পরিবেশবান্ধব কারখানা বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে সম্ভাবনা তৈরি করবে নি:সন্দেহেঃ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Published in দৈনিক ইত্তেফাক on Sunday 7 May 2017

পরিবেশবান্ধব কারখানায় নীরব বিপ্লব

৬৭ কারখানা গ্রীন হিসেবে সনদ পেয়েছে, পাইপলাইনে রয়েছে আরো ২২৭টি

রিয়াদ হোসেন

বিশ্বব্যপী বাংলাদেশের গার্মেন্টস নিয়ে সরব আলোচনার মধ্যে অনেকটা নীরবেই বিশালসংখ্যক পরিবেশববান্ধব ও কর্মপরিবেশসম্পন্ন (কমপ্লায়েন্ট) কারখানা স্থাপন হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কারখানা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও লাভ করেছে। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র হিসাবে, এ পর্যন্ত ৬৭টি গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল কারখানা ‘গ্রীন ফ্যাক্টরি’ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) স্বীকৃতি পেয়েছে। আরো ২২৭টি কারখানা পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে উঠছে। বলা চলে, পরিবেশবান্ধব কারখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক ধরনের নীরব বিপ্লব চলছে। তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের দাবি, ইউএসজিবিসি’র তালিকা অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব স্থাপনা এখন বাংলাদেশে! শুধু তাই নয়, পরিবেশবান্ধব কারখানার মান বিচারে বিশ্বের শীর্ষস্থানে থাকা তিনটি কারখানাও বাংলাদেশে। এর মধ্যে দুটি নারায়নগঞ্জে আর একটি পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডে (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা)। আর ইউএসজিবিসির’ তালিকা অনুযায়ী বিশ্বের শীর্ষ দশে থাকা পরিবেশবান্ধব কারখানার সাতটিই বাংলাদেশের।
তাজরীন ও রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের তৈরি পোশাক নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা শুরু হয়। গার্মেন্টসের দরাদরিতে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের শক্তি কিছুটা খর্ব হয়। তবে গত চার বছরে পরিবেশবান্ধব কারখানার আলোচ্য পরিসংখ্যান আন্তর্জাতিক অঙ্গণে এ খাতের ভাবমূর্তি বাড়াতে ভুমিকা রাখছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবেশবান্ধব স্থাপনার তালিকায় থাকা ইউএসজিবিসি’র লিডারশিপ ইন এনার্জি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন (এলইইড বা লিড) সনদ পেয়েছে শীর্ষ কারখানা নারায়ণগঞ্জের রেমি হোল্ডিংস। ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা বিটপি গ্রুপের এ কারখানাটি নিট পোশাক তৈরি করে থাকে। এ গ্রুপের আরেকটি পরিবেশবান্ধব কারখানা মানিকগঞ্জে তারাসিমা অ্যাপারেলস। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরান আলী ইত্তেফাককে বলেন, দিন দিনই প্রতিযোগিতা বাড়ছে। মূলত প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এ কারখানা স্থাপন করেছি। তিনি বলেন, রেমি হোল্ডিংস কারখানাটি পরিবেশবান্ধব হিসেবে সব ধরনের শর্ত পরিপালনের ক্ষেত্রে ১১০ নম্বরের মধ্যে ৯৭ পেয়ে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। ভালো অর্ডার পাচ্ছি। ক্রেতাদের কাছে বার্তা গেলে আরো বাড়বে। তিনি দাবি করলেন, বাংলাদেশে এখন ইউএসজিবিসি’র সনদপ্রাপ্ত কারখানার সংখ্যা সর্বোচ্চ।
চারটি ক্যাটাগরিতে পরিবেশবান্ধব হিসেবে সনদ দিয়ে থাকে ইউএসজিবিসি। পরিবেশবান্ধব স্থাপনার শর্ত পরিপালন বিবেচনায় প্লাটিনাম, গোল্ড, সিলভার হিসেবে সনদ দেওয়া হয়। এর বাইরে কেবল পরিবেশবান্ধব হিসেবেও সনদ দেওয়া হয়। সব ধরনের শর্ত পরিপালন করা হলে সেটি প্লাটিনাম হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশে এরকম কারখানার সংখ্যা ১৩টি। এর পেছনে থাকা কারখানা গোল্ড ও তার পেছনে থাকা কারখানা সিলভার হিসেবে সনদ পায়। দেশে গোল্ড ও প্লাটিনাম সনদ পাওয়া কারখানা যথাক্রমে ২০ ও ২৭টি। আর সাধারনভাবে পরিবেশবান্ধব হিসেবে সনদ পাওয়া কারখানা ৭টি।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, পাইপলাইনে থাকা কারখানাগুলো আগামী দুই বছরের মধ্যে এ সনদ পাবে বলে আশা করছি। এটি সম্ভব হলে একটি ইতিবাচক ইমেজ গড়ে উঠবে। এসব কারখানাই আগামীতে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করবে।
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পরিবেশবান্ধব কারখানায় পোশাক তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু বিশ্বব্যাপী পরিবেশবান্ধব ধারণাটি এখন বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায়ও (এসডিজি) এ বিষয়ে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ক্রয় আদেশ পাওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ মানের কারখানার চাইতে বাড়তি সুবিধা পায় পরিবেশবান্ধব কারখানা।
রেমি হোল্ডিংস ছাড়াও বিশ্বের সেরা দশটির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে নারায়ণগঞ্জের প্লামি ফ্যাশন্স। এর পরেই রয়েছে পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডের ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও। কারখানাটি ইউএসজিবিসি’র সনদ পাওয়া প্রথম বাংলাদেশী কারখানা। এছাড়া সেরা দশের তালিকায় তিনটি কারখানাই এসকিউ গ্রুপের। এগুলো হলো এসকিউ সেলসিয়াস-২, এসকিউ বিরিকিনা-১ ও এসকিউ বিরিকিনা-২। এছাড়া জেনেসিস ওয়াশিং নামে একটি কারখানাও রয়েছে এ তালিকায়।
প্লামি ফ্যাশন্সের প্রধান ফজলুল হক তার গ্রীন কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেন, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ঠিক পর পরই সিদ্ধান্ত নিলাম ইমেজ পুনরুদ্ধারে কিছু করতে হবে। রানা প্লাজাই যে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে না, সেটি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে হবে। এর পরই এ কারখানাটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিই।
তবে শুধু মুনাফার চিন্তা করলে এ ধরনের কারখানা তৈরি করা যাবে না। এ ধরনের কারখানা প্রতিষ্ঠায় বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করতে হয়। মান বজায় রাখতে নিয়মিত একটি খরচও আছে। অন্যদিকে এ ধরনের কারখানার জন্য ক্রেতা নিজে থেকেই উদ্যোগী হয়ে বাড়তি দরও দেবে না। তবে দরাদরির ক্ষেত্রে এসব কারখানা এগিয়ে যায়।
ইউএসজিবিসি শর্ত অনুযায়ী পরিবেশবান্ধব কারখানা হওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের শর্ত পরিপালন করতে হয়। আগে এ জন্য নয়টি বিষয় পরিপালন করার শর্ত থাকলেও সম্প্রতি আরো কিছু শর্ত যুক্ত হয়েছে। কারখানা নির্মাণে কী ধরনের নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার বিবেচনা করার পাশাপাশি সূর্যের আলোর কী পরিমাণ ব্যবহার হয় কিংবা সৌর বিদ্যুতের ব্যবহারও বিবেচনায় নেয়া হয়। এমন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, কারখানার নির্দিষ্ট দুরত্বের মধ্যে শ্রমিকদের বাসস্থান, স্কুল, বাজার করার ব্যবস্থা বা বাসস্ট্যান্ড থাকা, সূর্যের আলো ব্যবহার করার পাশাপাশি সৌরবিদ্যুত ব্যবহার এবং বিদ্যুত্ সাশ্রয়ী বাতি ব্যবহার করতে হয়। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করা, নির্দিষ্ট পরিমাণ খোলা জায়গা রাখা, অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা, বৈদ্যুতিক ফিটিংস স্থাপন ছাড়াও অগ্নি দুর্ঘটনা এড়াতে ব্যবহার করতে হয় সর্বাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি। অবশ্য পৃথিবীর সব দেশের স্থাপনাই যে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার ক্ষেত্রে ইউএসজিবিসি’র সনদ নেয়, তা নয়। অনেক দেশেই এক্ষেত্রে নিজস্ব পরিবেশবান্ধব নীতিমালার আলোকে স্থাপনা তৈরি করে। এ ধরনের কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। তুলনামূলক মাঝারি ও ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য এ অঙ্কের বিনিয়োগ করা কার্যত অসম্ভব। ফলে ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও এ ধরনের বিনিয়োগে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ জন্য সহজ শর্তে ঋণ ব্যাংকঋণের বিষয়টি বহুল আলোচিত। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রীন ফাইন্যান্সিংয়ের আওতায় সহজ শর্তে (সিঙ্গেল ডিজিট সুদে) ঋণের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এটিও সবার জন্য সুবিধাজনক নয়। প্লামি ফ্যাশন স্থাপনে ঋণ নিয়েছিলেন ফজলুল হক। তিনি বলেন, আট শতাংশ ঋণ এক সময় সুবিধাজনক থাকলেও বর্তমানে বাস্তবতায় তা নয়। এ বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার।
একই সঙ্গে ক্রেতাদের মনোভাবেরও পরিবর্তন দরকার বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
সিপিডি’র (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ইত্তেফাককে বলেন, এ ধরনের কারখানা বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে সম্ভাবনা তৈরি করবে নি:সন্দেহে। তবে এ কারণে এখনই যে বেশ ভালো ক্রয়াদেশ আসবে কিংবা নামকরা ব্র্যান্ড বাংলাদেশে লাইন ধরবে – তা নাও হতে পারে। পরিবেশবান্ধব কারখানার সঙ্গে কারখানা সংস্কারের চলমান গতি অব্যাহত রাখা এবং অবকাঠামোগত অন্যান্য সুবিধাও তৈরি করতে হবে। ফলে ধীরে ধীরে এর সুবিধা পাওয়া যাবে। তবে চ্যালেঞ্জের বিষয় হলো এ ধরনের কারখানা স্থাপনে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ এবং পরিবেশবান্ধব শর্ত পরিপালন করতে একটি বড় অঙ্কের খরচ চলমান রাখতে হয়। এক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত দর না পাওয়ার উপর নির্ভর করবে এটি টেকসই করা যাবে কিনা।