বিদ্যুতের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যয় বাড়বে: মোস্তাফিজুর রহমান

Published in প্রথম আলো on Friday, 24 November 2017

মধ্যবিত্তের খরচ বাড়ছে

দাম কমানোর পক্ষে যেসব যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছিল, তা কোনো কাজে লাগেনি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আদেশ ঘোষণা করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে কারওয়ান বাজারে টিসিবি ভবনের কার্যালয়ের শুনানিকক্ষে এই আদেশ ঘোষণা করা হয়।

ঘোষিত আদেশ অনুযায়ী সারা দেশে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রতি ইউনিটে গড়ে ৩৫ পয়সা। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে এই বাড়তি দাম কার্যকর হবে। অর্থাৎ গ্রাহক ডিসেম্বর মাসে যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন এবং জানুয়ারি মাসে যে বিল দেবেন, সেই বিল দিতে হবে বর্ধিত দামে।

এবারের মূল্যবৃদ্ধির আর্থিক চাপ বহন করতে হবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত গ্রাহকদের। যে গ্রাহক যত বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, তাঁদের বিলও তত বেশি হবে। বিইআরসির আদেশ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মাসে ১০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গ্রাহকের বিল বাড়বে ২২ টাকা। ১৫০ ইউনিট ব্যবহারকারীর বাড়বে ৪৮ টাকা। ২৫০ ইউনিট ব্যবহারকারীর বাড়বে ৯০ টাকা। ৩৫০ ও ৪৫০ ইউনিট ব্যবহারকারীর বাড়বে যথাক্রমে ১৩৭ ও ১৯৬ টাকা। মাসে ১ হাজার ইউনিট ব্যবহারকারীর বিল বাড়বে ৬০৪ টাকা। ফলে গ্রাহকদের বড় অংশেরই জীবনযাত্রার ব্যয় আরও খানিকটা বাড়বে।

আর্থসামাজিক খাতে বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুতের দাম ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকায় ভোক্তা এবং উৎপাদক সবাই কম দামের যে সুবিধা পাচ্ছিলেন, তা হারাবেন। উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যয় বাড়বে। অভ্যন্তরীণ বাজারের উৎপাদকের পাশাপাশি রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতায় সক্ষমতার ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। আর উৎপাদনের ব্যয় বাড়লে তা–ও শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপরই বর্তাবে।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আদেশ ঘোষণা করে বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেন, দাম বাড়ানোর পাশাপাশি ন্যূনতম বিল প্রত্যাহারসহ এবার অন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাতে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত গ্রাহকের ওপর আর্থিক চাপ কমবে। প্রায় ৩০ লাখ দরিদ্র গ্রাহকের (লাইফ লাইন গ্রাহক, যাঁদের বিদ্যুৎ ব্যবহারের সর্বোচ্চ সীমা ৫০ ইউনিট) বিল কমবে। প্রায় ৬০ লাখ লাইফ লাইন গ্রাহকের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের মূল্যহার অপরিবর্তিত থাকবে। মধ্যবিত্ত গ্রাহকের বিলও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে না।

মনোয়ার ইসলাম বলেন, দেশে লাইফ লাইন গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। এর মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ গ্রাহক মাসে বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন ১৫-২০ ইউনিট। তাঁদের মাসিক বিল হওয়ার কথা ৬০-৭০ টাকা। কিন্তু মাসিক ন্যূনতম বিলের (পিডিবির এলাকায় ১০০ টাকা, পল্লী বিদ্যুতের এলাকায় ৯০ টাকা) বিধান থাকায় তাঁদের ৩০-৪০ টাকা বিল বেশি দিতে হতো। এবার ন্যূনতম বিলের বিধান তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে তাঁদের ওই বাড়তি টাকা আর দিতে হবে না। এ ছাড়া ৬০ লাখ লাইফ লাইন গ্রাহকের বিলের পরিমাণ বাড়বে না। বাকি ৮ লাখের মতো লাইফ লাইন গ্রাহকের বিল কিছুটা বাড়বে।

গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানো হলেও এবার পাইকারি পর্যায়ে (পিডিবির কাছ থেকে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কেনা) বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। বরং তা প্রতি ইউনিটে ৬ পয়সা করে কমেছে বলেও বিইআরসির চেয়ারম্যান উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিদ্যুতের উৎপাদনমূল্যের সঙ্গে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রয়মূল্যের ব্যবধান ঘোচানোর জন্য সরকার ভর্তুকি বা অনুদান দেবে। তাই তা বাড়ানোর দরকার হচ্ছে না। গ্রামীণ জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে (আরইবি) কম দামে পাইকারি বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে বিইআরসির সদস্য (বিদ্যুৎ) মো. মিজানুর রহমান বলেন, সরকারের এই ভর্তুকি (বছরে প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা) বা অনুদান দেওয়ার বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন। তবে বিদ্যুতের দাম কমানোর জন্য ডিজেল ও ফার্নেস তেলের দাম কমানোসহ অন্যান্য বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত হতে পারেননি। তাই গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়াতে হয়েছে। এই দাম বাড়ানোর ফলে বিতরণ কোম্পানিগুলো বছরে প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বাড়তি বিল পাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণে কর্মরত কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এর মানে হচ্ছে বিশ্ববাজারে অব্যাহতভাবে কয়েক বছর ধরে কম থাকলেও সরকার দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমাবে না। শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত তেলের দাম কমানো হলেই বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা কমানো সম্ভব। কিন্তু তারা এসব বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে দাম বাড়ানোর প্রতিই বেশি মনোযোগী, যা দুঃখজনক।

আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদের মধ্যে ২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাত বছরে খুচরা গ্রাহক বা ভোক্তা পর্যায়ে আটবার এবং পাইকারি পর্যায়ে ছয়বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।

বিইআরসির আদেশে বলা হয়, কৃষিতে সেচ গ্রাহকেরা এখন থেকে সেচ মৌসুম শেষে তাঁদের বিদ্যুৎ–সংযোগ পরবর্তী মৌসুম পর্যন্ত স্থগিত রাখতে পারবেন। ফলে সেচের কয়েক মাসের পর সারা বছর আর তাঁদের বিল হবে না। নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা জামানত কমানো হয়েছে। প্রিপেইড মিটারের গ্রাহকের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা জামানত দিতেই হবে না। এ ছাড়া বিতরণ কোম্পানিগুলো নিজ নিজ এলাকায় বিভিন্ন হারে ডিমান্ড চার্জ, সার্ভিস চার্জ আদায় করত। এবার তা সব বিতরণ কোম্পানির জন্য সমান করা হয়েছে।

এবারের মূল্যবৃদ্ধির আদেশে বিদ্যুতের চারটি নতুন গ্রাহক শ্রেণি নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে সাধারণ নির্মাণ, ব্যাটারি চার্জিং, মধ্যম ক্ষমতার লাইন থেকে সরবরাহ নিয়ে আবাসিক ও বাণিজ্যিক নির্মাণ এবং উচ্চ ক্ষমতার লাইন থেকে সরবরাহ নিয়ে আবাসিক ও বাণিজ্যিক নির্মাণকাজ।

দাম বাড়ানোর আদেশ দেওয়ার জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিইআরসির সদস্য রহমান মুরশেদ, মাহমুদউল হক ভূঁইয়া, মো. আবদুল আজিজ খান, সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এবং দু-একটি বিতরণ কোম্পানির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল কত বাড়ছে
 গ্রাহক শ্রেণি ব্যবহার বর্তমান নতুন বাড়ছে কত
৭৫ইউনিট ৩১০ ৩২৫ ‍+১৫
১০০ ইউ. ৪৩৯ ৪৬১ ‍+২২‍
১৫০ ইউ. ৭১১ ৭৫৯ ‍+৪৮
২৫০ ইউ. ১২৫১ ১৩৪১ ‍+৯০
৩৫০ ইউ. ১৮১৫ ১৯৫২ ‍+১৩৭
৪৫০ ইউ. ২৫৪৭ ২৭৪৩ ‍+১৯৬
১০০০ ইউ. ৭৯৩৯ ৮৫৪৩ ‍+৬০৪