মূল্যপতন মানেই মালিকের মুনাফা কমে যাওয়া নয়: ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Published in বণিক বার্তা on Wednesday, 15 March 2017

এক দশকে পোশাকের মূল্য কমেছে ২৫ শতাংশের বেশি

বদরুল আলম

garmentসার্বিক নিরাপত্তা, পরিষেবা ব্যবহারে ব্যর্থতা রয়েছে। শ্রমের নিম্নমজুরির ওপর ভর করে হ্রাসমান পণ্যমূল্যের বাজারে প্রতিযোগিতায় বড় হওয়ার সাফল্যও আছে। রফতানি আয়ের প্রধান খাত বস্ত্র ও পোশাক শিল্প নিয়ে চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৃতীয় পর্ব

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতি পিস বেসিক টি-শার্টের রফতানি মূল্য ছিল ১ ডলার ৫০ সেন্ট। ২০১৬ সালে এসে একই পণ্যের মূল্য মাত্র ১ ডলার ১৫ সেন্ট দিতে চান মার্কিন ক্রেতারা। এ হিসাবে এক দশকের ব্যবধানে বেসিক টি-শার্টের মূল্য কমেছে ২৩ শতাংশ।

পণ্যের মূল্যহ্রাসের প্রবণতা দেখা গেছে পলো টি-শার্টের ক্ষেত্রেও। ২০০৫ সালে এক পিস পলো টি-শার্ট কিনতে ক্রেতারা খরচ করতেন ৩ ডলার ৫০ সেন্ট। ২০১৬ সালে একই পণ্যের মূল্য হিসেবে তারা দিতে চান ২ ডলার ৫০ সেন্ট। এ হিসাবে পলো টি-শার্টের মূল্য কমেছে প্রায় ২৯ শতাংশ।

শুধু বেসিক টি-শার্ট ও পলো টি-শার্ট নয়, রফতানিকৃত সব ধরনের নিট ও ওভেন পোশাকেরই দাম কমেছে গত এক দশকে। এর মধ্যে রয়েছে শার্ট, টি-শার্ট, ট্রাউজার, জ্যাকেট ও সোয়েটার।

ওভেন পণ্য প্রস্তুতকারকরা জানিয়েছেন, ২০১৬ সালে এক পিস কটন জিন্স প্যান্টের রফতানিমূল্য পাওয়া গেছে ৮ ডলার। যদিও ২০০৫ সালে একই পণ্য থেকে ১০ ডলার আয় করা যেত। এ হিসাবে এক দশকে কটন জিন্স প্যান্টের দাম কমেছে প্রায় ২৬ শতাংশ।

ওভেন পণ্যের মূল্য কমে যাওয়ার তথ্য মিলেছে আন্তর্জাতিক গবেষণায়ও। ২০১৫ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনির্ভাসিটির সহযোগী অধ্যাপক মার্ক অ্যানার ও ফেলো জেরেমি ব্লাসি এবং ইউনির্ভাসিটি অব কলোরাডোর সহযোগী অধ্যাপক জেনিফার বিরের গবেষণা অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া ওভেন পণ্যের মূল্য ৪০ শতাংশ কমেছে।

দেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর তথ্য বিশ্লেষণেও দেখা গেছে, এক দশকের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে নিট ও ওভেন উভয় পণ্যের মূল্য ২০ শতাংশের বেশি কমেছে।

খাত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ক্রেতারা নানা অজুহাতে ধারাবাহিকভাবে পণ্যের মূল্য কমাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ার পাশাপাশি ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ক্রেতারা দাম কমানোর চাপ দিচ্ছেন। আবার মুদ্রার অবমূল্যায়নও সাম্প্রতিককালে মূল্য কম চাওয়ার প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০১৩ সালের পর মূল্য কমানোর প্রধান হাতিয়ার হয়েছে কারখানার কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক নিরাপত্তা। ক্রেতাদের এ হাতিয়ার ব্যবহার আরো দৃঢ় হচ্ছে শিল্পোদ্যোক্তাদের অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতার প্রভাবে। ক্রয়াদেশ ধরতে কারখানা মালিকরা পণ্যের মূল্য অনেক কমিয়ে প্রস্তাব করছেন ক্রেতাদের। ক্রেতারাও এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, গড় হিসাব করলে গত এক দশকে মূল্য কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর মূল কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া। ২০১৫ সালে বৈশ্বিক বাজারে পোশাকের চাহিদা কমেছে ৭ শতাংশ। আর গত বছর কমেছে ৬ শতাংশ। দাম কমার আরেকটি কারণ হলো প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি। আর খুব ছোট একটি কারণ হলো অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা। এটা সবসময়ই থাকবে।

আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমানোর চাপ সবসময়ই মোকাবেলা করতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে টিকে থাকার জন্য আমরা বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে আসছি। ক্রেতারা মূল্য কমালেও কারখানা সংস্কারের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে দুর্বল অবকাঠামো, গ্যাস-বিদ্যুত্ ও দক্ষ শ্রমিক সংকট মোকাবেলা করে রফতানি কার্যক্রম চলমান রাখা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের দাম কমার অন্যতম একটি কারণ হলো— বাংলাদেশে তৈরি পোশাক সাধারণত কম দামি। রফতানি হওয়া তৈরি পোশাকের ৭৫ শতাংশই হচ্ছে সাধারণ টি-শার্ট, সিঙ্গলেট, ভেস্ট, জার্সি, পুলওভার, কার্ডিগান, স্যুট, জ্যাকেট, ট্রাউজার, শর্টস ও শার্ট। এ ধরনের পোশাকে মূল্য সংযোজন হয় অনেক কম। এ কারণেই পরিমাণ বাড়িয়ে এসব পণ্যের মূল্য কমিয়ে দিতে পারছেন ক্রেতা।

বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৫-০৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর নিট পোশাকের দাম কমেছে পিসপ্রতি ১ দশমিক ২ শতাংশ। আর ওভেন পোশাকের দাম কমেছে ২ দশমিক ২ শতাংশ হারে। অর্থাত্ নিট ও ওভেন পোশাক মিলে পোশাকপ্রতি দাম কমেছে গড়ে ১ দশমিক ৭ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পোশাকের মূল্য শুধু বাংলাদেশে নয়, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও কমেছে। তবে অন্যতম বড় বাজারে বাংলাদেশের কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্যপতনের প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। আবার কাঁচামালের মূল্য কমে যাওয়ার প্রভাবেও পোশাকের মূল্য কমেছে। গত এক দশকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে উত্পাদনশীলতা বেড়েছে। এর প্রভাবে উত্পাদন ব্যয়ও কমেছে। সুযোগটি মালিকদের পাশাপাশি ক্রেতারাও নিচ্ছেন। ফলে সামগ্রিকভাবে এক দশকে পোশাকের মূল্য কমেছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পোশাকের মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ওভেন পণ্যের মূল্য তুলনামূলক বেশি কমেছে। তবে মূল্যপতন মানেই মালিকের মুনাফা কমে যাওয়া নয়। উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রমিকদের দিয়ে পরিমাণে অনেক বেশি উত্পাদন করতে পারছেন মালিকরা। আবার কাঁচামালের আন্তর্জাতিক মূল্য কমে যাওয়ার কারণেও পোশাকের মূল্য কমেছে। তুলনামূলক কম মূল্যের পণ্য উত্পাদন আরো অনেক দিন অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি বহুমুখী পণ্য উত্পাদনে মনোযোগী হতে হবে। ক্রমান্বয়ে এ ধরনের পণ্য উত্পাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে মূল্য কমানোর চাপ মুক্ত হতে পারবেন পোশাক শিল্প মালিকরা।

তবে বহুমুখী পণ্য উত্পাদন ব্যবস্থা রাতারাতি গড়ে তোলা সম্ভব নয় বলে মনে করেন নিট পণ্য প্রস্তুতকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ পরিচালক ও অ্যাসরোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুল ইসলাম। তিনি বলেন,  মূল্য কমানোর চাপ অব্যাহত থাকার পাশাপাশি উত্পাদন ব্যয়ও ঊর্ধ্বমুখী। মজুরি, গ্যাস, বিদ্যুত্ সবকিছুর দাম বেড়েছে। এভাবে গত কয়েক বছরে উত্পাদন ব্যয় ১৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু শুধু উদ্যোক্তার পক্ষে এ পরিস্থিতি মোকাবেলা সহজ নয়। নীতিগত সহায়তাও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।