ব্যাংক খাত: সুশাসন নিশ্চিত করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ – ফাহমিদা খাতুন

বণিক বার্তা

সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত একাধিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে ব্যাংক খাতে সুশাসনের প্রসঙ্গটি বারবার সামনে আসছে। আমরা সবাই জানি, একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতির জন্য ব্যাংক খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের আর্থিক খাতের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, সেখানে ব্যাংক খাতের আধিপত্যটাই বেশি। অন্যান্য খাত অর্থাৎ নন-ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউট; যেমন— বীমা, ক্যাপিটাল মার্কেট প্রভৃতির চেয়ে ব্যাংক খাতের অংশ বেশি। গত চার দশকে এ খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। আমরা যখন স্বাধীনতা অর্জন করি, তখন ব্যাংক খাত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছিল, ব্যক্তি খাতের সেখানে কোনো ভূমিকা ছিল না। আশির দশকে অদক্ষতার কারণে ব্যক্তি খাতে পরিচালনার জন্য কিছু ব্যাংক ছেড়ে দেয়া হয়। এ খাতকে প্রতিযোগী করে তোলার জন্য বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি কমিশনও গঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়। মূলত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের তত্ত্বাবধানে এ খাতের সংস্কার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। নব্বইয়ের দশকে সংস্কার আরও গতি পায়। ফিন্যান্সিয়াল রিফর্ম প্রোগ্রাম, ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর অ্যাডজাস্টমেন্ট ক্রেডিট ইত্যাদি কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল— সুদের হার উন্মুক্ত করে দেয়া, ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশনিং সক্ষমতা বাড়ানো, মূলধন পুনর্গঠন ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়ানো এবং ঋণ আদায়ে আইনি ব্যবস্থা ও কাঠামোর উন্নয়ন। সংস্কারের ফলে ব্যাংক খাতের পারফরম্যান্সের কিছুটা উন্নতি হয়। যেমন— মূলধন পর্যাপ্ততা, মোট ঋণের মধ্যে খারাপ ঋণের অনুপাত, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, আয় ও মুনাফা, তারল্য, সম্পদের পর্যাপ্ততা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ব্যাংকগুলোর সংস্কারের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নীতিমালাও বাস্তবায়ন করা হয় এ সময়ে; যেমন— ‘ব্যাসেল ওয়ান’, ‘ব্যাসেল টু’ ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততা বজায় রাখা। তবে বিভিন্ন সূচকে ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য আপাতদৃষ্টিতে ভালো দেখা গেলেও কিছু দিন পরই ব্যাংক খাতে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।

বড় অঙ্কের অর্থ জালিয়াতি বা আর্থিক অনিয়মের ঘটনা উদ্ঘাটিত হচ্ছে। সম্পন্ন হওয়ার অনেক পরে হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো জালিয়াতির ঘটনা কিছু দিন আগে উদ্ঘাটিত হলো। এ অনিয়ম ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে শনাক্ত করতে পারেনি। অথচ আধুনিক ব্যাংক পরিচালনায় এগুলো চিহ্নিত করা কঠিন কিছু নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠে— সমস্যাটি কোথায়? এগুলো কি প্রাতিষ্ঠানিক নাকি সূচকের সমস্যা? যে সূচকগুলো প্রকাশ করা হচ্ছে, তা কি ব্যাংকগুলোর সঠিক চিত্র তুলে ধরছে? সোনালী ব্যাংকে সংঘটিত অর্থ কেলেঙ্কারি, যা হলমার্ক কেলেঙ্কারি নামে অধিক পরিচিতি লাভ করেছে সেখানে যে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে, তাকে অনেকে বড় কোনো অঙ্ক মনে করছেন না। কিন্তু সীমিত সম্পদের দেশে এ পরিমাণ অর্থের তাত্পর্য অনেক। এটি আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপির ৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য যে অর্থ দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে, তার ৪২ দশমিক ৯ শতাংশ। তদুপরি এটি সোনালী ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের ৩২০ দশমিক ৬ শতাংশ! এ অর্থ জালিয়াতির পর সংবাদমাধ্যম ও অডিট রিপোর্টে বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে— কে কীভাবে এ অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু বড় পরিসরে সামগ্রিক পরিস্থিতির দায়িত্ব নেয়ার ক্ষেত্রে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, অসৎ কর্মকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত এবং তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। তবে যাদের দেখভাল করার দায়িত্ব, তারা কোথায় ছিলেন? একটি ব্যাংক ক্রমেই ধার দেয়া প্রতিষ্ঠান থেকে ধার নেয়া প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হচ্ছে, তার চেকগুলো ফেরত আসছে— এসব দেখার বিষয়টি নিত্যদিনের কার্যক্রমের মধ্যে পড়ে বৈকি। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ম্যানুয়াল, ব্যাংকগুলোর নিজেদের অভ্যন্তরীণ ক্রেডিট নিয়ন্ত্রণ, নির্দিষ্ট সময় অন্তর অডিট প্রভৃতি ব্যবস্থা রয়েছে। মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক, বার্ষিক রিপোর্টিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এসব নিয়মনীতি পরিপালনে ব্যর্থতার কারণে এ ধরনের জালিয়াতি চাপা পড়ে যায় অনেক সময়। নাকি ইচ্ছে করে চাপা দেয়া হয়েছে? ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরই কেবল গোচরীভূত হওয়ার দৃষ্টান্ত অতীতেও রয়েছে। কিন্তু তা থেকে আমরা শিক্ষা নিইনি। হলমার্ক জালিয়াতি নতুন করে জানান দিচ্ছে— রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় সংস্কারের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, তা তেমন কাজে দেয়নি। আধুনিক ও দক্ষ মানব সম্পদ, উন্নত প্রযুক্তি, সঠিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা প্রভৃতির মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে গতিশীল করার প্রচেষ্টা এখনো সূদূরে রয়ে গেছে।

২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংকের সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে করপোরেটাইজেশন করার প্রস্তাব ছিল। করপোরেটাইজেশন করার মূল উদ্দেশ্য ছিল, অন্যান্য ব্যাংকের মতোই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এগুলো পরিচালিত হবে। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এ ব্যাংকগুলো সেবা প্রদান ও মুনাফা অর্জন করবে। সেই সংস্কারের অংশ হিসেবে প্রধান কর্মকর্তা ও এমডি, ডিএমডিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংকের সমপর্যায়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তাদের নিয়োগও প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার কথা ছিল। সংস্কারের ফলে অবশ্য ২০০৮ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো প্রথমবারের মতো মুনাফা অর্জন করে। এর আগে তাদের মুনাফা শূন্যের ঘরে ছিল। এখন আবার দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো পেছনের দিকে চলতে শুরু করেছে। এ অবস্থার উন্নতির ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের দক্ষতা মূল্যায়নের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের যোগ্যতার বিষয়টিও সামনে আসছে।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ রাজনৈতিকভাবে গঠিত হয়। এ কারণে তাদের রাজনৈতিক নির্দেশনা পালন করতে হয়। দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক বিবেচনা উপেক্ষা করে রাজনৈতিক নির্দেশমতো বিভিন্ন ঋণ দেয়া হয়। পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু করার সুযোগ থাকে না ব্যাংক কর্মকর্তাদের। যেহেতু সুযোগ থাকে না, তাই তারাও একই সুরে কথা বলতে থাকেন। ফলে ব্যাংকের স্বার্থ অনেক ক্ষেত্রেই চাপা পড়ে থাকে।

পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষতা ও ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টিও এড়ানো যায় না। অনেকে প্রশ্ন করছেন— এত বড় অনিয়ম হয়ে গেল, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কী কোনো ভূমিকা ছিল না? এটা ঠিক, বাংলাদেশ ব্যাংকই বিষয়টি প্রথমে শনাক্ত করে সোনালী ব্যাংককে সতর্ক করেছিল। এরপর পরবর্তী পদক্ষেপ কী নেয়া হলো? কিংবা সোনালী ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ যে বাড়ছিল, সেখানে কী উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল— এ বিষয়গুলো পরিষ্কার হওয়া উচিত। শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদই নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও অনেক সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পান— সে রকম গুঞ্জনও রয়েছে।

এ ধরনের জালিয়াতির ফলে সামগ্রিকভাবে আর্থিক খাতের ওপর মানুষের আস্থা কমে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। ব্যাংকে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলে তা সুদের হারে প্রভাব ফেলবে, যা কিনা ব্যক্তিখাতে ঋণপ্রবাহের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উদ্যোগ যত শিগগির নেয়া হবে, আর্থিক খাতের জন্য ততই মঙ্গলজনক।

সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে আর্থিক খাতের জন্য একটি কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। এর আগেও ব্যাংকিং খাতের জন্য এমন অনেক কমিশন হয়েছে। কিন্তু এ কমিশনগুলো থেকে আসা সুপারিশ বাস্তবায়ন না করা হলে শুধু কমিশন গঠন করে লাভ নেই। আশা করা হচ্ছে, বর্তমান অভিজ্ঞতার আলোকে এ ধরনের কমিশন ভবিষ্যতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।