ব্যক্তিত্ব দিয়ে জাতির চেতনা ধারণ করেছিলেন: রেহমান সোবহান

Published in বণিক বার্তা  on Tuesday, 15 August 2017

 

[এক একাডেমিক আলোচনায় রেহমান সোবহান এক দেশ, দুই অর্থনীতি তত্ত্ব হাজির করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তরুণ অর্থনীতিবিদ দেখিয়েছিলেন, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কী ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। ১৯৬১ থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত ফোরামে প্রকাশিত তার লেখা প্রকৃত অর্থে ষাটের দশকের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সংগ্রামের এক জীবন্ত দলিল। ছয় দফা তৈরিতে তারও অংশগ্রহণ ছিল। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে শিল্প-বিদ্যুত্, প্রাকৃতিক সম্পদ অবকাঠামো বিভাগে (১৯৭২-৭৪) কর্মরত ছিলেন]

আমার জানা মতে, সাম্প্রতিক ইতিহাসেও আন্দোলনকারী কোনো নেতা বঙ্গবন্ধুর মতো সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের পূর্বেই দেশ ও জনগণের ওপর এমন পূর্ণ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব আরোপ করতে সক্ষম হননি। এ ক্ষেত্রে আমরা মহাত্মা গান্ধী, মাও সে তুং, হো চি মিন, নক্রুমা, সুকর্নো, ফিদেল ক্যাস্ট্রো প্রমুখ নেতার কথা উল্লেখ করতে পারি। এমন ঘটনার কথা আমার জানা নেই, যেখানে বেসামরিক সরকার ও সিভিল সমাজ উভয়েই ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর থেকে তাদের আনুগত্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে এবং এমন এক ব্যক্তির ওপর আনুগত্য ন্যস্ত করেছে রাষ্ট্রক্ষমতার ওপর যার কোনো আনুষ্ঠানিক কমান্ড নেই। এমন কোনো ঘটনার কথাও আমার জানা নেই, যেখানে ক্ষমতাসীন কিংবা দখলদার শক্তির সামরিক বাহিনীতে কর্মরত একটি জাতিগোষ্ঠীর সকলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিদ্রোহ করেছে এবং প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী নেতার প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছে।

২৬শে মার্চ ১৯৭১-এর এই গণবিদ্রোহে কর্মরত সৈন্যদেরকে একটি মুক্তিবাহিনীর সর্বাগ্রভাগে স্থাপন করে। সমগ্র বাঙালি জাতি একজন নেতার পেছনে সমবেত হওয়ার কারণে এই গণবিদ্রোহ সম্ভবপর হয়। এই নেতা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের জনগণ তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে নিরঙ্কুশভাবে নির্বাচিত করে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল এইভাবে একটি প্রতিনিধিত্বশীল মর্যাদা লাভ করেযা ছিল নির্বাচনী রাজনীতির ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। তবে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু তাঁর দলের ঊর্ধ্বে উঠে যান এবং ইতিহাস তাঁকে জাতির পিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ করে। ওই মার্চ মাসেই, বাঙালির ইতিহাসে হয়তো প্রথম ও শেষবারের মতোই, একজন মানুষ তাঁর ব্যক্তিত্ব দিয়ে একটি জাতির চেতনাকে ধারণ করেছিলেন এবং এইভাবে সমগ্র জনগণকে তাঁর পেছনে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অর্থাত্ সকল রাজনৈতিক মতের লোক, প্রশাসনযন্ত্র, সশস্ত্রবাহিনী, সিভিল সমাজের সকল অংশব্যবসায়ী থেকে শ্রমিক, পেশাজীবী থেকে দরিদ্র কৃষকসকলকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন এবং তাদের অনেকেই ১৯৭১-এর ২৬শে মার্চে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবন উৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত হয়।

১৭ মার্চ ১৯৯৬ সালে ভোরের কাগজে প্রকাশিত জাতির পিতার স্মরণে: মার্চ ১৯৭১ ও বাংলাদেশের অভ্যুদয় শীর্ষক নিবন্ধ থেকে নেয়া।