ব্যাংকিং খাত চরম সংকটে থাকলেও গত বাজেটে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি: ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Published in আমার সংবাদ on Monday, 18 December 2017

কৃষি ব্যাংকে লুটপাট

দীর্ঘদিন ধরে মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ি ব্যাংকটির ৭ হাজার ৫৪০ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জুন মাসে এই ঘটতির পরিমাণ ছিল ৩১৮ কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতির পাশাপাশি ব্যাংকটিতে বেড়েছে খেলাপি ও প্রভিশন ঘাটতি। এছাড়া সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে ব্যাংকটি এই মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।

সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে আমানতকারী বা সরকারের জোগান দেওয়া অর্থই মূলধন হিসাবে বিবেচিত। আন্তর্জাতিক নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ অথবা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি সেই পরিমাণ মূলধন রাখতে হচ্ছে। কোনো ব্যাংক এ পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে মূলধন ঘাটতি হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে বলেন, সৎ করদাতাদের টাকা নিয়ে বার বার ব্যাংকের মূলধনের জোগান দেয়া অনৈতিক। কিন্তু মূলধন গ্রাসকারী অসৎ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ব্যাংকিং খাত চরম সংকটের মধ্যে থাকলেও সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি গত বাজেটে। উল্লেখ্য, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মূলধন জোগান দিয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। তবে ব্যাংকগুলো চেয়েছিল সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মূল কারণ হিসেবে জানা যায়, গত কয়েক বছরে সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাওয়া মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। এটা সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতাই ফুটে উঠেছে। এর ফলে শুধু ব্যাংকিং খাতে নয়, পুরো অর্থনীতিতেই বিপর্যয় নেমে আসবে। বিদেশি বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে ঘাটতির মুখে পড়া ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বিদেশি ব্যাংকগুলো লেনদেন করতে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। এতে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে গ্যারান্টি হিসেবে তাদের বাড়তি ফি দিতে হচ্ছে। যার প্রভাবে ব্যবসা ব্যয় বেড়ে গেছে। এ দিকে ব্যাংককের দুর্নীতি ও লুটপাটের দায় জনগণের ঘাড়েও চাপানো হচ্ছে। জনগণের করের টাকায় বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ব্যাংককের মূলধন জোগান দিয়ে আসছে সরকার। গত তিন বছরে সরকারি ৬ ব্যাংকের ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৭ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নানা কারণে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানো যাচ্ছে না। তার মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অন্যতম সমস্যা হলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। কারণ, একদিকে পরিচালনা পর্ষদে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয় তাদের বেশির ভাগই সরকারি দলের সমর্থক। অপরদিকে ঋণ বিতরণে আছে রাজনৈতিক চাপ। রাজনৈতিক তদ্বিরের মাধ্যমে ঋণের চাপ আসে। আবার ওই ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে। ফলে যারা ঋণ নেন, তারাও কোনো না কোনোভাবে সরকারি আদর্শে বিশ্বাসী। এতে যে ঋণ দেওয়া হয় তা আর ফেরত আসে না। এভাবেই সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে যাচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক চাপ না এলে ব্যাংকগুলোতে সুশাসন ফিরে আসত। এই ব্যাংকটির কৃষি ঋণের শ্রেণীকৃত হওয়ার পরিমাণ বেশি। খেলাপি ঋণ এই ব্যাংকের একটি সমস্যা। পাশাপাশি কৃষি ঋণের সুদের হার কম বিধায় এটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বায়লাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কৃষি ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করা সম্ভব নয়। এই ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড হচ্ছে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অন্যদিকে শস্য ঋণের সুদের হার ১২ শতাংশ। ফলে ব্যাংকের পরিচালনা ব্যয় নিয়েও সমস্যা দেখা দিয়েছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত হিসাবে এই ব্যাংকের ঋণের স্থিতি ১৬ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। যার মধ্যে কৃষি ও দারিদ্র্য বিমোচন খাতে ঋণ ১২ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। মোট কৃষি ঋণের শস্য খাতে ঋণের স্থিতি ৮ হাজার ৭ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ব্যাংক মুনাফা অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না। কারণ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ খাত শস্য খাতে সর্বাধিক ঋণ দিচ্ছে।