার বাড়াতে হবে, সেখানে মূল্যস্ফীতি যদি ১০ শতাংশের উপরে হয় সেখানে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত আমানতের সুদের হার নির্ধারিত না হলে জনগণ সঞ্চয়ে উৎসাহিত হবে না। সেটি হলে ব্যাংকগুলোকে ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ সুদের হারে ঋণ দিতে হবে। সুতরাং এখানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক প্রভাব আমরা লক্ষ্য করি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হতে পারে। তবে এরা ব্যাংক ঋণের ওপর খুব একটা নির্ভরশীল নয়। কারণ এরা অধিকাংশই এসএমই ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে হ্রাসকৃত সুদের হারে ঋণ পেয়ে থাকে। সুতরাং এক্ষেত্রে বিনিয়োগ সংকট খুব একটা দেখা দেবে না। রপ্তানি ও কৃষিতেও হ্রাসকৃত সুদের হার রয়েছে।

তারপরও সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি ও সুদের হার ইত্যাদি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করবে। বিনিয়োগের জন্য প্রধানত যেটি দরকার, তাহলো বিদ্যুৎ। বর্তমান সরকার প্রায় ২৯শ’ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ এনেছে বা ২ হাজারের উপরে নিট মেগাওয়াট যোগ হয়েছে। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা ইতিবাচক ফল পাচ্ছেন। যারা আগে ডিজেল ব্যবহার করতেন, বিদ্যুৎ অনিয়মিত ছিল, মেশিনপত্র নষ্ট হয়ে যেত, খরচ বেশি পড়ত তা থেকে তারা এখন কিন্তু কিছুটা সাশ্রয়ী অবস্থায় আছেন। সেদিক থেকে বিনিয়োগে একটি ইতিবাচক প্রভাবও যে আছে, সেটি মেনে নিতে হবে। সবটা মিলিয়ে আমার মনে হয় যে, বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধির হার যেটি ধরা হয়েছিল শতকরা ২৪ ভাগ, সেখানে সরকার ৫ ভাগ এবং বেসরকারি খাত ১৯ ভাগ, সেটির কাছাকাছি হয়তো আমরা যাব। কিন্তু বিনিয়োগের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি দক্ষ জনশক্তি, উৎপাদনশীলতা যেগুলো আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার জন্য খুব দরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে বিদেশিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য, দেশের বাজারে আমাদের শিল্প মালিকরা যাতে অন্য দেশের পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে সেদিকে নজর দেয়ার সময় আমাদের কিন্তু আসছে। যদিও দক্ষতা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ব্যাপার একটি মধ্যমেয়াদি বিষয়।

এফডিআইর দিক থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এখানে যদিও কিছুটা প্রবৃদ্ধি আমাদের আছে। কিন্তু ঋণ, পরিসেবা ইত্যাদির কারণেও দেখা যায় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে। এটি খেয়াল রাখতে হবে। এফডিআইর দিক থেকে বলতে পারি যে, সাধারণত একটি সম্ভাব্য ভালো এফডিআইর গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হয়। আমরা জানি, ব্রিকস রিপোর্টে ১১টি দেশের কথা বলা হয়েছে, সেখানেও বাংলাদেশ রয়েছে।

প্রতিযোগিতার যে সক্ষমতা আমাদের আছে, আমাদের যে প্রতিযোগিতায় সক্ষম মূল্যে শ্রম নিয়োজনের সুযোগ আছে, আমাদের প্রণোদনা কাঠামো ভালো, এখন যদি অবকাঠামোটা ঠিক করতে পারতাম, তাহলে বাংলাদেশ কিন্তু একটি বড় এফডিআই গন্তব্যের দেশে পরিণত হতে পারত। সব সুযোগই কিন্তু আমাদের আছে। আমরা যদি দেখি, এক্ষেত্রে ভিয়েতনাম যেখানে ৭-৮ বছর আগেও ১ বিলিয়ন ডলারে ছিল, এখন ১৫ বিলিয়ন ডলারে চলে গেছে। আমরা এখনো ১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ঘোরপাক খাচ্ছি। অবকাঠামো উন্নয়নে যদি জোর দিতে পারি, তাহলে ২০১২ সালে এফডিআইর প্রবণতা যেটি আছে, তা থেকে আরও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এই অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি টাকার অবমূল্যায়ন_ এগুলো যদি কিছুটা স্বস্তি পর্যায়ে রাখতে পারি, তার ওপর নির্ভর করবে বিদেশি বিনিয়োগ কতটা আসবে।

সংবাদ : একদিকে মুক্তবাজার অর্থনীতির আদর্শিক অবস্থান, অন্যদিকে আমাদের বাস্তবতা_ এ বিবেচনায় ডলার ফ্লটিংয়ে যাওয়া ও সুদের হারে আপার সিলিং তুলে দেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে বলে মনে করেন? একই সঙ্গে এফডিআই ও বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া এবং অনুদান ছাড় করানোর প্রশ্নে আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতির সক্ষমতা কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

মোস্তাফিজুর রহমান : সুদের হারের সিলিং তুলে যদি না দিত, তাহলেও বাজারের নিজস্ব নিয়মে এটি কিন্তু সবাই ভাঙা শুরু করছিলেন। আমাদের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তুলনা করলে প্রকৃত সুদের হার যেখানে ১৩-১৪ শতাংশ রাখতে হবে, সেখানে ১৩ শতাংশ হারে ঋণ দেয়া কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আপনার প্রশ্নের দুটি দিক রয়েছে। স্বল্পমেয়াদের কথা যদি বলি তবে বলব, অন্য দেশের তুলনায় স্প্রেড আমাদের অনেক বেশি। সেখানে দক্ষতা বৃদ্ধি, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রভিনশিয়াল ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি করে এই স্প্রেড যদি কমাতে পারি, তাহলে ঋণযোগ্য তহবিলের ওপর সুদের হার কমানো সম্ভব। এ জায়গাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারির প্রয়োজন আছে। আমরা ব্যাংকগুলোর কার্টেন গড়ে তোলার খবর প্রায়ই শুনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ দিকটাও দেখার দরকার আছে। স্প্রেডটা যাতে কমানো যায় সেটি দেখতে হবে। এটি হলো একটা দিক। দ্বিতীয়ত, সরকার বিভিন্ন জায়গায় যেসব প্রণোদনা দেয় এবং বিশেষ বিশেষ খাতে বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠানের স্বল্প সুদে ঋণদানের যেসব কর্মসূচি রয়েছে তার জন্য একটি ভালো আবহাওয়া তৈরি করা। যেমন এসএমই ফাউন্ডেশন, পিকেএসএফ বা ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এরা যাতে স্বল্প সুদে কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণদানে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে আসে সেটি দেখতে হবে। কারণ ব্যাংকগুলো অন্যান্য খাতে যেখানে ঋণ দিলে ১৭-১৮ শতাংশ সুদ পাবে, সেখানে তারা ৭ শতাংশ হারে কৃষিঋণ দিতে যাবে কেন? সুতরাং সরকারকে এ দিকটি দেখতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বও বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্রঋণ এখন ব্যাপকভাবেই কৃষি ও কৃষিবহির্ভূত খাতে ঋণ দিচ্ছে। সুতরাং এ জায়গাগুলোতে একটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তবে এসবই হলো স্বল্পমেয়াদি। আর মধ্যমেয়াদি হলো সুদের হার কমাতে হলে আমাদের অবশ্যই মূল্যস্ফীতির হার কমাতে হবে।
সেটি আবার সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা ও বৈশ্বিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির ওপর নির্ভর করছে। এছাড়াও দেখতে হবে টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকানো যাবে কি না। টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে গেলে আবার রিজার্ভ পরিস্থিতি ভালো থাকতে হবে। আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগে হলে বর্তমান পরিস্থিতিতে ২-৩ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছেড়ে দিত। যদি তার ১৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থাকত। এটি করা হলে ডলারের আজকের এ অবস্থা হতো না। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেই ম্যানুভারিং সক্ষমতা এখন আর নেই।

সংবাদ : বৈদেশিক সাহায্য ছাড়ের প্রশ্নে কিংবা প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রশ্নে আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতির সক্ষমতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী হতে পারে?

মোস্তাফিজুর রহমান : বৈদেশিক সাহায্যের পাইপলাইনে যে ডলার রয়েছে বলে আপনি উল্লেখ করেছেন, তা কীভাবে দ্রুত অবমুক্ত করতে পারি, তা ভাবতে হবে। বিশ্বব্যাংকের জরুরি ত্রাণ সহায়তা তহবিলের অধীনে ঋণের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে, বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণের অবমুক্ত করা এবং বড় বড় প্রকল্পগুলোর জন্য আমরা টাকা আনতে পারছি না। সেগুলো যদি করতে পারি, রিজার্ভ পরিস্থিতিতে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেক্ষেত্রে টাকার অবমূল্যায়ন যেমন রোধ করা যাবে তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার প্রয়োজনীয়তাও কমবে। ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেটি আবার সুদের হারের ওপরও ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। সুতরাং এভাবে মধ্যমেয়াদি করণীয় আমাদের আছে। দু’দিক থেকেই আমাদের কাজ করতে হবে। কৃষিখাত আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত। বোরো ফসল আসছে। ডিজেলের দাম বাড়ছে। ড. মাহবুব হোসেন বলেছেন, এতে ৪ শতাংশের মতো খরচ বাড়তে পারে। সেখানে কৃষকরা কিছু উপকরণ যাতে সময়মতো পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে যদি কৃষকরা ভালো দাম পায় তাহলে বর্ধিত খরচ তারা পুষিয়ে নিতে পারবে। এক্ষেত্রে অবশ্য সরকারের ভূমিকা ইতিবাচক। এক্ষেত্রে সরকারের বড় সাফল্য রয়েছে। আপনি অর্থনৈতিক কূটনীতির কথা বলেছেন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান দুনিয়ায় কূটনীতি মানেই অর্থনৈতিক কূটনীতি। সেদিক থেকে অনেক দেশেই কিন্তু আমাদের দূতাবাস নেই, কমার্শিয়াল কাউন্সিলর নেই। ল্যাটিন আমেরিকাতে আমাদের দূতাবাসের সংখ্যাতো হাতেগোনা। অনেক দেশে আছে কি না তাও জানি না। এ জায়গাগুলোতে দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ করতে হবে। বিশেষ করে যেসব দেশে আমাদের শ্রমিকরা যান, সেখানে আমাদের কূটনীতির অধিক দক্ষতার দরকার রয়েছে।

সংবাদ : বিনিয়োগ নিয়ে বলুন। বর্তমানে জিডিপির ২৪ শতাংশ বিনিয়োগে যাচ্ছে। একে ৬ষ্ঠ পরিকল্পনায় ৩২ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার প্রাক্কলন করা হয়েছে। প্রাক্কলিত লক্ষ্যে যেতে পারা যাবে কি?

মোস্তাফিজুর রহমান : আপনার প্রশ্নটি খুবই প্রাসঙ্গিক। সরকারি খাত, বেসরকারি খাত, পিপিপি এবং এফডিআই_ এই চারটি খাতই এখানে যুক্ত। সেখানে সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনীতির ঝুঁকিগুলো যদি আমরা কমাতে পারি, তাহলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে। সেটি যদি না হয়, তাহলে মূলধন পাচার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। অতীতে এটি দেখা গেছে। টাকার মূল্য আবার অবমূল্যায়ন হতে পারে। বিনিয়োগকারীদের এমন আশঙ্কা হলে তারা টাকা ডলারে রাখার জন্য বাইরে পাচার করে দেবেন।
ইউএনডিপি ও আংকটাডের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, এভাবে বাংলাদেশ থেকে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার বাইরে চলে গেছে। যা আমাদের বৈদেশিক সাহায্যের প্রায় সমপরিমাণ। এই জায়গাগুলোতে আমরা যদি সামষ্টিক অর্থনীতিতে একটি সুস্থির ও স্থিরতা আনতে পারি, তাহলে বাইরে পাচার না হয়ে টাকাগুলো দেশেই বিনিয়োগ হওয়ার বেশি সম্ভাবনা থেকে যাবে। সেদিক থেকে আমাদের মতো দেশে জিডিপির ৩২ শতাংশ বিনিয়োগ হওয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে আমাদের সঞ্চয়ের হার বৃদ্ধি করতে হবে। আমরা জানি, আমাদের সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে একটি ফারাক রয়েছে। যদি সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকিগুলো কমাতে পারি, তাহলে একদিকে সঞ্চয় বিনিয়োগের ফারাক কমে আসবে, অন্যদিকে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে বাড়বে। তবে এর একটা মূল নিয়ামক হবে অবকাঠামোর উন্নয়ন। অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে বিনিয়োগে ফ্রাউড-ইন হবে। এর আরেকটা দিক হলো, ৩২ শতাংশ বিনিয়োগে যেতে হলে যেটিকে বলা হয় বর্ধিত পুঁজি উৎপাদন অনুপাত (ওহপৎবসবহঃধষ পধঢ়রঃধষ ড়ঁঃঢ়ঁঃ ৎধঃরড়), এই হতে হলে আয়কর কমাতে হবে। আয়কর কমাতে যদি না পারি তাহলে প্রবৃদ্ধিতে এটি পরিণত হবে না। আমাদের আয়কর এখন ৪:১-এ আছে। সুতরাং বিনিয়োগ যদি আরও ১০ শতাংশ বাড়াতে হয়, তবে আয়কর ৩ থেকে সোয়া ৩-এ নিয়ে যেতে হবে। তাহলে আমরা ডাবল ডিজিট প্রবৃদ্ধিতে যেতে পারব। সেটি করতে হলে দক্ষতা, দক্ষ জনশক্তি সেখানে বিনিয়োগ করা এবং বিশেষ করে কৃষিতে আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতির এই ভাটার সময় আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।

এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় হলো, আঞ্চলিক বিশেষ করে ভারত শূন্য শুল্ক দেয়ায় রপ্তানিমুখী বিনিয়োগের একটি বিরাট সুযোগ এসে গেছে আমাদের। ভারতীয় বিনিয়োগ বাংলাদেশে এসে শূন্য শুল্ক সুবিধাটা নেয়া অথবা বৈদেশিক বিনিয়োগও বাংলাদেশে এসে ভারতের বিশাল বাজারে প্রবেশের সুযোগটা নেয়া। বিশেষ করে এটি কাজে লাগানোর জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা নেয়া উচিত।

সংবাদ : শূন্য শুল্কে ভারতে বিনিয়োগ বা রপ্তানির আশাপ্রদ সম্ভাবনা আপনি দেখছেন। ভারতের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকার পরও দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে হুটহাট ভারতের শুল্ক ও শুল্কবহির্ভূত বাধা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? বিআইডিএস গবেষণায় দেখিয়েছে, এমন প্রায় একশটি অশুল্ক বাধা রয়েছে ভারতের।
মোস্তাফিজুর রহমান : নানা ধরনের অসুবিধা আছে। তার পরও আমি কিন্তু বাংলাদেশকে দেয়া ভারতের এই সুবিধা দেয়ার ব্যাপারে প্রচ- আশাবাদী। দেখুন, আমরা যখন বাজার উন্মুক্ত করলাম, ভারত কিন্তু এর ভালো সুযোগ নিল এবং এখন সাড়ে ৪ মিলিয়ন ডলারের মতো, আমরা যে ৩৩ মিলিয়ন ডলার আমদানি করি তার এটি একটি বড় অংশ। শতকরা প্রায় ৭/৮ ভাগের মতো ভারতের বাজার থেকে আসছে। এটি একটা বড় ঘটনা যে, ভারত আমাদের শূন্য শুল্কের সুবিধা দিয়েছে। ২০০৩ সালে আমরা রপ্তানি করেছি ১শ’ মিলিয়ন ডলার। গত বছরে আমরা ৫১২ মিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি করেছি। ৮ বছরে আমরা ১শ’ থেকে ৫শ’তে চলে গেছি। সুতরাং যে বাধাগুলোর কথা আপনি বললেন, সেগুলো সত্যিই কিন্তু আমাদের রপ্তানিকারকরা এখানে দেখছেন না। এখানে ওহঃবৎবংঃরহম ব্যাপার হলো_ অন্যান্য দেশে যারা রপ্তানি করেন ভারতে রপ্তানি কিন্তু সে রকম নয়। এখানে অনেকেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিমাণে রপ্তানি করছেন। সুতরাং দারিদ্র্য নিরসন ও কর্মসংস্থানের ওপর এর বেশ একটা ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে।

দুই, বিশ্বে আমাদের রপ্তানির শতকরা ৮০ ভাগ হলো তৈরি পোশাক। আর ২০ ভাগ হলো নন-রেডিমেট গার্মেন্টস। ভারতের কিন্তু তার উল্টো। ভারত তার রপ্তানির মাত্র ২০ ভাগ রেডিমেট গার্মেন্টস। ৮০ ভাগ নন-রেডিমেট গার্মেন্টস। সুতরাং রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণের দিক থেকে এটি গুরুত্বপূর্ণ। সেই জায়গাগুলোতে কিন্তু আমাদের একটি বড় সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এই শূন্য শুল্ক সুবিধার কারণে। হ্যাঁ, এটি ঠিক অনেক ধরনের অশুল্ক বাধা ভারতের দিক থেকে রয়েছে। এগুলোকে মোকাবিলা করেই কিন্তু আমরা ৮ বছরে ১শ’ মিলিয়ন থেকে ৫শ’ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাড়িয়েছি। আমরা যদি বাধাগুলো মোকাবিলা করতে পারি, অদূর ভবিষ্যতে ১ থেকে ২ বিলিয়ন ডলারে আমরা একে নিয়ে যেতে পারব। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

আমরা ভারতের বাজার জানি। আমাদের পরিবহন ব্যয় কম। প্রতিযোগিতা সক্ষমতা রয়েছে। সিপিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভারত অনেক পণ্য বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করে। বাংলাদেশ থেকে করে না। আবার বাংলাদেশ সেসব পণ্য অন্য দেশগুলো থেকে আমদানি করে। কিন্তু ভারত থেকে করে না। এই যে একটা ফাঁক, যেখানে পারস্পরিক সক্ষমতা থাকার পরও কেউ কারও কাছ থেকে রপ্তানি-আমদানি করছে না। এই বাজার কিন্তু খুব বড়। এটিকে যদি আমরা টার্গেট করতে পারি, সেটি হলো একটা দিক। এর জন্য বিনিয়োগ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় বিনিয়োগ যেটি ভারতের বাজারে ঢুকতে পারলে শূন্য শুল্ক সুবিধা। বৈদেশিক বিনিয়োগ যেটি ভারতের বিশাল বাজারে ঢুকতে পারলে শূন্য শুল্ক সুবিধা।

আর আমাদের নিজস্ব বিনিয়োগ তো আছেই। এই তিনটির কম্বিনেশন করতে হবে। এখন অশুল্ক বাধা গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তিন ধরনের অশুল্ক বাধা আছে। একটা হলো_ ঞৎধফব ভধপরষরঃধঃরড়হ. অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে ৯০ শতাংশ বাণিজ্যই হয় সড়কপথে। সেখানে রাস্তাঘাটের উন্নতি, অবকাঠামোর উন্নতি, কাস্টম পয়েন্টের উন্নতি। এখন যে কানেকটিভিটির কথা বলা হচ্ছে_ সেটি যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি, তা হলো একটা দিক।

দ্বিতীয়টি হলো বিভিন্ন মান বজায় রাখা সংক্রান্ত। এটিা শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়। যে কোন দেশ থেকে আমদানি করলে এই মান নির্ধারণের প্রশ্ন এসে যায়। তবে এক্ষেত্রে আমাদের বিএসটিআই এবং ভারতের বিএসআই’র মধ্যে একটা পারস্পরিক স্বীকৃতির চুক্তির দিকে আমরা এগোচ্ছি। এর ফলে বিএসটিআই’র সক্ষমতা বাড়বে। ফলে মান সংক্রান্ত পণ্যের অশুল্ক বাধা আর থাকবে না। আর একটি হলো সার্কের অধীনে মান নির্ধারণের একটি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ঢাকায় হবে। ঝঅঅজঈ জবমরড়হধষ ঝঃধহফধৎফরুধঃরড়হ ঙৎমধহরুধঃরড়হ. এটি হলে মান নির্ধারণের সক্ষমতা বৃদ্ধির একটা সুযোগ আমরা পাব। যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি ঢাকায় হচ্ছে।

তৃতীয়টি প্রকৃত অর্থেই অশুল্ক বাধা। এ বাধা কাটাতে দু’দেশের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বৈঠক হচ্ছে। এর সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। উভয়পক্ষই মূল সমস্যাকে অ্যাড্রেস না করে কীভাবে পিঠ বাঁচিয়ে চলা যায় সেই চেষ্টাই করছেন। তবে সমাধানের এটি একটা চলমান প্রক্রিয়া। তবে আপনি যে অর্থনৈতিক কূটনীতির কথা বলেছেন, তারই সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তাহলে আমরা এ বাধাগুলো দূর করতে পারব। তবে ভারতের সঙ্গে শূন্য শুল্কে বাণিজ্য আমাদের একটি বড় অর্জন।

সংবাদ : ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার রাজনৈতিক লক্ষ্যের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হলো দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য হ্রাস। গোটা পরিকল্পনার সার্বিক বিচারে এ লক্ষ্য অর্জনের বাস্তবতা সম্পর্কে আপনার ভাবনা কী?

মোস্তাফিজুর রহমান : এ পরিকল্পনাকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। এর দুটি দিক। একটি হলো প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয়টি হলো বণ্টনগত। এর মধ্যে ঞৎধফব ড়ভভ নিশ্চয়ই আছে। দেখা গেছে, দ্রুত প্রবৃদ্ধি করতে গেলে বৈষম্য বাড়ে। আবার বৈষম্য হ্রাসের জন্য বিনিয়োগ বাড়ালে প্রবৃদ্ধি অর্জনে ঘাটতি দেখা দেয়। এই টানাপড়েনের মধ্য দিয়েই যেতে হয়। পরিকল্পনার মধ্যে যেটি করা হয়েছে সেটি হলো ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির দিকে আমরা যাব। কিন্তু বণ্টনগত বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে। এটি একটা চ্যালেঞ্জিং টার্গেট। কিন্তু আমার মনে হয়, এটি সম্ভব। এটি পরিকল্পনাতেই বলা হয়েছে। এটি একটি নির্দেশনামূলক পরিকল্পনা, কারণ আমাদের সরকারি খাত অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ এডিপিতে সরকার ৫-৬ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করে না। সেখানে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বড় বড় অবকাঠামোর যেসব কথা বলা হয়েছিল, পরিকল্পনার শেষে বিদ্যুতের যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এবং কেবল উৎপাদন নয়, সাশ্রয়ী হারে উৎপাদন করা_ এটিও কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কারণ প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অনেক সময়ে নির্ভর করবে সাশ্রয়ী হারে বিনিয়োগকারী বিদ্যুৎ কিনতে পারছেন কি না তার ওপর। পরিকল্পনার টার্গেট পূরণ অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করবে। যেমন আমাদের নিজস্ব এনবিআর, নন-এনবিআর’র মাধ্যমে সঞ্চয় বাড়াতে পারছি কি না। এর থেকে রাজস্ব ব্যয় বাদ দিয়ে যা উদ্ধৃত থাকবে, তা বিনিয়োগে নিয়ে যেতে পারছি কি না। বাইরের অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সেটি করতে হলে আমাদের জবাবদিহিতা, সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। আমরাতো দেখছি বড় বড় প্রকল্প কীভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। টাকা আসছে না। সেটির কারণে যে সরকারি বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়। বেসরকারি খাত যখন আইএফসিসহ অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে তারাও কিন্তু প্রাপ্তিতে সংকটে পড়ে গেছে। সবটাই নির্ভর করবে সরকারের বড় ভূমিকার ওপর। বৈষম্য হ্রাসের নামে দারিদ্র্যকে তো বণ্টন করা যাবে না। টেকসই কর্মসংস্থান দারিদ্র্য বিমোচনের বড় উপায়। এর সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচি বাস্তবায়নতো থাকছেই। তবে বৈষম্য হ্রাসে গ্রামীণ অর্থনীতিতে খাস জমি, জলা ইত্যাদির বণ্টন ও সংস্কার সম্পর্কিত আপনার বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত।

তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সাশ্রয়ী হারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্যমেয়াদি যে পরিকল্পনা, সেটিই চূড়ান্তভাবে ৬ষ্ঠ পরিকল্পনার মূল্যায়নে ক্রিটিক্যাল ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে কৃষির গুরুত্ব অব্যাহত রাখতে হবে। যদিও পরিকল্পনায় জিডিপিতে এর অবদান কমছে। তার পরও এর পরিমাণ, এই খাতে কর্মনিয়োজন, গ্রামীণ খাতে কৃষিবহির্ভূত খাতের অবদান ইত্যাদি বিবেচনায় এখন কৃষি খাত বড়। সুতরাং এর গুরুত্ব অব্যাহত রাখতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ।

সব মিলিয়ে বলব, দক্ষ জনশক্তি তৈরির বিকল্প আর কিছু নেই। আমরা বলি, আমাদের শ্রম সস্তা। কিন্তু আমরা তো শ্রম বিক্রি করব না। আমরা বিক্রি করব পণ্য। সুতরাং পণ্যের মান প্রতিযোগিতামুখী না হলে শ্রম ব্যয় বেড়ে যায়। সুতরাং দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে।

গোটা পরিকল্পনার বাস্তবায়নকে যদি একটি সুশাসনের বলয়ে নিয়ে আসা যায়, তাহলে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে আমাদের বেগ পেতে হবে না। এখন আমাদের ১১০ বিলিয়ন ডলার জিডিপি আছে। ৮ শতাংশ বৃদ্ধি করা মানে বছরে আরও ৯ বিলিয়ন ডলার বাড়ানো। বাংলাদেশে যদি আমরা ১ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরি, তাহলে আমাদের মাথাপিছু আয় ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে বাড়বে ৬ দশমিক ৬ শতাংশের মতো। এটি কিন্তু তেমন বেশি নয়। ডাবল ডিজিটে যাওয়ার পরিকল্পনা আমাদের করতে হবে।
সংবাদ : এরপরও দারিদ্র্য বৈষম্য দূরীকরণে ভূমি মালিকানার বণ্টন নিয়ে পরিকল্পনায় কিছু বলা হয়নি। আপনার মন্তব্য কী?
মোস্তাফিজুর রহমান : এটি সত্য, দারিদ্র্য বিমোচনে খাস জমির বণ্টন গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বেষ্টনীর সম্প্রসারণও দারিদ্র্য বিমোচনে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ।
তবে এ মুহূর্তে একটি ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন যদি আমরা করতে পারি, সেদিকেই যেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত বণ্টনের দিকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষি ও শিল্পে প্রবৃদ্ধি ঘটলে কর্মসংস্থান সম্প্রসারিত হবে। দারিদ্র্য নিরসনের উৎকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। সেটি না হলে বণ্টনের নামে দারিদ্র্র্যকেই বণ্টন করতে হবে। বৈষম্য থাকলে বণ্টনও বৈষম্যমূলক হবে। আগে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। তবে সেই প্রবৃদ্ধির চরিত্রটি কী হবে, তাও বিবেচনায় নিতে হবে। পরিকল্পনার মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, যেসব কথা বলা হয়েছে তা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব কি না।
সংবাদ : জেনেভায় অনুষ্ঠিত ডবিস্নউটিও’র সাফল্য কতখানি, বিশেষ করে যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বল্পোন্নত দেশের বাস্তবতাই মেনে নিতে চায়নি? বিকল্প আঞ্চলিক সহযোগিতাকে কতখানি গুরুত্ব দিতে চান?

মোস্তাফিজুর রহমান : ২০০১ সালে দোহা রাউন্ড শুরু হয়েছিল। ১১ বছর চলে গেল, তার সমাপ্তি আমরা দেখছি না। বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশে যেখানে শূন্য শুল্ক দেয়ার কথা ছিল, তা দেয়া হয়নি। জেনেভায় মন্ত্রী পর্যায়ে অষ্টম বৈঠক যে হলো সেখানে আমরা দেখেছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক যে অবস্থা তার জন্য তারা কিছুটা সংরক্ষণশীল ভূমিকা রেখেছে। যার জন্য কোন ধরনের নেগোশিয়েসন পর্যন্ত হয়নি। শুধু একটি চেয়ারম্যান সামারি হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে আমরা সহায়তা দেব।

আমাদের প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং বিকাশে এক কথায় আঞ্চলিক সহযোগিতার কোন বিকল্প নেই। এই সহযোগিতার বহুবিধ মাত্রিকতাই এখন আমাদের উপায় বলে আমরা মনে করি। বাজারের প্রশ্নে, রপ্তানির প্রশ্নে, বিনিয়োগের প্রশ্নে, যোগাযোগের প্রশ্নে এবং প্রযুক্তি স্থানান্তরের প্রশ্নে আঞ্চলিক সহযোগিতাই একমাত্র কাম্য। এ সহযোগিতা বাংলাদেশের কাছে উন্মুক্ত বাজারের অপার সুযোগ এনে দেবে।

সংবাদ : সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মোস্তাফিজুর রহমান : আপনাকে এবং সংবাদ-এর পাঠকদের ধন্যবাদ।