বাংলাদেশের লাভের জায়গা চারটি – খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

In an interview, Dr Khondaker Golam Moazzem speaks on the Bangladesh-Bhutan-India-Nepal (BBIN) transit, published in Prothom Alo on Saturday, 7 November 2015.

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের (বিবিআইএন) মধ্যে পারস্পরিক ভূখণ্ড ব্যবহার করে যাত্রী ও পণ্যবাহী যান চলাচলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই ট্রানজিট-ব্যবস্থা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

এ সপ্তাহের সাক্ষাৎকার: খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
বাংলাদেশের লাভের জায়গা চারটি

জাহাঙ্গীর শাহ

প্রথম আলো: বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের (বিবিআইএন) মধ্যে পারস্পরিক ভূখণ্ড ব্যবহার করে যাত্রী ও পণ্যবাহী যান চলাচলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা পথে পণ্যবাহী ট্রাক গেছে। এ থেকে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: এ চুক্তির ফলে বাংলাদেশের বাড়তি লাভের জায়গা হতে পারে চারটি। প্রথমত, আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে; বিশেষত নেপাল ও ভুটানে সহজতর যোগাযোগের জন্য রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। নেপাল ও ভুটানের কাছে সমজাতীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশও নতুন আমদানির উৎস হতে পারে। বর্তমানে নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের রপ্তানি যথাক্রমে ২১ দশমিক ৭ মিলিয়ন এবং ৫ মিলিয়ন ডলার, অন্যদিকে ভারতের রপ্তানি যথাক্রমে ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন এবং ৭৮১ মিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে এ তিনটি দেশের পণ্য বাণিজ্য হলে বিভিন্ন শুল্ক, মাশুল ইত্যাদির মাধ্যমে বাড়তি রাজস্ব আদায় হতে পারে। তৃতীয়ত, উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির কারণে স্থানীয় পরিবহন অপারেটর ও লজিস্টিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হবে। চতুর্থত, এ চুক্তির ফলে আঞ্চলিক পর্যায়ে উৎপাদন নেটওয়ার্ক গড়ে উঠলে বিভিন্ন সম্ভাবনাময় খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রথম আলো: এ ধরনের উদ্যোগ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে আসিয়ানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। সেটা অর্থনীতির জন্য কতটা উপকারে আসবে?

মোয়াজ্জেম: বিবিআইএন মোটর চলাচল চুক্তির আওতায় বর্তমানে সীমিতসংখ্যক পথে পণ্য ও যাত্রী চলাচলের সুযোগ হলেও ভবিষ্যতে তা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ করে দেবে। এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ সংযুক্ত হলে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে বাণিজ্য ব্যয় কমে বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের মোট বাণিজ্য প্রায় ৭ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ভারত, চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এ পথে বাণিজ্য করলে বাংলাদশের ভূখণ্ড ব্যবহারের কারণে বাড়তি রাজস্ব প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে আসিয়ান দেশগুলোর বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৭২ বিলিয়ন ডলার এবং চীনের সঙ্গে এর পরিমাণ প্রায় ৬৩ মিলিয়ন ডলার। ভবিষ্যতে ভারত ও বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সড়কপথে যুক্ত হলে একটি আঞ্চলিক উৎপাদন নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে, যা বাণিজ্য ও বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

আঞ্চলিক যোগাযোগ

  • সহজতর যোগাযোগের সুবাদে আমদানি-রপ্তানি বাড়তে পারে
  • ভূখণ্ড ব্যবহারের সুযোগ দিলে বাড়তি রাজস্ব আদায়
  • পরিবহন ও লজিস্টিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের সুযোগ পাবে
  • বিভিন্ন সম্ভাবনাময় খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা

প্রথম আলো: ট্রানজিট-ব্যবস্থা চালু করতে বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার। এই বিনিয়োগ কীভাবে আসতে পারে?

মোয়াজ্জেম: বিবিআইএন মোটরযান চলাচল চুক্তিভুক্ত সড়কপথ, স্থলবন্দর এবং নৌ ও সমুদ্রবন্দর-সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য অবকাঠামো বর্তমানে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রস্তুত নয়। এ সমস্যা চুক্তিভুক্ত প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রেই কম-বেশি রয়েছে। তবে ভারতের দিক থেকে পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো। যেহেতু বাংলাদেশই মূলত ট্রানজিট পথ হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হবে, তাই বাংলাদেশ অংশে বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে বিবিআইএনের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রায় ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ট্রানজিট করিডর উন্নয়নে, বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধিতে এবং স্থলবন্দরের উন্নয়নে অর্থ-সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। জাপান সরকারের প্রতিষ্ঠান জাইকা অর্থ-সহায়তা দিতে আগ্রহী। তবে এই বিপুল বিনিয়োগের সুফল অনেকাংশে নির্ভর করবে অন্য দেশ তাদের সংশ্লিষ্ট অংশের অবকাঠামো উন্নয়নে একই সময়ে সমভাবে বিনিয়োগ করে সড়কযোগাযোগ পথকে আঞ্চলিক বাণিজ্যের জন্য প্রস্তুত করছে কি না, তার ওপর।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করলে মাশুল নির্ধারণ করার সময় কোন কোন বিষয় আসতে পারে?

মোয়াজ্জেম: বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পণ্য চলাচলের ক্ষেত্রে কয়েক প্রকারের মাশুল বা চার্জ বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের কারণে যানবাহনের ওপর ট্রানজিট মাশুল আরোপ করা। দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ সড়ক বা অবকাঠামো ব্যবহারের কারণে বাড়তি ব্যয়, ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন মাশুল ঠিক করা। এ ক্ষেত্রে সড়কের বিনিয়োগজনিত ব্যয় (নতুন সড়ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে), সড়ক নিয়মিত পরিচর্যা, পরিবেশ দূষণ-ক্ষতি, সড়কে বাড়তি চাপজনিত ক্ষতি ইত্যাদি বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে স্থলবন্দর, নৌবন্দর, সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সেবার জন্য বিভিন্ন শুল্ক-মাশুল ধার্য করা হতে পারে। সামগ্রিকভাবে শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ধার্যকৃত শুল্কের ফলে আন্ত-আঞ্চলিক পরিবহন ব্যয় যাতে এমন পর্যায়ে থাকে, যাতে পণ্য পরিবহনকারী দেশগুলো ট্রানজিট হিসেবে বিবিআইএন পথকে ব্যবহারে উৎসাহিত হয়; একই সঙ্গে এ পরিবহনসেবা প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে তার সামগ্রিক ব্যয় মেটানো এবং বাড়তি রাজস্ব আদায় যাতে সম্ভব হয়।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পণ্য নেওয়ার সুবিধা ভারতকে দিলে পণ্যের বর্তমান বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে কি?

মোয়াজ্জেম: উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশের পণ্যের বাজারটি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৩ সালে উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি ছিল ৬৬ মিলিয়ন ডলার। ২০০৫ সালে মোট রপ্তানি ছিল মাত্র ৫ মিলিয়ন ডলার এবং ২০০৯ সালে ছিল ৩৪ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের মূল রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট, পাথর, মাছ, সাবান, কাপড়, ইলেকট্রনিক পণ্য, খাদ্যপণ্য, কাচ ইত্যাদি। এসব পণ্য ভারতের অন্যান্য অংশেও উৎপাদিত হয় এবং তা সীমিত আকারে উত্তর-পূর্ব ভারতে অভ্যন্তরীণ রপ্তানি হয়। নতুন চুক্তির ফলে পণ্য পরিবহনে সময় ও ব্যয় লক্ষণীয়ভাবে কমে এলে উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যকে ভারতীয় রপ্তানি পণ্যের সঙ্গে বাড়তি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে পড়তে হবে। তবে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে পণ্য বিপণন করলে এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাদের খুব বড় সমস্যায় ফেলবে না।