Dr Khondaker Golam Moazzem on cattle trade

Published in Prothom Alo on Monday, 31 August 2015.

ভারত থেকে গরু আনতে বাধা

কামরুল হাসান

সীমান্তে বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ী ও গরু আনা শ্রমিকেরা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) বাধার মুখে পড়ছেন। ভারত থেকে যাতে বাংলাদেশে গরু ঢুকতে না পারে, সে জন্য পাহারা বসিয়েছেন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের কর্মীরা। এতে দু-একটি স্থান ছাড়া দেশের সব সীমান্ত দিয়ে গরু আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

গরু ব্যবসায়ীরা বলছেন, সীমান্ত এলাকাগুলোয় ভারতের ব্যবসায়ীরা গরু এনে জড়ো করেছেন। কিন্তু ভয়ে সীমান্তের কাছাকাছি আসতে পারছেন না। সীমান্তের বাসিন্দারা বলছেন, ওপারের মতো এপারেও গরু না আনার জন্য মাইকে সতর্ক করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে সমাবেশ করছে বিজিবি।

বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, গাবতলীর হাটে এখন গরুর সংখ্যা ২৫ শতাংশ কম। কোরবানির সময় পরিস্থিতি কী হবে, তা বলা মুশকিল। কারণ, দেশি গরু হাটে আসে সাধারণত কোরবানির ৮-১০ দিন আগে থেকে। দেশি গরু হাটে আসার পরই বোঝা যাবে কোরবানির পশুর হাটে গরুর দাম কেমন হবে।

তবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অজয় কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছে। কোরবানির পশুর বাজারে কোনো ঘাটতি হবে না। কারণ, এখনো কৃষকের ঘরে বিক্রির উপযোগী ৩৪ লাখ গরু-মহিষ ও ৭৯ লাখ ভেড়া-ছাগল আছে। এগুলো কোরবানির বাজারের জন্য প্রস্তুত আছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বিজিবির হিসাব অনুসারে, প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখ গরু ভারত থেকে আনা হয়। এ খাতে লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। সরকারি হিসাবে, ২০১৪ সালে গরু এসেছে ২০ লাখ ৩২ হাজার। ২০১৩ সালে আসে ২৩ লাখ ৭৪ হাজার, অর্থাৎ মাসে প্রায় ২ লাখ করে গরু এসেছে। কিন্তু এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে গরু আসা কমতে থাকে। যেখানে গত জানুয়ারিতে গরু আসে ১ লাখ, সেখানে ফেব্রুয়ারিতে আসে মাত্র ৪৮ হাজার ৪৫০টি, মার্চে আসে ৪৪ হাজার ৯৪৫টি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই মাসে ২০ হাজারের বেশি গরু আসেনি। আগস্টে প্রতিদিন মাত্র দুই হাজারের মতো গরু এসেছে। অথচ আগে প্রতিদিন গড়ে ৮-১০ হাজার করে গরু আসত সীমান্তের ওপার থেকে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সহকারী গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গরু-বাণিজ্য নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, হাতে সময় কম থাকায় উচ্চাভিলাষী কিছু করার সম্ভাবনা কম। তবে ভেতরে-ভেতরে সরকার কোনো উদ্যোগ নিলে সেটা খুব ভালো হয়। অবশ্য পশুর সংকট থাকলেও মানুষ ঠিকই বিকল্প খুঁজে নেবে।

এ বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ভারতের ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং গরু পাচার বন্ধ করতে বিএসএফের প্রধান আশিস মিত্রকে নির্দেশ দেন। এরপরই গরু নিয়ে সীমান্তে কড়াকড়ি শুরু হয়। এখন দু-একটি সীমান্ত ছাড়া অন্য সব সীমান্ত দিয়ে গরু আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, গরু নিয়ে কোনো ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটুক, সেটা কেউ প্রত্যাশা করে না। সীমান্ত অতিক্রম করে গরু না আনার জন্য সীমান্তবাসীকে সতর্ক করা হচ্ছে। এ জন্য সীমান্ত এলাকায় সাড়ে তিন হাজারের বেশি সচেতনতামূলক সমাবেশ করা হয়েছে।

বিজিবির কর্মকর্তারা বলছেন, গরু আনা-নেওয়া বন্ধ হলে সীমান্তে গুলির ঘটনাও কমে যাবে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে যেসব গুলির ঘটনা ঘটে, তার ৯০ শতাংশ ঘটনার পেছনেই থাকে গরু-বাণিজ্য। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সীমান্তে গুলিবর্ষণের ঘটনায় ২৮৮ জন নিহত হয়েছেন। ২০১৪ সালে মারা যান ৪০ জন। আর এ বছরের ছয় মাসে মারা গেছেন ২০ জন।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৫০ লাখ গরু জবাই হয়। শুধু কোরবানির ঈদেই জবাই হয় ২৫ লাখ পশু। মোট চাহিদার প্রায় অর্ধেকই আসে ভারত থেকে। কিন্তু ভারত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতির কথা বিবেচনা করে কখনো গরু রপ্তানির অনুমতি দেয়নি। এ অবস্থায় গো-মাংসের বাজার স্থিতিশীল রাখতে দেড় দশক আগে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে করিডর-ব্যবস্থা চালু করে সরকার। এ ব্যবস্থায় প্রথমে সীমান্তের ওপার থেকে আসা গরু একটি খোঁয়াড়ের মতো স্থানে জড়ো করা হয়। এরপর শুল্ক কর্মকর্তারা মালিকানাবিহীন দেখিয়ে গরুগুলোকে ‘বাজেয়াপ্ত’ ঘোষণা করেন। এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে বাজেয়াপ্ত করার জন্য কাগজে কলমে সংক্ষিপ্ত বিচার দেখানো হয়। এরপর ‘রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাজেয়াপ্ত’ গরু মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে গরু ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। বৈধভাবে এটাই গরু আনার ব্যবস্থা।

তবে ভারতের কাছে এ ব্যবস্থার কোনো স্বীকৃতি নেই। ভারত থেকে এভাবে গরু আনতে সীমান্তের রাজশাহী অঞ্চলে ১২টি, যশোরে ৯, খুলনায় ৪, সিলেট ও চট্টগ্রামে ৩টি করে মোট ৩১টি করিডর স্থাপন করা হয়েছে। দেশের কয়েকটি সীমান্ত এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে কিছু গরু ও মহিষ আসছে। সেটা অন্যান্য বছরের তুলনায় খুবই কম। ঈদের আগে সরবরাহ বাড়বে কি না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

যশোর সীমান্তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গরু না আসায় গরু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সীমান্তের লাখো মানুষ বেকার হয়ে গেছে। তাদের একটি বড় অংশ ভারত থেকে মাদক ব্যবসা ও মানব পাচারের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।

জানতে চাইলে ২৩ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত শার্শা সীমান্তের চার করিডর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার গরু আসত। এখন সেখানে দৈনিক ১০০ থেকে ১২৫টির মতো গরু আসছে। গরু ব্যবসায় ধস নামায় এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এখন ফেনসিডিল ব্যবসা, মানব পাচারসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ কাজে জড়িত হচ্ছে।

সরকার বলছে, কোরবানির পশুর বাজারে সংকট হবে না

সীমান্তের গরু ব্যবসায়ী ও বিজিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ী ও গরু আনা শ্রমিকদের দেখামাত্রই সীমান্তে গুলি করার মতো অবস্থানে রয়েছে বিএসএফ। ফলে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও রাখালেরা ভারত সীমান্তে এখন ঢুকতে সাহস দেখান না। গত ছয় মাসে গরু আনতে গিয়ে শার্শা সীমান্তের পুটখালী, রুদ্রপুর, গোগা ও অগ্রভুলোট করিডর এলাকায় বিএসএফের গুলিতে একজন নিহত এবং পাঁচ ব্যবসায়ী ও শ্রমিক আহত হয়েছেন। এ সময় সীমান্ত থেকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো এক গরু ব্যবসায়ীর লাশও উদ্ধার করা হয়।

পুটখালী করিডর দিয়ে ভারত থেকে গরু আনেন এমন একজন ব্যবসায়ী শার্শার সাতমাইল গ্রামের বাসিন্দা মাযহারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্ত পাহারার জন্য ভারতের বিএসএফ সদস্যরা সম্প্রতি দুই দেশের সীমান্ত ভাগ করা ইছামতী নদীতে স্পিডবোট নামিয়ে পাহারা দেওয়া শুরু করেছেন। নদীর আশপাশে গরু ব্যবসায়ী দেখলেই তাঁরা গুলি করছেন।

লালমনিরহাটের পাটগ্রাম পৌর সদরের ধরলা সেতু এলাকায় পাটগ্রাম কাস্টমস অফিসে ইসলামপুর শুল্ক করিডর অবস্থিত। কাস্টমস অফিসের একটি সূত্রমতে, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলার গরু ব্যবসায়ীরা ওই সীমান্ত দিয়ে আমদানি করা গরু পাটগ্রাম ইসলামপুর শুল্ক করিডরে এনে থাকেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গরু ব্যবসায়ী জানান, বিএসএফের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন আর আগের মতো গরু আসছে না।

ঠাকুরগাঁওয়ের সীমান্তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানকার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার হরিণমারি করিডরে পশু থেকে রাজস্ব আয় একেবারেই কমে গেছে।

হরিণমারি করিডরের দায়িত্বে থাকা সিপাহি দিলদার হোসেন জানান, চার-পাঁচ মাস আগে হরিণমারি করিডরে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০টি গরু-মহিষ থেকে শুল্ক আদায় করা হতো। এখন শুল্ক আদায়ের পশুর সংখ্যা কমে চার-পাঁচে দাঁড়িয়েছে।

তবে দেশের সব সীমান্ত দিয়ে গরু আসা কমলেও রাজশাহীর আটটি করিডরে গরু-মহিষ আমদানি বেড়ে গেছে। রাজশাহী কাস্টমস কমিশনারের কার্যালয়ের অধীনে ভারত থেকে গবাদিপশু আমদানির মোট আটটি করিডর রয়েছে।

রাজশাহী কাস্টমস কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই করিডরগুলো দিয়ে গত জুনে ১৮ হাজার ৮৫৮টি গরু, ১০ হাজার ৭৬৫টি মহিষ ও ৩০৬টি ভেড়া-ছাগল এসেছে। জুলাই মাসে ১৯ হাজার ৭০০ গরু ও ১১ হাজার মহিষ এসেছে।

সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ভারত থেকে গরু আসা একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ৫০ হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। গরু করিডর করার জন্য গড়ে ওঠা খাটালগুলো খালি পড়ে আছে।

সাতক্ষীরার সবচেয়ে বড় গরুর খাটাল পরিচালনাকারী সদর উপজেলার বৈকারী সীমান্তের সাতক্ষীরা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদুজ্জামান ওরফে ওসলে মেম্বার জানান, ভারত থেকে গরু আসছে না। এতে তাঁর খাটাল এলাকায় ও গরু ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত চার-পাঁচ হাজার মানুষ বেকার হয়ে বিভিন্ন স্থানে চলে যাচ্ছেন।

সাতক্ষীরার নীলডুমুর ৩৪ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক কর্নেল মোহাম্মদ খালিদ বিল ইউসুফ ও সাতক্ষীরা ৩৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মেজর নজির আহমেদ বকশী জানান, বাংলাদেশিদের সীমান্ত পেরিয়ে গরু আনতে ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে লোকজনকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, কোরবানির বাজার সামনে রেখে সরকার যদি এখনই কোনো উদ্যোগ নেয়, তাহলে এ সমস্যা থাকবে না।

(প্রতিবেদনে সহায়তা করেছেন রাজশাহীর আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, সাতক্ষীরার কল্যাণ ব্যানার্জি, যশোরের মনিরুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও থেকে মুজিবুর রহমান ও পাটগ্রাম থেকে এ বি সফিউল আলম)