প্রজন্মের পাথেয় – ড. ফাহমিদা খাতুন

Published in বণিক বার্তা on Thursday, 16 March 2017

বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াকালে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের বৈদেশিক সাহায্য, দারিদ্র্য এবং সরকারি শিল্পোদ্যোগ-বিষয়ক লেখাগুলো পড়েছি। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষকদের মাধ্যমেই তাঁর কাজগুলোর সঙ্গে পরিচিত হই। তিনি যে একজন রাজনীতিসচেতন ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার অর্থনীতিবিদ, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি ছয় দফা আন্দোলন কর্মসূচি তৈরিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, সেটাও তখন জেনেছি।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে আমি বিআইডিএসে যোগ দিই। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল রাজনীতিতে জড়িত থাকার কারণে আমার যখন শিক্ষক হওয়া হলো না, তখন আমার অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক প্রয়াত অধ্যাপক আখলাকুর রহমান আমাকে বিআইডিএসে যেতে বলেন। সেখানে লিখিত পরীক্ষার পর সাক্ষাত্কার পরীক্ষা দেয়ার সময় অধ্যাপক রেহমান সোবহান ছিলেন সাক্ষাত্কার বোর্ডে। তখনই তাঁর সঙ্গে প্রথম আমার মুখোমুখি দেখা। ছাত্রজীবন থেকে পত্রপত্রিকায় আমার লেখালেখির অভ্যাস ছিল। সেগুলো দেখে ইন্টারভিউ বোর্ডে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কীভাবে এ অভ্যাসটি আমি অর্জন করেছি। বুঝতে পারছিলাম তিনি আমার এদিকটি পছন্দ করেছিলেন।  তারপর থেকে সবার মতো আমারও ‘স্যার’ হয়ে গেলেন তিনি।

স্যারের প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ, সামাজিক ন্যায়বিচার, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, সুশাসন ইত্যাদি বিষয়ে অনেকেই লিখবেন। আমি সেদিকগুলোয় না যেয়ে তাঁর ব্যক্তিত্বের অন্যদিকগুলো তুলে ধরতে চাই, যেগুলো কাছ থেকে দেখেছি।

বিআইডিএসে ১৯৮৯ সালে যোগদান করার পর আমি রেহমান সোবহান স্যারের সরাসরি সান্নিধ্য লাভ করি। তবে তাঁর সঙ্গে মুখোমুখী হলেই প্রথম প্রথম দারুণ নার্ভাস লাগত। দেখা হলেই তিনি বলতেন, ‘হুয়াট আর ইউ ডুয়িং?’ তখন কী নিয়ে গবেষণা করছি, বলতে গিয়ে ভাবনার খেই হারিয়ে ফেলতাম। এত বিশাল মাপের ব্যক্তিত্বের সামনে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা একজন নতুন গবেষকের পক্ষে গুছিয়ে কিছু বলতে গিয়ে প্রায়ই হোঁচট খেতে হতো। তবে তাঁর এ প্রশ্নই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে এবং তা নিয়ে কাজ করতে সাহায্য করেছে, চিন্তাগুলোকে কীভাবে যুক্তিসঙ্গতভাবে গুছিয়ে উপস্থাপন করা যায়, সেটি শিখতে সহায়তা করেছে। তাঁর মুখোমুখী হলেই যেন পরিষ্কারভাবে আমার গবেষণার বিষয়টি বলতে পারি, সে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতাম, গুছিয়ে রাখতাম নিজের চিন্তাগুলো। স্যারের কারণে তৈরি হওয়া এ অভ্যাসটি আমার সারা জীবন কাজে লেগেছে। ভালো গবেষক হওয়ার বীজটি অন্য অনেকের মতো আমার মধ্যে তিনিই প্রোথিত করেছেন।

সে সময় বিআইডিএসে অনেক প্রতিভাবান গবেষক স্যারের এই ‘কী করছ?’ প্রশ্নের উত্তর অনেক সুন্দর করে বলতে পারতেন। কিন্তু সেগুলো লেখার ব্যাপারে তারা একটু অলস বা অনাগ্রহী ছিলেন। স্যার তো আর গতানুগতিক কাজের হিসাব চাওয়ার মানুষ নন। তিনি বলতেন, ‘ওকে, ওহাই ডোন্ট ইউ রাইট দেম ডাউন’। এ চাপে পড়ে তারা লিখতে বসে যেতেন।

আমি লন্ডনে পিএইচডি শেষ করে বিআইডিএসে ফেরত আসি ১৯৯৬ সালে। আমি বিদেশে যাওয়ার আগেই তিনি বিআইডিএস থেকে অবসর নিয়েছিলেন। কিন্তু তখনো পেশাগত কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন জায়গায় দেখা হলে জিজ্ঞেস করতেন— আমি কী নিয়ে ব্যস্ত আছি, কী বিষয়ে কাজ করছি। বিআইডিএসে থাকাকালে সিপিডির জন্য দু-একটা কাজ করেছি। তারপর ২০০২ সালের শেষের দিকে সিপিডিতে স্থায়ীভাবে যুক্ত হলাম। আবারো স্যারের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ পেলাম। সিপিডিতে আরো ঘনিষ্ঠভাবে তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।

অর্থনীতিতে পড়াশোনা, শিক্ষকতা এবং গবেষণা করলেও রাজনীতি স্যারের প্রিয় বিষয়। তিনি বিশ্বাস করেন, রাজনৈতিকভাবেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হবে। বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে তাই সেতুবন্ধ স্থাপন করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। সিপিডি প্রতিষ্ঠার পেছনে স্যারের উদ্দেশ্য ছিল গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে নীতিনির্ধারণে কাজে লাগানো। আমরা গবেষণা করি, অনেকেই সেগুলো বিশ্বের নামিদামি জার্নালে প্রকাশ করি। তার পরই শেষ। কিন্তু অধ্যাপক রেহমান সোবহান চান, এ গবেষণা যেন প্রায়োগিক কাজে ব্যবহার করা যায়। আর এ গবেষণার ফল নিয়ে সমাজের সব গোষ্ঠী বির্তক করুক। গবেষক, নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, অধিকার রক্ষাকারী সংগঠনের সদস্য, মাঠপর্যায়ের কর্মী, মিডিয়া— সবাই এক টেবিলে মুখোমুখি বসে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনা করবে। তারপর সেখান থেকে যে সুপারিশমালা বেরিয়ে আসবে, তা মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে। যদিও বিষয়টি এত সরল নয়। কেননা প্রতিটি রাজনৈতিক সরকার তার নিজস্ব ম্যান্ডেট দ্বারাই পরিচালিত হয়, কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্যটি মহত্। সর্বোপরি আজ বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ যে এত বিষয় নিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য ডায়ালগ করছে এবং তাদের কণ্ঠস্বর যে এত প্রসারিত হচ্ছে, সেখানে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের একক অবদান রয়েছে। ছোট হলেও নাগরিক সমাজের জন্য যে জায়গাটি তৈরি হয়েছে, সেখানেও স্যারের অবদান অনস্বীকার্য। সরকার নীতিমালা তৈরি করবে, সরকারি কর্মকর্তারা তা বাস্তবায়ন করবেন; সেখানে অন্যদের ভূমিকা হবে দর্শকের এবং গ্রহীতার। এটিই ছিল একসময়ের স্বাভাবিক নিয়ম। এখন আমরা দেখি, সরকারের নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় একটা জায়গা তৈরি হয়েছে, যেখানে নাগরিক সমাজ ও পেশাজীবীদের জন্য কিছুটা অংশগ্রহণ ও মতামত প্রদানের সুযোগ রাখার চেষ্টা হচ্ছে। পঞ্চবার্ষিক পকিল্পনা প্রণয়ন, বাজেট প্রণয়ন কিংবা কোনো খাতওয়ারি নীতিমালা তৈরির সময় সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়ে থাকে তাদের বক্তব্য শোনার জন্য।

বিশ্লেষকমনের পাশাপাশি রেহমান সোবহান স্যারের রয়েছে একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল মন। এত বড় মাপের ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ছোটখাটো বিষয়গুলোও তাঁর নজর এড়িয়ে যায় না। সিপিডির চেয়ারম্যান হিসেবে অফিসের দৈনন্দিন কাজে তিনি নাক গলান না। সবার সঙ্গে প্রতিদিন কথাবার্তাও হয় না তাঁর। কিন্তু সিপিডির প্রতিটি অনুষ্ঠানে তিনি আগ্রহ নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। সেটি শুধু জ্ঞানগর্ভ সেমিনার বা ডায়ালগ নয়। সিপিডির বইমেলা, কর্মীদের জন্মদিন, বিয়ে, নারী দিবস, অবকাশ— এ রকম সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি প্রচণ্ড আগ্রহসহকারে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যারা কাজ করেন, তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক খুঁটিনাটি সব বিষয়ে তিনি খেয়াল রাখেন। আমি নিজে কীভাবে সংসার ও চাকরি করি, সে ব্যাপারেও তিনি খোঁজখবর রাখেন সর্বদা।

নেতৃত্ব সৃষ্টি এবং নতুনদের জন্য সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি অনন্য। শুধু বাংলাদেশ নয়, বহু দেশেই নিজের সৃষ্টি করা প্রতিষ্ঠান অন্যকে পরিচালনা করতে দেয়ার উদাহরণ বিরল। এটির জন্য অনেক বড় হূদয় প্রয়োজন, যেটি স্যারের রয়েছে। এখন আমি যে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক হলাম, এক্ষেত্রেও স্যারের অবদান সর্বোচ্চ। কারণ সিপিডির ভেতরে নেতৃত্ব বদল হওয়ার সংস্কৃতি তিনিই তৈরি করেছেন। তিনি সিপিডি সৃষ্টি করেছেন বটে, কিন্তু সবসময় তা পরিচালনার দায়িত্ব আঁকড়ে বসে থাকেননি। তিনি অন্যদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন। সে ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। আমাকে দায়িত্ব নিতে বলার সময় তিনি বলেছেন, ‘তুমি নিজের যোগ্যতায় এ দায়িত্ব নিতে যাচ্ছ। তোমাকে দেখে অন্য নারীরাও উত্সাহিত হবে, তারাও এগিয়ে আসবে’। যিনি আমাকে বিআইডিএসে নিয়োগ দিয়েছিলেন, তিনিই তাঁর নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান আমাকে পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন, এটি আমার জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। তাঁর সান্নিধ্যে থাকার প্রতিটি মুহূর্তই শিক্ষণীয়। প্রতিষ্ঠানের ছোটখাটো বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করলেও কোন বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের গবেষণা ও আলোচনা করা উচিত, গবেষণার কোন ইস্যুগুলো তুলে ধরতে হবে, সেসব ব্যাপারে তিনি আমাদের নিয়মিত পরামর্শ দেন।

কঠিন অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি গান, সিনেমা, খেলাধুলা সবকিছুতেই তাঁর আগ্রহ প্রবল। সিপিডির বার্ষিক অনুষ্ঠানে ক্রিকেট ম্যাচের অন্যতম সক্রিয় সদস্য অধ্যাপক সোবহানের বেটিং আমরা দারুণ উপভোগ করি। একজন অর্থনীতিবিদ পরিচয়ের বাইরে তিনি একজন ভালো ভ্রমণসঙ্গীও বটে! তাঁর সঙ্গে যখন বিভিন্ন সেমিনারে বিদেশে যাই, তিনি শুধু সেসব দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি, খেলাধুলা সম্পর্কেই জানেন না, সেখানকার নামকরা রেস্টুরেন্টের সুস্বাদু খাবারগুলো সম্পর্কেও বিশেষজ্ঞ। তাই খাবার নির্বাচকের দায়িত্বটা আমরা তাঁকেই দিয়ে থাকি। সেটা হোক না নিউইয়র্ক, অসলো, দিল্লি, কাঠমান্ডু বা কলম্বো।

বাংলা ভাষায় তাঁর দখল না থাকলেও চেষ্টা করেন বাংলায় আলোচনা করতে। সেটি করতে গিয়ে অবশ্য তাঁর অনন্য শব্দচয়ন এবং উচ্চারণ আমাদের রসের খোরাক জোগায়। যেমন তিনি একবার একজন নামকরা অর্থনীতিবিদের কাজ এবং জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘উনি তো পৃথিবীতে চলে গেছেন’, অর্থাত্ তিনি বলতে চেয়েছেন যে, ওই অর্থনীতিবিদের নামডাক সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে।

মেধা, পাণ্ডিত্য ও মননশীলতার এক বিরল সম্মিলন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তাঁর মূল্যবোধ ও আদর্শ ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে। তিনি আমার কাজের অনুপ্রেরণা এবং দিকনির্দেশক। তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবন কামনা করি।

 

লেখক: নির্বাহী পরিচালক

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)