গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারে সরকার: ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Published in সকালের খবর on Monday, 26 December 2016

গার্মেন্টস শ্রমিকদের দাবিগুলোও বিবেচনায় নেওয়া দরকার

rmg-sectorগার্মেন্টস শ্রমিকদের দাবিগুলোও বিবেচনায় নেওয়া দরকারএসএম আলমগীর: নতুন মজুরি বোর্ড গঠনসহ বেশ কিছু দাবি তুলে প্রায় দু’সপ্তাহ আন্দোলনের পর গতকাল কাজে যোগদান করেছে আশুলিয়া এলাকার গার্মেন্টস শ্রমিকরা। তবে কাজে ফিরলেও শ্রমিকরা তাদের দাবিগুলো বাস্তবায়ন চাচ্ছে। অর্থনীতিবিদ এবং শ্রমিক নেতারাও মনে করছেন শিল্পের স্বার্থে ও দেশের অর্থনীতির ক্ষতির দিক বিবেচনা করে আপাতত হয়তো শ্রমিকরা শান্ত হয়ে ফের কারখানার চাকা ঘোরাতে শুরু করছে, কিন্তু এই দাবিতে তারা আবারও পথে নামতে পারে। শ্রমিকরা যাতে আবারও কারখানার কাজ ফেলে পথে না নামে সেটা দেখার দায়িত্ব সরকার ও মালিকদের।

অবশ্য তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) নেতারাও অনুধাবন করছেন নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করা না হলেও শ্রমিকদের অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো যায় কি না। বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনাও চলছে বলে বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে মজুরি বৃদ্ধির দাবি শ্রমিকরা যথাযথভাবে উপস্থাপন করেনি বলে বিভিন্ন মন্ত্রী ও বিজিএমএই নেতারা বক্তব্য দেওয়ায় শ্রমিক নেতারা এখন সঠিক নিয়ম মেনে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের প্রস্তাব দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। এ বিষয়ে শ্রমিক নেতারা বলেন, আগামী সপ্তাহের মধ্যেই বিভিন্ন শিল্প এলাকার সাধারণ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এবং শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে মিলিতভাবে আলোচনা করে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। এরপর চূড়ান্ত প্রস্তাবনা শ্রম মন্ত্রণালয়, শ্রম অধিদফতর এবং গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএতে দেওয়া হবে। এছাড়া আজ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এই বৈঠকেও শ্রমিক নেতারা বিষয়গুলো আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করবেন বলে জানা গেছে।

শ্রমিকদের দাবি বাস্তবায়নের বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, কয়েক দিনের আন্দোলনের পর শ্রমিকরা কাজে ফিরেছে-এটা স্বস্তির খবর। তবে শ্রমিকদের কাজে ফেরা মানেই এই নয় যে, তাদের সমস্যাগুলো কেটে গেছে। এবারের শ্রম আন্দোলনের মাধ্যমে কারখানা পর্যায়ে বেশ কিছু সমস্যা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানা গেছে। যেমন কোনো কারখানায় ওভারটাইম নিয়ে জটিলতা রয়েছে, কোনোটিতে ছুটি দেওয়া নিয়ে ঝামেলা, আবার কোনোটিতে মিড লেভেল ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে সাধারণ শ্রমিকদের দ্বন্দ্বের বিষয় রয়েছে। সবার আগে এসব সমস্যা সমাধান করতে হবে। কারণ অতীতে দেখা গেছে, এ রকম ছোট ছোট সমস্যাকে ঘিরে বড় শ্রমিক অসন্তোষ হয়েছে। গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিটি একেবারে অযৌক্তিক, তাও বলা যাবে না। মজুরি বৃদ্ধির বেশ কিছু যৌক্তিক কারণ দেখানো হয়েছে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, ঘরভাড়া বেড়েছে। এসব বিষয়ে মালিকদের পাশাপাশি সরকারও ভূমিকা রাখতে পারে। গার্মেন্টস শিল্প এলাকাগুলোতে শ্রমিকদের জন্য রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারে সরকার। ১০ টাকার চাল তাদের মধ্যে দিতে পারে। এছাড়া শিল্পপ্রবণ এলাকায় শ্রমিকের সন্তানদের পড়াশোনার খরচ বিশেষ বিবেচনা করে কম নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। একইভাবে শ্রমিকরা যাতে কম টাকায় চিকিত্সাসেবা নিতে পারে তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বাড়িভাড়াও অন্যদের তুলনায় শ্রমিকদের জন্য কম রাখা যেতে পারে। এসব উদ্যোগ নিলে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক কমে আসবে।

তিনি বলেন, নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের বিষয়ে বিজিএমইএ নেতরা হয়তো এখন দ্বিমত পোষণ করছেন। তারা বলছেন, ৫ বছর পর বাড়ানো হবে বেতন। কিন্তু ৫ বছর পরই যে বাড়াতে হবে এমন কোনো বিষয় নয়, সার্বিক দিক বিবেচনা করে আগেও বাড়ানো যেতে পারে। তবে এখনই বাড়াতে হবে বিষয়টি তেমন নয়, মালিকরা এখন একটা ঘোষণা দিতে পারেন যে, আগামী ছয় মাস বা এক বছর পর বাড়ানো হবে মজুরি। তাছাড়া এখনই মজুরি না বাড়িয়ে মহার্ঘ্যভাতা, ওভারটাইম বৃদ্ধিসহ অন্যান্য সুবিধাও বাড়ানো যেতে পারে। সব শেষে আমি বলব, শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে সবাই নমনীয় হবেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতানউদ্দিন আহমেদ বলেন, মজুরি বৃদ্ধিসহ শ্রমিকদের দাবিগুলো অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। শ্রমিকরা তাদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানাতেই পারে, সে অধিকার তাদের আছে। কিন্তু শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবি তুললে তাদের হয়রানি করা কখনই কাম্য নয়। আমি মনে করি, সরকার শ্রমিকদের দাবিগুলো নিয়ে সচেতন হবে এবং মালিকদের বুঝিয়ে বেতন বাড়ানোর উদ্যোগ নেবে। এর আগেও তিন বছরের মাথায় বেতন বাড়ানো হয়েছে। তাহলে এখন বাড়ালে সমস্যা কোথায়। এই তিন বছরে তো জীবনাযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লে তো এই নিম্ন আয়ের শ্রমিকদেরই কষ্ট হয় বেশি।

তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার কথা বলা হলেও এখনও সেভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ পাচ্ছে না শ্রমিকরা। তাছাড়া কারখানা পর্যায়ে যেসব শ্রমিক ইউনিয়নের কমিটি কাজ করে সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। শ্রমিক সংগঠনগুলোকে এক্ষেত্রে আরও সচেতন হয়ে এবং শ্রমিক স্বার্থরক্ষায় কাজ করতে হবে। এছাড়া সরকারি পর্যায়ে বা বিজিএমইএ নেতারা যেকোনো সঙ্কটে কেন্দ্রীয় শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু কেবল কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে বৈঠক করলেই হবে না, আঞ্চলিক পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

লিখিতভাবে প্রস্তাব দেওয়ার প্রস্তুতি : এবার লিখিতভাবে মজুরি বৃদ্ধির আবেদন জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। এ বিষয়ে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, বিজিএমইএ নেতারা এবং মন্ত্রীরা বলেছেন, শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাবটি যথাযথভাব উপস্থাপন করেনি। এজন্য আমরা এবার আনুষ্ঠানিকভাবে লিখিত প্রস্তাব দেব। আগামী এক সপ্তাহে আমরা বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি চূড়ান্ত করব।

আরেক শ্রমিক সংগঠনের নেতা জাগো বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, শ্রমিকরা কাজে ফিরেছে এতে আমরাও খুশি। কিন্তু আমরা আমাদের দাবিগুলো ভুলে যেতে চাই না। দাবিগুলো আমরা এবার লিখিত আকারে দেব মালিক এবং সরকারকে। আশা করব, মজুরি বৃদ্ধির দাবি মেনে নেওয়া হবে।