ভারতীয় ঋণের আওতায় নেয়া প্রকল্পগুলো সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেঃ ড. মুস্তাফিজুর রহমান

Published in দৈনিক জনকন্ঠ on Thursday, 5 October 2017

ভারতীয় ঋণে অবকাঠামো উন্নয়নে ঘটবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন

এম শাহজাহান ॥ ভারতীয় ঋণের অর্থে অবকাঠামো খাতের উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হওয়ায় দেশে দ্রুত বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতিতেও বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বড় অঙ্কের যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে তাও কমে আসার পথ তৈরি হচ্ছে। বড় অঙ্কের এ ঋণচুক্তির ফলে ভারতীয় একক অথবা যৌথ বিনিয়োগ আসবে বাংলাদেশে। এছাড়া বড় ধরনের এ ঋণচুক্তির ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। ঋণচুক্তির পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি জানিয়েছেন, এ চুক্তির ফলে দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এবং সর্বোপরি আস্থার জায়গাটা আরও মজবুত হবে।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়তে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় গত সাত বছরে প্রথম ও দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিট বা এলওসি চুক্তির আওতায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করে বাংলাদেশ। আর এবার তৃতীয় এলওসির আওতায় আরও সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করা হলো। সব মিলিয়ে ভারত থেকে আট বিলিয়ন ডলার ঋণ হিসাবে পাওয়া যাবে। ১ শতাংশ সুদে আগামী ২০ বছরে ঋণের টাকা পরিশোধের সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। ফলে বড় অঙ্কের ঋণের এ টাকা দ্রুত পাওয়া গেলে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। দ্রুত বাড়বে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে ইতোমধ্যে ভারতীয় এ ঋণের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা হয়েছে। সংগঠনটির সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আলী, আবুল কাশেম আহমেদ ও জসিম উদ্দিন ভারতীয় ঋণ দ্রুত অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহারের জন্য তাগিদ দিয়েছেন। তারা বলছেন, ভারতীয় এ ঋণ ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার।

তৃতীয় এলওসি বা লাইন অব ক্রেডিট একটি ভাল চুক্তি হয়েছে। এ চুক্তির ফলে ৩৬ হাজার কোটি টাকা আসবে বাংলাদেশে, যা দিয়ে দেশের বড় ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি বাড়বে। একই সঙ্গে রফতানি বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। তাই দ্রুত যাতে ঋণের এসব টাকা ব্যবহার করা যায় সেদিকে সরকারের সবচেয়ে বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন। সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা থাকায় এর আগের দুটি এলওসির টাকা ব্যবহারে দক্ষতার পরিচয় দেয়া যায়নি। তবে এবার মনে হচ্ছে এ ঋণের সর্বোচ্চ ব্যবহারে দু’দেশই আন্তরিক। আশা করা হচ্ছে, সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে এবারের ঋণের টাকায় দ্রুত দেশের অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন করা সম্ভব হবে।

এদিকে, তৃতীয় এলওসির অর্থ দিয়ে ১৭ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পগুলো হলোÑ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে বিদ্যুত বিতরণ অবকাঠামো উন্নয়ন, পায়রা বন্দরের বহুমুখী টার্মিনাল নির্মাণ, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার ও তীর সংরক্ষণ, বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ, সৈয়দপুর বিমানবন্দর উন্নতকরণ, বেনাপোল-যশোর-ভাটিয়াপাড়া-ভাঙ্গা সড়ককে চার লেনে উন্নীত করা, চট্টগ্রামে কন্টেনার টার্মিনাল নির্মাণ, ঈশ্বরদীতে কন্টেনার ডিপো নির্মাণ, কাটিহার-পার্বতীপুর-বরনগর দিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যুত বিতরণ লাইন তৈরি, মংলা বন্দর উন্নয়ন, চট্টগ্রামে ড্রাই ডক নির্মাণ, মীরসরাইয়ের বারৈয়ারহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত চার লেনে সড়ক উন্নীত করা, মোল্লাহাটে ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ, মীরসরাই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন, কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর হয়ে সরাইল পর্যন্ত চার লেন সড়ক নির্মাণ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে এক লাখ এলইডি বাল্ব সরবরাহ প্রকল্প।

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, নতুন এ ঋণচুক্তির আওতায় ১৭ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। সব মিলিয়ে দেড় শতাংশ সুদ, সহজশর্তে এ ঋণ আমরা পেতে যাচ্ছি। যোগাযোগ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অবকাঠামো নির্মাণের এ প্রকল্পগুলো আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, তবে ঋণের অর্থছাড়েও যতœশীল হতে হবে ভারতকে। সময়মতো প্রকল্পের অর্থ ছাড় না হলে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হবে এটিই স্বাভাবিক। প্রতি বছর ২০ শতাংশ হারে ঋণের অর্থছাড়ের যে শর্ত রয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তাই অর্থছাড়ের বিষয়ে ভারতের এক্সিম ব্যাংককে আরও দক্ষতার পরিচয় দেয়া প্রয়োজন।

জানা গেছে, ঋণচুক্তির পাশাপাশি তিন বিষয় সামনে রেখে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলো হলো আঞ্চলিক যোগাযোগ, রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি। আঞ্চলিক যোগাযোগ বা কানেক্টিভিটির আওতায় ভারতের ভূখ- ব্যবহার করে ভুটান ও নেপালে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে বাংলাদেশ। একই ভাবে ভারত বাংলাদেশের ভূখ- ও বন্দর ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পাঠাতে পারবে। এজন্য বাংলাদেশকে নির্দিষ্ট হারে মাসুল প্রদান করবে ভারত। বাণিজ্য চুক্তির আওতায় ভারতে রফতানি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হবে। ভারতের সঙ্গে বড় অঙ্কের যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে তা দূর হবে রফতানি বাণিজ্যের মাধ্যমে। একই সঙ্গে জ্বালানি ও সেবাসহ বিভিন্ন খাতে ভারতের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা।

এছাড়া ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণে দশটি বর্ডার হাট চালু করতে যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ-মেঘালয় সীমান্তে তিনটি বর্ডার হাট চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশ-ত্রিপুরা সীমান্তে আরও তিনটি হাট স্থাপনের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া আরও চারটি বর্ডার হাট স্থাপনে দু’দেশের পক্ষ থেকে সম্মতি দেয়া হয়েছে। এসব হাট চালু হলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।