বাংলাদেশ নিরাপদ – এ বার্তা দিন সর্বত্র : ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম


Published in দৈনিক সমকাল on Wednesday, 24
 August 2016 

সমকালীন প্রসঙ্গ

বাংলাদেশ নিরাপদ – এ বার্তা দিন সর্বত্র : ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

security-bangladeshগুলশানে হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলার পর দেড় মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। ওই হামলার পর আরও দুটি ঘটনা দেশ-বিদেশে কেবল শঙ্কা বাড়ায়_ ৭ জুলাই পবিত্র ঈদের দিন শোলাকিয়ায় দেশের বৃহত্তম ঈদের জামাতে বড় ধরনের নাশকতার চেষ্টা ও ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুর এলাকায় একটি বাড়িতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত সফল অভিযানে ৯ সন্ত্রাসীর মৃত্যু। শেষোক্ত ঘটনা সম্পর্কে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে বলা হয়, বড় ধরনের নাশকতা পরিচালনার জন্যই ওই তরুণরা সেখানে সমবেত হয়েছিল। কয়েক ঘণ্টাব্যাপী এ অভিযান পরিচালিত হয়। গোলাগুলি চলে দু’পক্ষ থেকেই।

গুলশান হত্যাকাণ্ডে আমরা স্তম্ভিত। সর্বত্র প্রশ্ন উঠেছে_ এভাবে বিনা কারণে, বিনা প্ররোচনায় নিষ্ঠুর পন্থায় নারী-পুরুষদের হত্যা করা কীভাবে সম্ভব? নিহতদের মধ্যে ১৬ জন ছিলেন ইতালি ও জাপানের নাগরিক। জাপান বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বহু বছর ধরে সহায়তা দিচ্ছে। নিহতরা কাজ করছিলেন আমাদের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে। ইতালীয়দের কয়েকজন আমাদের তৈরি পোশাক রফতানির কাজে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এ হত্যাকাণ্ডে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে সংকট তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিকে অনেকেই সহনশীল, উদার হিসেবে জানেন। কিন্তু গুলশান হত্যাকাণ্ডের পর অনেক ইস্যু সামনে এসেছে। শিক্ষা কার্যক্রমে কোনো গলদ আছে কি? চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি কি তার প্রভাব হারাচ্ছে? পরিবারের বন্ধন কি দুর্বল হয়ে পড়ছে? আমাদের রাজনীতিতে সংকট রয়েছে এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে অনেক দিন ধরেই আলোচনা চলে। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক নিরাপত্তার ঝুঁকিও আলোচনায় রয়েছে। কিন্তু গুলশান হত্যাকাণ্ডের পর বিদেশিদের নিরাপত্তা বিশেষভাবে আলোচনায় আসে। বাংলাদেশের মানুষ অতিথিদের সমাদর করেন, এমনকি দরিদ্র মানুষও নিজে অভুক্ত থেকে খাবার তুলে দেন বিদেশি অতিথিকে। এসব যেন রাতারাতি পরিণত হয় অতীতের বিষয়ে।

গুলশান, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুরের সন্ত্রাসীদের মধ্যে কয়েকজন ছিল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। কেউ কেউ এসেছে ধনবান পরিবার থেকে। এতদিন ধারণা ছিল_ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করা কিছু তরুণ ভুল পথে চলে যাচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে, সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও সন্ত্রাসী রিত্রুক্রটমেন্ট চলছে। গুলশান হত্যাকাণ্ডের পর নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে পর্যালোচনা শুরু হয়। অর্থনীতিতে কী ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে, সেটাও বলা হতে থাকে। দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা পুঁজি খাটাতে কতটা নিরুৎসাহিত হবেন, তার হিসাবও কেউ কেউ দিতে থাকেন। তবে এর মধ্যেই আমাদের আশ্বস্ত করার মতো কিছু ঘটনা ঘটে। যেমন, সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আন্তরিক চেষ্টা। নির্দিষ্ট এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও সার্বিকভাবে অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যেও তাৎক্ষণিক ক্ষতির তথ্য নেই। তবে কিছু দেশে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিষয়ে যে মনোভাব গড়ে উঠছে তা সহজে দূর হবে বলে মনে হয় না। সরকার বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে সন্ত্রাসের যে কালো থাবা মাথাচাড়া দিয়েছে তার উৎস দেশের ভেতরেই। এর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নানা সমীকরণও যুক্ত। তবে এমন মতও বেশ জোরালো যে, বিশ্বব্যাপী চরমপন্থি শক্তির যে সক্রিয়তা আমরা দেখছি, তা থেকে হলি আর্টিসান কিংবা ঈদের জামাতে হামলাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা ঠিক হবে না। দেশের আরও কয়েকটি স্থানে বিদেশিদের ওপর হামলা হয়েছে এবং তাতে মৃত্যুর ঘটনা রয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও সুপরিকল্পিত হামলার শিকার হচ্ছে। এসব একান্তই অভ্যন্তরীণ কারণে ঘটছে কি? এ মতে অবিচল থাকার কারণে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী যে সমন্বিত কর্মকাণ্ড চলছে, তার সুবিধা গ্রহণ থেকে কিন্তু আমরা বঞ্চিত হতে পারি। বাংলাদেশের উদার, সহিষ্ণু ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্যও বিশ্ব সমাজের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানো জরুরি। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমরা যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করছি এবং ভবিষ্যতে যা করতে চাই তাতে সহযোগিতা প্রদানে আগ্রহী দেশগুলোকে সে বিষয়ে অবশ্যই জানাতে হবে।

এটা সুলক্ষণ যে, গত দেড় মাসে দেশের সর্বত্র সন্ত্রাসবাদের বিপদ নিয়ে অনেক সভা-সমাবেশ-মানববন্ধন হয়েছে। বিশেষভাবে কর্মসূচি পালিত হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। কেন ধনবান পরিবারের কিছু শিক্ষিত তরুণ জঙ্গিগোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছে, তার কারণ অনুসন্ধান চলছে। পরিবারের সদস্য হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে সেটা গোপন না রেখে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে। শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিতিও আলোচনায়। সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরদারের তাগিদ বেড়েছে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো উৎসব বা দিবসকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানের বাইরেও নিজেদের কর্মকাণ্ড বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে।

এটাও মনে রাখতে হবে, এসব হচ্ছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। দীর্ঘমেয়াদে ফল পেতে কিছু বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ দিতেই হবে। যেমন, বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রমের পাঠ্যসূচি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার, ক্যাম্পাস কিংবা বাইরে কে কী করছে তার প্রতি নজর রাখা, শিক্ষা-বহির্ভূত কর্মকাণ্ড বাড়ানো_ এসব গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিক বন্ধন নিয়েও নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় জনগণের সংশ্লিষ্টতা বাড়াতেও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ধর্মান্ধ চরমপন্থিদের পরাজিত করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপের পাশাপাশি পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজ_ সব স্থান থেকেই কিছু না কিছু করার রয়েছে। এরা যাতে অন্যান্য দেশের সন্ত্রাসী শক্তির সঙ্গে সংযুক্ত হতে না পারে, সে বিষয়েও সতর্ক থাকা চাই।

সন্ত্রাস দমনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। আমাদের কাজ অনেক, সে তুলনায় সক্ষমতায় ঘাটতি রয়ে গেছে। এটা পূরণে অভ্যন্তরীণ জোগান যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি বিশ্ব সম্প্রদায়েরও সহায়তা চাই। ইতিমধ্যে কোনো কোনো দেশ আমাদের চাহিদা জানতে চেয়েছে। আমরা তাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ ও উন্নত সরঞ্জাম পেতে পারি। আল কায়দা, ইসলামিক স্টেট_ যেসব সংগঠন একাধিক দেশে সক্রিয় তাদের মোকাবেলায় ইতিমধ্যে যারা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিশ্চয়ই নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ গত দেড় মাসে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে এবং আরও যা কিছু করতে চায় সেটাও তাদের জানাতে হবে।

বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার প্রসঙ্গে ফিরে যাই। বিদেশিরা এখানে কতটা নিরাপদ তার একটি মানদণ্ড হচ্ছে তাদের পরিবারের সদস্যদের অনুভূতি-অভিমত। তারা পরিবার নিয়ে এখানে অবস্থান ও চলাচলে স্বস্তিবোধ করতে চাইবে। উদ্বেগহীন থাকতে চাইবে। বাংলাদেশকে তারা যেন ‘নন-ফ্যামিলি পোস্টিংয়ের দেশ’ হিসেবে গণ্য না করে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হলি আর্টিসানে হামলার পর আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যে তাৎক্ষণিক প্রভাব নেই। কিন্তু গুলশান-বনানী-বারিধারার রেস্তোরাঁগুলোতে সেই আগের ভিড় নেই। বিপণি বিতানগুলোতে নেই ক্রেতাদের স্বাভাবিক আনাগানো। শোনা গেছে, বিদেশিদের অনেকে পরিবারের সদস্যদের স্বদেশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমরা জানি, অভিজাত এলাকায় অনেক ফ্ল্যাটে বিদেশিরা থাকেন। তারা পরিবারের সদস্যদের এখানে রাখতে না চাইলে বাড়ির মালিকদের সমস্যা হবে। গাড়িচালক ও গৃহকর্মীদের সমস্যা হবে।

স্থানীয় ব্যবসাতেও প্রভাব পড়বে। ওই এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও চলছে। এর প্রভাব নিয়ে শঙ্কিত অনেক বিনিয়োগকারী। কেউ যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েছেন। কেউ এক বা একাধিক সংস্থার অনুমোদন নিয়েছেন; কিন্তু অপরিহার্য কিছু সংস্থার অনুমোদন বা ক্লিয়ারেন্স নেননি। কেউ কেউ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় গুলশান-বারিধারা থেকে ব্যবসায়িক কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলতে উদ্যোগী। এসবের তাৎক্ষণিক প্রভাব কিন্তু কর্মসংস্থানেও পড়বে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে উন্নত দেশগুলোর ঋণ আছে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও ঋণ দেয়। এখন পর্যন্ত এসব ঋণের সুদের হার থাকে খুব কম, পরিশোধের মেয়াদ থাকে দীর্ঘ। নতুন পরিস্থিতিতে তারা বাংলাদেশ থেকে সরে যাবে_ তেমন ঘোষণা নেই বরং আশ্বাস আছে। তবে সতর্ক থাকা চাই। নতুন কোনো বিপদ ঘটলে সেটা অশনিসংকেত হয়ে উঠতে পারে। তখন প্রকল্প সহায়তা কমে যাবে কিংবা ‘ধীরে চলো নীতি’ ঘোষিত হবে। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে আসতে চাইবেন না কিংবা আগ্রহ কম দেখাবেন।

আমাদের অবকাঠামো চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ছে। গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে এলএনজি প্লান্ট স্থাপনের কাজ চলছে। পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে চলেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক প্রসারিত হয়েছে। ঢাকার সঙ্গে ময়মনসিংহ অঞ্চলের যাতায়াত সহজ হয়েছে। কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজে অগ্রগতি আছে। এসব উদ্যোগের পরিণতিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার কথা। তবে উদ্যোক্তারা অবশ্যই চাইবেন নিরাপদ পরিবেশ। এতে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি হতে দেওয়া চলবে না।

দেশের মতো প্রবাসে বাংলাদেশি কর্মীদের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সিঙ্গাপুরে কয়েকজন বাংলাদেশি দণ্ডিত হয়েছে জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার দায়ে। তারা ওই দেশে কাজ করতে গিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। এটা শুধু সে দেশের আইন লঙ্ঘন নয়; তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি। এ ধরনের ক্ষতিকর কাজে আমাদের কর্মীরা যুক্ত হলে প্রবাসের শ্রমবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এ ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা চেকিংয়ের প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের যেসব কর্মী দেশের বাইরে যাবে তাদের যাওয়ার আগে যেমন নির্দেশনা-পরামর্শ দিতে হবে, তেমনি অতীত কর্মকাণ্ডও খতিয়ে দেখতে হবে। আবার দেশে যারা ফেরত আসবে তারা প্রবাসে থাকাকালে কোনো নাশকতা-অপরাধে যুক্ত ছিল কি-না সেটাও জানার চেষ্টা করতে হবে।

বাংলাদেশকে সন্ত্রাসের ইস্যুতে জরুরি ভিত্তিতে ছোট-বড় পরিসরে আন্তর্জাতিক সম্মেলন-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আয়োজনের কথাও ভাবতে হবে। এর ফলে অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান যেমন ঘটবে, তেমনি সফল আয়োজন থেকে এ বার্তাও যাবে_ বাংলাদেশ যথেষ্ট নিরাপদ।

অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ_ সিপিডি