এসডিজি বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়গুলোকে আরো সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে – ফাহমিদা খাতুন

CPD Research Director Dr Fahmida Khatun in an interview with Bonik Barta discusses ways to realise the Sustainable Development Goals (SDGs) in the context of Bangladesh, interview published in Bonik Barta on Wednesday, 7 October 2015.

সাক্ষাৎকার
এসডিজি বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়গুলোকে আরো সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে

ড. ফাহমিদা খাতুন

cpd-fahmida-khatun-sdg-bangladesh-2015

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক। এর আগে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ইউএনডিপি ও ইউএসএআইডিতে কাজ করেছেন। খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ এবং গ্রিনিচ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফুলব্রাইট ফেলোশিপ পেয়ে এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং স্কলার হিসেবে গবেষণা করছেন অধ্যাপক জেফ্রি স্যাক্সের সঙ্গে। তাছাড়া নরওয়ের ক্রিশ্চিয়ান মিকেলসেন ইনস্টিটিউট এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়া ইনস্টিটিউট ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিকস অ্যান্ড ট্রেড নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। গবেষণার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী কর্মকাণ্ডেও জড়িত হয়েছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সামষ্টিক অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, পরিবেশ ও স্বল্পোন্নত দেশের অর্থনীতি বিষয়ে দেশে ও বিদেশে তার অনেক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তিনি ভারতের সেন্টার ফর স্টাডি অব সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড পলিসি নামক প্রতিষ্ঠানে একজন ভিজিটিং স্কলার। তার সঙ্গে এসডিজি সম্পর্কিত নানা বিষয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার এমএম মুসা

সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ মোটামুটি ভালো করেছে— সবাই বলছে এটা। এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথমে জানতে চাইব, আমরা এমডিজির কোন কোন লক্ষ্যে ভালো করেছি?

এমডিজিতে যে আটটি লক্ষ্য ছিল, তার মধ্যে দারিদ্র্য দূরীকরণসহ অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন ভালো। যেমন— দারিদ্র্য দূরীকরণ, প্রাথমিক শিক্ষা, মেয়েদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অগ্রগতি, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, খাদ্যনিরাপত্তা প্রভৃতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। শুধু তা-ই নয়, নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অনেক লক্ষ্য পূরণ হয়ে গেছে। যেখানে সমস্যা ছিল, ৮ নম্বর লক্ষ্য অর্থাত্ বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব। সেখানে বলা ছিল, দরিদ্র দেশগুলোর উন্নয়নে উন্নত দেশগুলো অর্থ, বাণিজ্য, প্রযুক্তি প্রভৃতির মাধ্যমে সহযোগিতা করবে। কিন্তু সেটা পূরণ হয়নি। কথা ছিল, উন্নত দেশগুলো তাদের জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দেবে। তা হয়নি। ধনী দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে বিনা শুল্কে বাজার সুবিধা দেবে, সেটিও অর্জিত হয়নি। এগুলোয় বাংলাদেশের ভূমিকা গ্রহীতার। তাই আমি বলব, এমডিজির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন উল্লেখযোগ্য ছিল।

এ অর্জনের পেছনে কোন বিষয়গুলো কাজ করেছে?

বাংলাদেশের জন্য এসডিজির লক্ষ্যগুলো অর্জন খুব একটা কঠিন হয়নি এজন্য যে, আমাদের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলোয় দারিদ্র্য বিমোচনসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক লক্ষ্য সবসময়ই ছিল। এসব লক্ষ্য নির্ধারণে বৈশ্বিক পর্যায়ে কোনো উদ্যোগের ওপর আমরা নির্ভর করিনি। আমরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন, সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়া, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, শিক্ষার হার বাড়ানো এবং নারীর ক্ষমতায়নের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করেছি। তার পর সেগুলো অর্জনের জন্য কর্মসূচি প্রণয়ন করেছি। একদিকে সরকারের পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ড, অন্যদিকে এনজিওগুলোর কার্যক্রম ও ব্যক্তি খাতের উদ্যোগ— সবার কাজের সমন্বয়ে আমরা সফল হতে পেরেছি।

এবার এসডিজি প্রসঙ্গে আসা যাক। বলা হচ্ছে, এক্ষেত্রে গুণের দিকে বেশি জোর দেয়া হবে। আপনার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের কোথায় জোর দেয়া উচিত?

এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাগুলোর পরিধি অনেক বড়। এসডিজিতে ১৭টি লক্ষ্য, যার অধীনে আরো ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। নিঃসন্দেহে এসডিজি অর্জন এমডিজির চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। যেমন— ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য, সবার জন্য শিক্ষা, সবার জন্য জ্বালানি ও বিদ্যুত্ ইত্যাদি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে এসডিজিতে। এমডিজিতে এ রকম ‘সবার জন্য’ বিষয়টি ছিল না। যেমন— এমডিজিতে দারিদ্র্যসীমা ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে অর্ধেকে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এসডিজিতে ২০৩০ সালের মধ্যে সব দেশে, সবার অতি দারিদ্র্য দূর করতে হবে। অর্থাত্ বর্তমানে যারা দিনে ১ দশমিক ২৫ ডলারের নিচে আয় করছে, তাদের সবার দারিদ্র্য দূর করতে হবে। এসডিজির মূল ভাব হলো, কাউকেই পেছনে ফেলে রাখা যাবে না, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে হবে। বিশ্বনেতারা মনে করছেন, সবার প্রচেষ্টা দিয়ে এসব লক্ষ্য অর্জন করা যাবে। তাছাড়া এসডিজিতে টেকসই উন্নয়নের বিভিন্ন দিক বিবেচনায় আনা হয়েছে। অর্থাত্ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে এসডিজি প্রণয়ন করা হয়েছে। কেননা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হওয়ার পরেও অন্য দুটি ক্ষেত্রে দুর্বলতা থাকলে সেই উন্নয়ন টেকসই হয় না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলো, কিন্তু এর সুফল সবাই পেল না, বৈষম্য রয়ে গেল; তাহলে সামাজিক অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত হবে না। পরিবেশের অবক্ষয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়, এমনকি পিছিয়েও পড়ে। এ বিষয়গুলো এসডিজিতে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। সেদিক থেকে এসডিজিকে বেশ প্রাগ্রসর, অনেক সুদূরপ্রসারী বলা যায়। একদিকে এটা উচ্চাভিলাসী বটে, কিন্তু এ পরিকল্পনায় মানব উন্নয়নের সামগ্রিক দিকগুলো বিবেচনা করা হয়েছে। কেননা অনেক দেশে দারিদ্র্য কমার পরও আয় বৈষম্য ও সামাজিক বৈষম্য কমেনি। তাই এবার উন্নয়নের গুণগত দিকগুলোর ওপরও নজর দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের কী করার আছে এতে?

এসডিজির উদ্দেশ্যগুলো বৈশ্বিক পর্যায়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন জাতীয় পর্যায়ে সেগুলো বাস্তবায়ন করাটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। এখানে কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগ দেয়া দরকার। আমরা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলো করে আসছি। আগেই বলেছি, সেখানে দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি ছিল। এখন সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করেছে। সেখানেও এসব লক্ষ্যমাত্রার প্রতিফলন রয়েছে। এসব ভালো দিক। কিন্তু সমস্যা হলো, কীভাবে এসডিজি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এক. এজন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ লাগবে, সেটি কোথা থেকে পাওয়া যাবে। একটা হিসাব করা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী এগুলো বাস্তবায়নের জন্য আগামী ১৫ বছরে ১৭২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার লাগবে। এ বছরের জুলাইয়ে ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় অনুষ্ঠিত ‘উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন’ শীর্ষক সম্মেলনে উন্নয়ন সহযোগীরা কে কত অর্থ দেবে তা বলেছে। কিন্তু সব অর্থ এখনো জোগাড় হয়নি। উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড়াও বিভিন্ন সূত্র থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাছাড়া বিশেষ করে প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে সম্পদ আহরণেও জোর দেয়া হচ্ছে। এজন্য অভ্যন্তরীণ কর আহরণ বাড়ানোর ওপর নজর রাখতে বলা হচ্ছে। স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে কর আহরণ বড় সমস্যা। কর ফাঁকি, কর জালের আওতায় সবাইকে না আনা ইত্যাদি সমস্যা দূর করার কথা বলা হচ্ছে। দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ বাইরে চলে যাওয়া বন্ধ করার কথাও আলোচিত হচ্ছে। অর্থায়নের সমস্যাটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমাদেরকে বৈশ্বিক সূত্র ও দেশের ভেতর থেকে সম্পদ আহরণ করতে হবে।

অর্থায়ন ছাড়াও আরেকটি সমস্যা হচ্ছে সমন্বয়ের অভাব। এসডিজি অর্জনের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, যেমন— অর্থ, পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মহিলা ও শিশু, কৃষি, জ্বালানি, পরিবেশসহ আরো অনেক মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এমডিজি বাস্তবায়নের সময় সব মন্ত্রণালয় একই রকম সচেতন ছিল না। কিন্তু এখন তাদের আগের চেয়ে অধিক সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে।

এমডিজিতে শুধু লক্ষ্যমাত্রা ছিল, কিন্তু কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু ছিল না। কিন্তু এসডিজির ১৭ নম্বর লক্ষ্যমাত্রায় এটি বাস্তবায়নের বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে বলা আছে। যেমন— অর্থায়ন, প্রযুক্তি, সক্ষমতা বাড়ানো, বাণিজ্য সুবিধা, নীতিমালা ও প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য বৈশ্বিক সহযোগিতা এবং সরকার, ব্যক্তি খাত ও সুশীল সমাজের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, এসডিজির অগ্রগতি জানার জন্য মানসম্পন্ন ও সময়োপযোগী পরিসংখ্যান পাওয়া খুবই জরুরি। কোনো দেশের আয়, নারী উন্নয়ন, বয়স, অভিবাসন, ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক তথ্য না থাকলে এসডিজি বাস্তবায়ন কতখানি হলো, তা বোঝা কঠিন। তাই পরিসংখ্যান ও স্বচ্ছতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে, তথ্য বিপ্লবের কথা বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকেও এ বিষয়গুলো বিচেনায় রেখে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কার্যক্রম এক্ষেত্রে কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে?

প্রথম কথা হচ্ছে, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কার্যক্রম বন্ধ করা যাবে না। উন্নত দেশেও এসব কার্যক্রম থাকে বিভিন্নভাবে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আমরা যাদের আনছি, তারা অতিদরিদ্র। অনেকের উত্পাদনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার মতো সক্ষমতা থাকে না। যেকোনো কল্যাণমুখী প্রগতিশীল সরকারের অন্যতম ভূমিকা থাকে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষকে দেখাশোনা করা। আমাদের দেশে সামাজিক সুরক্ষা খাতে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ ব্যয় হয়। আমরা এটিকে বাড়িয়ে অন্তত জিডিপির ৪ শতাংশ করার কথা বলছি। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এটি ৩ শতাংশ করার লক্ষ্য ছিল। সেটি আমরা পূরণ করতে পারিনি। উন্নত দেশে এ খাতে জিডিপির ৮ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। এসডিজিতে জোর দেয়া হচ্ছে, উত্পাদনশীল সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর। সমাজের নাজুক জনসংখ্যাকে সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনীর মধ্যে আনার পাশাপাশি কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে যদি উত্পাদনশীল কাজে না লাগানো যায়; তাহলে উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য দূরীকরণ কোনোটাই সম্ভব হবে না।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি একই স্থানে আটকে  আছে। এ পরিস্থিতিতে এসডিজি বাস্তবায়ন আমাদের জন্য কতখানি চ্যালেঞ্জের হবে?

নিঃসন্দেহে এটা চ্যালেঞ্জিং হবে। তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় প্রেক্ষিতই দেখতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে ২০০৮ সালে আর্থিক মন্দার পর বড় বড় অর্থনীতি এখনো স্থবিরতা কাটাতে পারেনি। বৈদেশিক সাহায্য এবং বিশেষ করে রফতানির জন্য ওই সব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর আমরা অনেকটা নির্ভরশীল। অন্যদিকে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক পরিবেশ একটা বড় বিষয়। কারণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়াতে পারব না, অবকাঠামো উন্নয়ন করতে পারব না, স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারব না, তখন আমরা এসডিজির লক্ষ্য পূরণে পিছিয়ে পড়ব। কারণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না হলে মানুষের আয় বাড়বে না, আয় না বাড়লে দারিদ্র্য বিমোচন হবে না, আয় না বাড়লে তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করতে পারবে না। দেশের ভেতরে আমি বলব কয়েকটা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এক. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। দুই. ভৌত অবকাঠামো ও সামাজিক উভয় খাতেই বিনিয়োগ বৃদ্ধি। এগুলো করতে না পারলে এসডিজি বাস্তবায়ন কষ্টকর হবে। এসডিজি পূরণের ক্ষেত্রে আমাদের আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো, জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত বাংলাদেশের ওপর অনেক বেশি মাত্রায় পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এটা প্রশমনে অর্থ ও প্রযুক্তি দুটোরই প্রয়োজন রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে আমরা কতখানি এ ব্যাপারে সহযোগিতা পাব, তার ওপরও নির্ভর করছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কতটা মোকাবেলা করতে পারব।

আমরা তো সম্প্রতি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। ফলে বাংলাদেশের জন্য আরো চ্যালেঞ্জ বাড়বে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতি কেমন হওয়া উচিত?

নিম্ন আয় থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ে উন্নীত হওয়াটা ভালো অর্জন। এখানে আমাদের ভাবমূর্তির ব্যাপার আছে। তার ওপর ২০২১ সালের মধ্যে আমাদের মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার যে স্বপ্ন রয়েছে, সেক্ষেত্রে কিছুটা এগোলাম। কিন্তু নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া মানে স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসা নয়। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে হলে শুধু মাথাপিছু আয় বাড়ালে চলবে না। পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচক এবং ভঙ্গুরতা সূচকেও অগ্রগতি অর্জন করতে হবে। তাই স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যে সুবিধাগুলো আমরা পাচ্ছি, তা এখনো বহাল থাকবে। তবে হ্যাঁ, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হওয়ায় এখন আমাদের অনেকে স্বল্প সুদে ঋণ দেবে না। তবে অন্যদিকে আমাদের সুযোগও বাড়বে। আমাদের ক্রেডিট রেটিং উন্নত হবে। ফলে বাইরে থেকে বাণিজ্যিক ঋণ নিতে পারব। একটু বেশি সুদেই নিতে হবে। কিন্তু আমি মনে করি, আমাদের দেশে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের বিশ্ববাজার থেকে বাণিজ্যিক সুদের হারে ঋণ নেয়ার সক্ষমতা রয়েছে। পাশাপাশি আমাদের প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে হবে এবং দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হবে। এজন্য দরকার বিনিয়োগ এবং প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানো। এখন যে প্রবৃদ্ধির মধ্যে আটকে রয়েছি, সেটি ভাঙতে হবে।

এটা কীভাবে ভাঙা সম্ভব?

এটি ভাঙতে হলে আমাদের অর্থনীতির সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার কথা আগেই বলেছি। পাশাপাশি রফতানি বৈচিত্র্যকরণ, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা, মানবসম্পদের দক্ষতা বাড়ানো, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি, অবকাঠামোতে বিনিয়োগ ইত্যাদি প্রয়োজন। কর্মসংস্থান বাড়ানোও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুধু তা-ই নয়, কোন ধরনের কর্মসংস্থান করব, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। অর্থাত্ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। তবে সবকিছুর আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আমাদের সামনে এখন দুটি চ্যালেঞ্জ। একটি হলো, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। অন্যটি এসডিজি বাস্তবায়ন। রাজনৈতিক অঙ্গীকার অব্যাহত থাকলে এসডিজির বেলায়ও আমরা সফল হব।