স্বাস্থ্য খাতে আরও বিনিয়োগ হোক

Published in সমকাল on Wednesday, 22 February 2017

সাক্ষাৎকার

অধ্যাপক সাকিকো ফুকুদা-পার

সাকিকো ফুকুদা-পার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের দ্য নিউ স্কুলের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ইন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক। তিনি জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির ভাইস চেয়ারম্যান। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিট অব সাসেক্স ও দ্য ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোমেসির গ্র্যাজুয়েট। ফুকুদা-পার পড়িয়েছেন কলাম্বিয়া ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে। কাজ করেছেন বিশ্বব্যাংকে। সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির তৃতীয় বার্ষিক বক্তৃতার প্রধান বক্তা হিসেবে বাংলাদেশে আসেন। ঢাকায় তিনি সমকালের সঙ্গে কথা বলেন

সমকাল: সিপিডির বক্তৃতায় আপনি স্বাস্থ্যসেবায় কতগুলো চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন…

সাকিকো ফুকুদা-পার: প্রকৃতপক্ষে অপর্যাপ্ত উদ্ভাবন, ওষুধপ্রাপ্তিতে সমস্যা ও নতুন ওষুধের দাম বৃদ্ধি_ এই তিনটি চ্যালেঞ্জ কেবল বাংলাদেশের নয়, বিশ্বব্যাপীই আমরা দেখছি। ওষুধের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসাসেবার ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা সর্বত্রই ঘটছে। এর প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি থাকার পরও বিশ্বব্যাপী বাড়ছে ওষুধের দাম। ফলে মানুষ কাঙ্ক্ষিত হারে ওষুধ পাচ্ছে না।

সমকাল: আপনি ওষুধের দাম বৃদ্ধির কথা বলেছেন। বাংলাদেশেও একই সমস্যা। কিন্তু বিপরীত বিষয় হলো দিন দিন আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে। সাম্প্রতিক হিসেবে আমাদের গড় আয়ু প্রায় ৭১ বছর। ওষুধের দাম কিংবা চিকিৎসাসেবার দাম বৃদ্ধির পরও এমনটা হচ্ছে। কীভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন।

ফুকুদা-পার: দেখুন গড় আয়ু বৃদ্ধি কেবল ওষুধ বা চিকিৎসার দাম বৃদ্ধির সঙ্গেই সম্পর্কিত নয়, নানা কারণে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেতে পারে। যেমন_ খাদ্য-পুষ্টি, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি। এসবসহ অন্যান্য দিক থেকে বাংলাদেশের অগ্রগতি লক্ষণীয়। ফলে এখানে গড় আয়ু বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি আগেই বলেছি; তবে যোগ করার বিষয় হলো, অনেক ওষুধ কিংবা নতুন নতুন ওষুধ বাংলাদেশকে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আন্তর্জাতিকভাবে যখন ওষুধের দাম চড়া, তখন বাংলাদেশকেও উচ্চমূল্য দিয়ে ওষুধ কিনতে হয়। তা বহন করতে হয় মানুষকেই। বাংলাদেশেও তার প্রভাব আমরা দেখেছি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশে যক্ষ্মা রোগে ২০১৪ সালে ৮১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। যদিও যক্ষ্মা চিকিৎসায় দুটি নতুন ওষুধ তৈরি হয়েছে এবং তা বাংলাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সমকাল: বাংলাদেশ প্রায় প্রয়োজনীয় সব ওষুধ উৎপাদন করে থাকে। কিন্তু আমাদের এখানে ওষুধের গুণগত মান এখনও বড় প্রশ্ন। আমরা দেখেছি, সম্প্রতি ২০টি ওষুধ কোম্পানিকে হাইকোর্ট থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১৪ কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন বন্ধ করা হয়েছে। এ ধরনের সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী?

ফুকুদা-পার: আমি মনে করি, মানের বিষয়টি প্রথম সরকারকে দেখতে হবে। সরকারের এ সংক্রান্ত আইন-নীতিমালা নিশ্চয়ই রয়েছে। সেগুলো যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে কি-না দেখতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনা সাধুবাদযোগ্য, এর মাধ্যমে নিশ্চয়ই এ খাতের কোম্পানিগুলো সতর্ক হবে। ওষুধ কোম্পানিগুলো ব্যবসা করছে ঠিক আছে, তবে অবশ্যই মানের দিকটি সরকারের তরফ থেকে তদারকি করতে হবে। কারণ ওষুধ মানুষ সেবন করে, যথাযথ ওষুধ না হলে তা মানুষের রোগ সারানোর পরিবর্তে উল্টো রোগাক্রান্ত করবে। তা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতোই। উৎপাদনকারীরা যেন এটা মনে না করে তারা যা ইচ্ছা তা করবে, তাদের দেখার কেউ নেই। অবশ্যই তাদের মাঝে দায়িত্ববোধ, পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে।

সমকাল: বিশ্বব্যাপী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবি্লউএইচও) জনস্বাস্থ্যের জন্য কাজ করছে। আমরা কীভাবে সংস্থাটি থেকে অধিক সহযোগিতা পেতে পারি?

ফুকুদা-পার: বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ঠিক আছে। কিন্তু সংস্থাটি আপনাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করবে না। বরং বাংলাদেশ থেকে ডবি্লউএইচওর কাছে দেশের স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে কীভাবে সংস্থাটি কাজ করতে পারে, তা তুলে ধরতে হবে। ডবি্লউএইচও একটি দেশের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করে। গবেষণামূলক নানা উপাত্ত প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি হুমকি থাকলে প্রত্যেককে সতর্ক করে। তবে এটা ঠিক, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, জাইকার মতো সংস্থার সঙ্গেও ডবি্লউএইচও একত্র হয়ে কাজ করে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তরফ থেকেই ঠিক করা উচিত স্বাস্থ্যসেবায় তাদের প্রায়োরিটি কী, সেখানে ডবি্লউএইচও কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে। যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, শিশুমৃত্যু ইত্যাদি বিষয়ে ডবি্লউএইচও সহযোগিতা করছে, আরও করবে বলে আমার ধারণা।

সমকাল: আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা একটি চ্যালেঞ্জ। এ ব্যাপারে সরকার অনেক কিছু করছে, আর কী করতে পারে?

ফুকুদা-পার: আমি আসলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নই। তবে এটা ঠিক, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে একটা সমস্যা রয়েছে। আমরা ওষুধের দাম বৃদ্ধির কথা বলেছি। দরিদ্র মানুষের আয় ক্ষমতার বাইরে, অনেক ওষুধ রয়েছে তা নিশ্চিত করবে কে? দরিদ্র মানুষ তো বটেই অনেক সময় মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চ মধ্যবিত্তও সমস্যায় পড়ে। এ সমস্যাটা অনেক সময় এইচআইভি, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ার মতো সংক্রামক ব্যাধির পাশাপাশি অসংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রেও ঘটছে। আমরা দেখছি, জনস্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার বিবেচনা করে ওষুধ উদ্ভাবনে বিনিয়োগ কম।

সরকারের উচিত হবে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো। এটা কেবল বাংলাদেশ সরকারের জন্যই নয়, সব দেশের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। কেবল বেসরকারি কোম্পানির ওপর ভরসা করে বসে থাকা নয়। বরং সরকারের তরফ থেকেই উদ্যোগ ও বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।

সমকাল: আমরা স্বাস্থ্যসেবার কথা বলছি। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো স্বাস্থ্যবীমা নেই। আমরা দেখেছি, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা কেয়ার করতে চেয়েছেন। বাংলাদেশে আমরা কীভাবে তা শুরু করতে পারি?

ফুকুদা পার: নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যবীমা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক দেশেই নানাভাবে এটি চালু আছে। উন্নয়নশীল দেশেও তা চালু রয়েছে। বাংলাদেশ আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে। ২০১০ সালে সিয়েরা লিওন ফ্রি হেলথ কেয়ার স্কিম চালু করে। তারা অবশ্য গর্ভবতী নারী ও শিশুদের বেশি জোর দিচ্ছে। তবে বাংলাদেশের প্রায়োরিটি তাদেরই ঠিক করা উচিত।

প্রাসঙ্গিকভাবে বলা দরকার, জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলে সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। সেখানে কতগুলো টার্গেটের কথাও বলা হয়েছে। যেমন প্রয়োজনীয় গুণগত স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা কার্যকর ও যথার্থ ওষুধ ও ভ্যাকসিন সবার জন্য নিশ্চিতকরণ। এগুলো বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পারলেও সবার স্বাস্থ্য অধিকার সহজ হবে।

সমকাল: আপনার ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

ফুকুদা-পার: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের পাঠকদের শুভেচ্ছা।

 

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মাহফুজুর রহমান মানিক