অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কোনো নিয়োগপত্র না থাকার কারণে মালিকরা শ্রমিকদের ঠকানোর সুযোগ নিতে পারেনঃ মোস্তাফিজুর রহমান

Published in আলোকিত বাংলাদেশ on Monday 1 May 2017

৫ কোটি শ্রমিকের স্বার্থ দেখার কেউ নেই

উন্নতির সুফল পাচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিতরা

জাহিদুল ইসলাম

কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে কর্মস্থলের দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ প্রাণহানির জায়গা দখল করে আছে তৈরি পোশাক শিল্প। কয়েক বছরের চলমান সংস্কার কর্মসূচির ফলে এ খাতে কর্মপরিবেশের চিত্রই পাল্টে গেছে। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে কর্মক্ষেত্রের দুর্ঘটনায় ৯ জন শ্রমিক মারা গেছেন। প্রাণহানির বিবেচনায় পোশাক খাতের অবস্থান ১১তম। সংগঠনটির হিসেবে ২০১৬ সালে কর্মক্ষেত্রের দুর্ঘটনায় ৮৮৮ শ্রমিক মারা গেছেন। পোশাক খাতে কর্মপরিবেশের উন্নতি হলেও অবহেলিত রয়েছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করা ৫ কোটির বেশি শ্রমিক। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কর্মে নিয়োজিত মোট জনশক্তির ৮৪ দশমিক ৭ শতাংশ রয়েছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত আছেন ৫৮ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ৫ কোটি মানুষ কাজ করছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত মোট জনশক্তির ১৩ শতাংশের জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, বহুজাতিক দাতা সংস্থা ও শ্রমিক সংগঠনের বিভিন্ন উদ্যোগ থাকলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা বরাবরই রয়েছেন অবহেলিত। এ অবহেলার সুযোগ নিয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শিশুরাও নিয়োজিত হচ্ছে শ্রমিক হিসেবে। এরই ধারাবাহিকতায় সারা দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ লাখ ৫০ হাজারে।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকা- আর রানা প্লাজা ধসের মতো বড় দুই দুর্ঘটনার পর দেশি-বিদেশি উদ্যোগে পোশাক খাতে কর্মপরিবেশের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতর প্রতিষ্ঠার সুবাদে অন্যান্য শিল্পেও লেগেছে উন্নত পরিবেশের ছোঁয়া। পোশাক কারখানার দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার নেমে এসেছে। অন্যদিকে উল্টো পথে হাঁটছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। নিয়োজিত শ্রমশক্তির ৮৪ দশমিক ৭ শতাংশ রয়েছেন সব ধরনের নজরদারির বাইরে।

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি উদ্যোগে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক খাতে। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম নিরসন, শিশুশ্রম নির্মূল করা, নারী ও পুরুষ শ্রমিকের বেতনবৈষম্য দূর করা সহ সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগের সুফল কেবল প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরাই পেয়ে আসছেন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রম আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে কোনো কর্তৃপক্ষই নেই। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে লাইসেন্সের আওতায় এনে নজরদারি বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তারা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কোনো নিয়োগপত্র নেই; নেই নির্ধারিত বেতন। এ কারণে মালিকরা শ্রমিকদের ঠকানোর সুযোগ নিতে পারেন। তিনি বলেন, সর্বশেষ শ্রম আইন সব খাতের শ্রমিকদের জন্যই প্রযোজ্য। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে তা বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, মোট জনশক্তির শতকরা ৮০ ভাগের বেশি শ্রমিক এখন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এ খাতের শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের কৌশলগত পরিকল্পনা প্রয়োজন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে ক্রমান্বয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নিয়ে আসা প্রয়োজন বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।

শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বিলসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গেল বছর কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৮৮৮ শ্রমিক মারা গেছেন। ১ বছরে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ৬৯৯ জন পুরুষ, আর ২৮ জন রয়েছেন নারী। ২০১৫ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৩৬৩ শ্রমিক মারা গেছেন। ১ বছরে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ৩২৬ জন পুরুষ, আর ৩৭ জন নারী। নিহতদের মধ্যে ১৮৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে সহিংসতায়।

এর বাইরে ১ বছরে কর্মক্ষেত্রে ১ হাজার ৯৩ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৭০৩ জন। ৩৯০ জন আহত হয়েছেন সহিংসতায়। ১ বছরে বাংলাদেশে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতেই সবচেয়ে বেশি শ্রমিক নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বিলস। এর সংখ্যা ২৪৯। ২০১৫ সালে পরিবহন খাতের ১২৫ শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে নিহত হন। এর বাইরে নির্মাণ খাতে ৮৫ জন, মৎস্য আহরণে ৫২, কৃষিতে ৪৬, দিনমজুর ৩৮, প্রবাসে ২৮, ওয়ার্কশপের কাজে ১১ জন শ্রমিক মারা যান। নির্মাণ খাতে ২০১৫ সালে ৬১ শ্রমিক মারা গেছেন; দিনমজুর মারা গেছেন ২৭ জন।

কারখানায় কর্মপরিবেশের উন্নতি এখনও কাক্সিক্ষত মানে পৌঁছেনি বলে মনে করেন শ্রমিক নেত্রী মোশরেফা মিশু। আলোকিত বাংলাদেশকে তিনি বলেন, এখনও অনেক কারখানায় ন্যূনতম মজুরি কার্যকর করা হয়নি। ভূমিকম্পে অনেক ভবনেই ফাটল ধরেছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই কাজ করছেন শ্রমিকরা। নেই নিরাপদ পানির ব্যবস্থা। তিনি বলেন, শ্রমিকদের ঘাম পুঁজি করে মালিকপক্ষ ব্যবসা পরিচালনা করছে। শ্রমিকদের শোষণ করতে তারা হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে স্বৈারাচারী উৎপাদন ব্যবস্থা। ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারও নিশ্চিত করা হচ্ছে না। সরকার ও মালিকপক্ষের বাইরে কেউ ট্রেড ইউনিয়নও করতে পারছেন না। মালিকপক্ষের বাইরে কেউ ট্রেড ইউনিয়ন করতে চাইলে ছাঁটাই করা হচ্ছে। মহান মে দিবসকে সামনে রেখে এ পরিস্থিতির অবসান চান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবহন খাতে শ্রমিকদের দৈনিক আয় ১০০ টাকার ঘরে। বাধ্য হয়েই এ খাতে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। দুই বেলা দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার জন্যই তারা এ পথ বেছে নিয়েছেন। সারা দেশে এমন ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু এখনও শ্রমিক।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রম জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মোট শিশুর সংখ্যা ৩ কোটি ৯৬ লাখ। এর মধ্যে সাড়ে ৩৪ লাখ শিশুশ্রমিক। এক দশক আগের জরিপে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩২ লাখ, যাদের বয়স ৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। সবচেয়ে বেশি প্রায় ১৪ লাখ শিশুশ্রমিক ঢাকা বিভাগে। এর পরেই চট্টগ্রামের অবস্থান। পাঁচটি খাতে মূলত এসব শিশু কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে পরিবহন এবং গুদামজাতকরণ, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, যানবাহন মেরামত, নির্মাণ খাত এবং খনিজ খাত। এছাড়া কৃষি, বন ও মৎস্য খাতেও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে শিশুরা। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কাজ করছে খনিজ খাতে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রমিকদের এক-তৃতীয়াংশ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। ঝুঁকি নিয়ে জীবিকার কারণে কাজে নিয়োজিত প্রায় ১২ লাখ শিশু কয়েকটি কারণে কর্মস্থল ঝুঁকি বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিবিএসের প্রতিবেদনে। আটটি কারণ বেরিয়ে এসেছে সংস্থাটির জরিপে। স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ যন্ত্রপাতি, আগুন-গ্যাস, ধুলাবালি এবং ঝাঁকুনিপূর্ণ স্থান, অত্যধিক গরম এবং উত্তপ্ত, ভূগর্ভস্থ অথবা অতি উচ্চতায়, পানি, অন্ধকার বা আবদ্ধ স্থান, রাসায়নিক ও বিস্ফোরক নিয়ে কাজ করার কারণে ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।