বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ছাড় করাতে সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে: ড. মোয়াজ্জেম

Published in আমাদের সময় on Tuesday, 30 January 2018

আটকা সোয়া ৩ লাখ কোটি টাকা

গোলাম রাব্বানী

বাংলাদেশের উন্নয়ন-সহযোগীদের শর্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় ও সরকারের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় দেশের উন্নয়নে দাতাদের প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় হচ্ছে না। ফলে পাইপলাইনে বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে যাচ্ছে। ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক সহায়তার অর্থ আটকে রয়েছে, যা উন্নয়ন-সহযোগীদের প্রতিশ্রুত অর্থের প্রায় ৫৪ শতাংশ। ফলে দেশের প্রত্যাশিত উন্নয়ন কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সূত্র জানায়, আলোচ্য সময়ে উন্নয়ন-সহযোগীরা বাংলাদেশের উন্নয়নে ৭ হাজার ৩৫ কোটি ডলার বা ৫ লাখ ৬২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বৈদেশিক সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। এর বিপরীতে ছাড় হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ২৭৫ কোটি ডলার বা ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। মোট প্রতিশ্রুতির ৪৬ শতাংশ ছাড় হয়েছে।

উন্নয়ন-সহযোগীরা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে এসব অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর বিপরীতে সরকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা রক্ষা, সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের ব্যাপারে নানাবিধ শর্ত রয়েছে। অর্থ ছাড় না হওয়ার অন্যতম একটি কারণ দাতাদের শর্ত বাস্তবায়ন না করা। এ ছাড়াও প্রকল্পের কাজে ধীরগতি, জরিপ ঠিকমতো না করা, দাতাদের কাছে প্রকল্পের ব্যাপারে সব তথ্য না দেওয়া, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই পাইপলাইনে আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ বাড়ছে।

এদিকে ২০১৫ সালে সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) বৈঠকে দাতারা বলেন, নতুন সহায়তার ব্যাপারে দাতাদের তাগাদা না দিয়ে পাইপলাইনে আটকে থাকা সহায়তার অর্থ দ্রুত ছাড়ের ব্যবস্থা নিতে বলেছে। ওই সহায়তা পেলে সরকার উন্নয়ন কর্মকা- আরও বেশি এগিয়ে নিতে পারবে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পাইপলাইনে বৈদেশিক সহায়তার অর্থ আটকে থাকাটা সরকারের প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক তৎপরতার অভাবে হয়েছে। প্রকল্পের কাজ সঠিক সময়ে না করা এবং দাতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব ঠিকমতো না দেওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে। এসব অর্থ ছাড় করাতে সরকারকেই বেশি উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে।

তিনি বলেন, জাতিসংঘের এমডিজি ও এসডিজি বাস্তবায়নে উন্নত দেশগুলো সাহায্য ও ঋণের অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু সে তুলনায় আমরা তা আনতে পারিনি। তাই অঙ্গীকার পাওয়ার চেয়ে কতটুকু আদায় করা যাবে, সে অনুসারে বৈদেশিক সহায়তা পাওয়ার দিকে নজর রাখতে হবে।

সূত্র জানায়, ২০০০-০১ থেকে ২০০৫-০৬ পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে উন্নয়ন-সহযোগীরা বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে ১ হাজার ৩৭ কোটি ৩৩ লাখ ডলার সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করে। এর বিপরীতে ওই সময় তারা ছাড় করেছে ৭৯৮ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। পাইপলাইনে আটকে রয়েছে ২৩৮ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। ওই সময় মোট অঙ্গীকারের ৭৬.৯৬ শতাংশ ছাড় হয়েছে। বাকি ১৩.০৪ শতাংশ পাইপলাইনে আটকে রয়েছে।

২০০০-০১ অর্থবছরে বৈদেশিক সাহায্যের অঙ্গীকার ছিল ২০৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ছাড় হয়েছে ৮৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার। পাইপলাইনে আটকা পড়েছে ৬৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার। তবে ২০০১-০২ অর্থবছরে অঙ্গীকার ছিল ৮৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার, ছাড় হয়েছে ১৪৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। পাইপলাইন থেকে তখন বেশি ছাড় হয়েছিল ৫৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২০০২-০৩ অর্থবছরে ২১৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার, ছাড় হয় ১৫৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার, পাইপলাইনে আটকে আছে ৫৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে অঙ্গীকার ছিল ১৯২ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ছাড় হয় ১০৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার, পাইপলাইনে আটকে আছে ৮৯ কোটি ডলার। ২০০৪-০৫ অর্থবছরে অঙ্গীকার ছিল ১৫৫ কোটি ২০ লাখ ডলার, ছাড় হয়েছে ১৪৯ কোটি ১০ লাখ ডলার, পাইপলাইনে আটকে আছে ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে অঙ্গীকার ছিল ১৭৮ কোটি ৭৩ লাখ ডলার, ছাড় হয়েছে ১৫৬ কোটি ৭৬ লাখ ডলার, পাইপলাইনে আটকে আছে ২১ কোটি ৯৭ লাখ ডলার।

২০০৬-০৭ থেকে ২০০৭-০৮ এই দুই অর্থবছরে দাতারা ৫০৯ কোটি ৮৫ লাখ ডলার দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল। এর বিপরীতে ২৬৯ কোটি ২০ লাখ ডলার ছাড় করেছে। পাইপলাইনে রয়েছে ১৪০ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। ওই সময় মোট অঙ্গীকারের ৫২.৭৯ শতাংশ ছাড় হয়েছে। বাকি ৪৭.২১ শতাংশ পাইপলাইনে আটকে রয়েছে।

২০০৬-০৭ অর্থবছরে অঙ্গীকার করে ছিল ২২৫ কোটি ৬১ লাখ ডলার, ছাড় হয়েছে ১৬৩ কোটি ৫ লাখ ডলার, পাইপলাইনে আটকে আছে ৬২ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে অঙ্গীকার ছিল ২৮৪ কোটি ২৪ লাখ ডলার, ছাড় হয়েছে ২০৬ কোটি ১৫ লাখ ডলার, পাইপলাইনে আটকে আছে ৭৮ কোটি ৯ লাখ ডলার।

২০০৮-০৯ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর এই ৯ বছর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। ওই সময় উন্নয়ন-সহযোগীরা ৫ হাজার ৪৮৭ কোটি ৮ লাখ ডলার সহায়তার অঙ্গীকার করেছিল। এর বিপরীতে ছাড় হয়েছে ২ হাজার ২২০ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। পাইপলাইনে আটকে আছে ৩ হাজার ২৬৬ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। ওই সময়ে মোট অঙ্গীকারের ৫৯.৫৩ শতাংশ ছাড় হয়েছে। বাকি ৪০.৪৭ শতাংশ আটকে আছে।

এর মধ্যে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে অঙ্গীকার ছিল ২৪৪ কোটি ৪৩ লাখ ডলার, ছাড় হয়েছে ১৮৪ কোটি ৭৩ লাখ ডলার, পাইপলাইনে আটকে আছে ৫৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে অঙ্গীকার ছিল ২৯৮ কোটি ৩৬ লাখ ডলার, ছাড় হয়েছে ২২২ কোটি ৭৭ লাখ ডলার, পাইপলাইনে ৫৭ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। ২০১০-১১ অর্থবছরে অঙ্গীকার ছিল ৫৯৬ কোটি ৮১ লাখ ডলার, ছাড় হয় ১৭৭ কোটি ৬৭ লাখ ডলার, পাইপলাইনে আটকে আছে ৪১৯ কোটি ১৯ লাখ ডলার। ২০১১-১২ অর্থবছরে অঙ্গীকার ছিল ৪৭৬ কোটি ৪৫ লাখ ডলার, ছাড় হয় ২১২ কোটি ৬৪ লাখ ডলার, পাইপলাইনে আটকা ২৬৩ কোটি ৮১ লাখ ডলার। ২০১২-১৩ অর্থবছরে অঙ্গীকার ছিল ৫৮৫ কোটি ৪৬ লাখ ডলার, ছাড় হয় ২৮১ কোটি ১০ লাখ ডলার, পাইপলাইনে আটকে আছে ৩০৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে অঙ্গীকার ছিল ৫৮৪ কোটি ৪২ লাখ ডলার, ছাড় হয়েছে ৩০৮ কোটি ৪৩ লাখ ডলার, পাইপলাইনে আটকে আছে ২৭৫ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অঙ্গীকার ছিল ৫২৫ কোটি ৮৪ লাখ ডলার, ছাড় হয়েছে ৩০৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার, পাইপলাইনে আটকে আছে ২৭৮ কোটি ৬২ লাখ ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে অঙ্গীকার ছিল ৭০৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ছাড় হয়েছে ৩৫৬ কোটি ৩৫ লাখ ডলার, পাইপলাইনে আটকে আছে ৩৮৪ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অঙ্গীকার ছিল ১ হাজার ৪৭৯ কোটি ৫১ লাখ ডলার, ছাড় হয়েছে ১৭২ কোটি ৩৫ লাখ ডলার, পাইপলাইনে আটকে আছে ১ হাজার ২৪৮ কোটি ৭৩ লাখ ডলার।