Dr Khondaker Golam Moazzem on GSP

তবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এখন আর শুল্কমুক্ত সুবিধা মুখ্য নয়। পণ্যের গুণগত মান এবং দর প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে হবে। তিনি জানান, দেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি  পোশাক কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধার আওতাভুক্ত নয়।

Published in Amader Shomoy on Monday, 12 October 2015.

জিএসপি এখনই মিলছে না

শফিকুল ইসলাম জুয়েল, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে

জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমন, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষাসহ নানা খাতে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখায় জনবহুল বাংলাদেশকে ‘মডেল’ হিসেবে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে তুলে ধরছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিবাচক সব কর্মকা-গুলোও  ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নাইরোবিতে বক্তব্যের সময় বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বের ১২২টি দেশকে অগ্রাধিকার বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) দিলেও এর বাইরে রেখেছে বাংলাদেশকে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১২টি দেশের সঙ্গে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) সুবিধা ভোগের চুক্তি করলেও প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও  বাংলাদেশকে এতে সম্পৃক্ত করেনি। ফলে ৬০০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানির বাজারে এবার বড় ধরনের ধাক্কা লাগার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব অ্যাপারেল অ্যান্ড টেক্সটাইলের (ওটেক্সা) কর্মকর্তা, মার্কিন শ্রম প্রতিনিধির কার্যালয় (ইউএসটিআর) সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

সংশ্লিষ্টদের ধারণা,  যেসব  কারণে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছে এর মধ্যে অন্যতম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত ও তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বক্তব্য সম্পর্কে নেতিবাচক, আপত্তিকর ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মন্তব্য করা। এতে ওবামা প্রশাসন ও মার্কিন নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। ফলে পরিকল্পিতভাবেই আটকে রাখা হয়েছে জিএসপি সুবিধা। এতে করে প্রায় পাঁচ হাজার ধরনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির ক্ষেত্রে শুল্ক ছাড়ের সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। তাদের ধারণা, ইউক্রেন প্রশ্নে অসন্তুষ্ট মার্কিন প্রশাসন রাশিয়াকেও জিএসপি সুবিধা দেয়নি। আর বাংলাদেশের নানা পদক্ষেপে সন্তুষ্ট থাকলেও অসন্তুষ্টির ভার তাতে কমেনি।

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও বলেছেন, রাজনৈতিক কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা ফেরত দিচ্ছে না। তবে এতে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। মন্ত্রী বলেন, রানা প্লাজা ধসের কারণে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। তখন জিএসপি ফিরে পাওয়ায় ক্ষেত্রে আমাদের ১৬টি শর্ত দিয়েছিল তারা। এরই মধ্যে সব শর্তই পূরণ করেছি আমরা। এর পরও তারা বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধাবঞ্চিত রেখেছে। তোফায়েল আহমেদ বলেন, বাংলাদেশকে তারা রাশিয়ার কাতারে দাঁড় করিয়েছে। অথচ পাকিস্তানে কিছুই নেই। তার পরও তাদের জিএসপি দেয়া হয়েছে। শ্রমিক নয়, কিন্তু শ্রমিক নেতা হয়েছেন এমন ব্যক্তিরাও জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী।

অন্যদিকে, জিএসপি সুবিধা স্থগিত প্রশ্নে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্টিফেন ব্লুম বার্নিকাট গাজীপুরে দুটি গার্মেন্ট কারখানা পরিদর্শন শেষে গত ১২ আগস্ট বলেন, রাজনৈতিক কারণে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করা হয়নি। আর জিএসপি পুনর্বহালও রাজনৈতিক ইস্যুতে হবে না। আগে বাংলাদেশের গার্মেন্ট কারখানা সম্পর্কে উচ্চ ধারণা ছিল, কিন্তু রানা প্লাজা ধসের পর ধারণা নেতিবাচক হয় যুক্তরাষ্ট্রের। তবে নতুন শ্রম আইনের বিধিমালা পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত জিএসপির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নের মাধ্যমে জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়া যাবে বলে তিনি আশাবাদী। গত ৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় এমপি এ কে এম রহমতউল্লাহর প্রশ্নের জবাবে এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় প্রধানমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক ব্যতীত অন্যান্য পণ্য জিএসপি সুবিধার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশাধিকার ছিল। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানি করা পণ্যের ৯০ শতাংশের বেশি হলো টেক্সটাইল ও অ্যাপারেল পণ্য।

যেসব শর্তে আটকে যায় জিএসপি : রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশে তৈরি পোশাক ও চিংড়ি খাত এবং ইপিজেডভুক্ত শিল্প কারখানায় শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছেÑ এমন অভিযোগ করে ২০১৩ সালের ২৭ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে। জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে বিভিন্ন শর্ত সংবলিত ‘বাংলাদেশ অ্যাকশন প্ল্যান-২০১৩’ বাস্তবায়নের পরামর্শ দেয়। ওই অ্যাকশন প্ল্যানের শর্তের মধ্যে রয়েছে, পরিকল্পনায় আইনগত ও নীতিগত ব্যবস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন, রফতানিযোগ্য তৈরি পোশাক কারখানা ভবনের ফায়ার, ইলেকট্রিক্যাল ও স্ট্রাকচারাল বিষয়ক যাচাই, প্রশাসনিক পদক্ষেপ, শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার, দুটি এনজিওর কার্যক্রম পুনঃচালু করা, জনসাধারণের প্রবেশযোগ্য ডাটাবেজ প্রতিষ্ঠা, শ্রম ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন ত্বরান্বিত করা, হটলাইন প্রতিষ্ঠা করা, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নে বিশেষ  প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন, চিংড়ি সেক্টরে শ্রম অধিকার ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ রক্ষা করা। এই অ্যাকশান প্ল্যান বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন তিন দফায় (১৫ নভেম্বর ২০১৩, ১৫ এপ্রিল ২০১৪ এবং ১৬ নভেম্বর ২০১৪) ‘ইউনাইটেড  স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর)’ বরাবর পাঠায় বাংলাদেশ সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার অগ্রগতি পর্যলোচনাপূর্বক অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে চলমান কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়ার তাগিদ দেয়। কিন্তু গত ২৯ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের ১২২টি দেশের জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করলেও এ তালিকায় বাংলাদেশকে রাখা হয়নি।

জিএসপি ফেরত না পাওয়ার নেপথ্যে ৩ কারণ : সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত তিন কারণে দীর্ঘ হচ্ছে জিএসপি স্থগিতাদেশ। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমিকদের (বিশেষ করে পোশাক শিল্পের) অধিকার ও নিরাপত্তা সুরক্ষা নিশ্চিত না হওয়ার বিষয়টি। শিল্প নিরাপত্তার প্রশ্নে পোশাক শিল্প কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আরো উন্নত করা, ভবনগুলোতে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত ইস্যুতে আরো অগ্রগতি প্রয়োজনের তাগিদ অনুভব করছেন তারা। এ ছাড়া শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক প্রাপ্তির বিষয় নিয়েও রয়েছে তাদের ঘোর আপত্তি। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক পরিবেশের বিষয়টি। মার্কিন প্রশাসন ও নীতিনির্ধারকদের ধারণা, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিতর্কিত। এই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। প্রতিষ্ঠা পায়নি সবার ভোটাধিকার। এ নির্বাচনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ, পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত উপেক্ষিত হয়েছে, যা মার্কিন প্রশাসনকে ‘ছোট’ করেছে। তৃতীয় কারণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত ও তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বক্তব্য সম্পর্কে নেতিবাচক, আপত্তিকর ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মন্তব্যের বিষয়টি। সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং দেশটির নীতিনির্ধারকদের সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র চাপের মুখেও ড. ইউনূসকে  গ্রামীণ ব্যাংকে পুনর্বহাল করা হয়নি। এই তিন কারণ ছাড়াও বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নে ভিন্ন মত, ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির অভিযোগÑ এসব জিএসপি ফেরতে বাধা হিসেবে কাজ করছে।

৬০০ কোটি ডলারের বাজারে এবার ধাক্কা লাগার আশঙ্কা : যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি সুবিধা স্থগিতের আদেশ কার্যকরের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে গত ২ সেপ্টেম্বর। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে সার্বিকভাবে রফতানি আয় তেমন কমেনি। তবে এবার প্রায় ৬০০ কোটি ডলারের রফতানি বাজারে ধাক্কা তথা রফতানি কমার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ওটেক্সার সর্বশেষ তথ্য মতে, গত জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বস্ত্র ও পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ, যা গত বছর জুলাইয়ে ছিল ২০ শতাংশ। আর রফতানি উন্নয়ন বু্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, জিএসপি স্থগিত হওয়ার পর ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রথম বছরে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৫৪৯ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সমাপ্ত আগস্ট পর্যন্ত পরবর্তী এক বছরে রফতানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯৪ কোটি ৩৯ লাখ ডলার।

জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৭ জুন বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি সুবিধা স্থগিতের পর তিন দফা শুনানি হলেও বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিতের আদেশ প্রত্যাহার হয়নি। এ-সংক্রান্ত মার্কিন শ্রম প্রতিনিধির কার্যালয় ইউএসটিআরের বছরে দু’বার এ বিষয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনার কথা থাকলেও গত ডিসেম্বরের পর এখন পর্যন্ত আর কোনো শুনানি হয়নি। আগামী নভেম্বরে পরবর্তী শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যেই পরিস্থিতি যাচাইয়ে ইউএসটিআরের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসছে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিতের প্রায় একই সময় থেকে ১২২টি দেশের এ সুবিধার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়। গত দু’বছর এসব দেশের পণ্য মার্কিন বাজারে জিএসপি সুবিধা পেত না। ফলে জিএসপি স্থগিত থাকার পরও বাংলাদেশকে তেমন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হয়নি। কিন্তু গত দু’মাস থেকে জিএসপি নবায়ন সুবিধায় ওই ১২২টি দেশের পণ্য এখন বিনা শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশকে গুনতে হচ্ছে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক। ফলে জিএসপি স্থগিতের পর গত দু’বছরে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিতে কোনো প্রভাব দেখা না গেলেও এখন তা স্পষ্ট হবে। তবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এখন আর শুল্কমুক্ত সুবিধা মুখ্য নয়। পণ্যের গুণগত মান এবং দর প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে হবে। তিনি জানান, দেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি  পোশাক কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধার আওতাভুক্ত নয়।