Dr Khondaker Golam Moazzem on house rent

Published in Shokaler Khobor on Thursday, 2 July 2015.

নিয়ন্ত্রণহীন বাড়িভাড়া

এসএম আলমগীর

আইন আছে প্রয়োগ নেই, তদারককারী প্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু কোনো তদারকি নেই। আর এই সুযোগেই একেবারে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে বাড়িভাড়া। রাজধানীতে বাড়ি ও ফ্ল্যাট মালিকদের ইচ্ছামাফিক বাড়ছে বাড়িভাড়া। কোথাও বছরে একবার, কোথাও দুইবার, আবার কোথাও তিনবারও বৃদ্ধি করা হচ্ছে। অথচ বাড়িভাড়া আইনে পরিষ্কার বলা অছে-ভাড়াটিয়ার সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে দুই বছর অন্তর মাত্র ১৫ শতাংশ বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করা যাবে। কিন্তু এ আইনের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।

হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ ও বাড়িভাড়া তদারকি করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। কিন্তু সংস্থাটিও এ ব্যাপারে একেবারে উদাসীন। সদ্য সমাপ্ত ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক চেকের মাধ্যমে বাড়িভাড়া দেওয়ার বিধান করা হলেও সেটিও মানা হচ্ছে না। বাড়িভাড়া নেওয়ার সময় বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ার লিখিত চুক্তি করা বাধ্যতামূলক হলেও সেটিও মানা হচ্ছে না প্রায়ই। প্রতিবছর একবারেই ভাড়া বাড়ানো হয় সর্বনিম্ন এক হাজার টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। অভিজাত এলাকায় এই ভাড়া বৃদ্ধির হার আরও বেশি।

ইতোমধ্যে গতকাল  রাজধানীসহ সারাদেশে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের বিরোধ নিষ্পত্তিসহ বাড়িভাড়া নির্ধারণে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সরকারি কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গঠনের পর এই কমিশন এলাকাভেদে গণশুনানি করে ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণ এবং মালিক ও ভাড়াটিয়াদের বিরোধের বিষয়ে সুপারিশ দেবে। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) গোলাম রহমান সকালের খবরকে বলেন, বাড়িভাড়া আইন আছে। সেখানে বাড়ির মালিকদের সতর্ক করে অনেক কিছুই বলা আছে। এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা তদারককারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের দায়িত্ব পালনে আরও কঠোর হতে হবে।

অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বাড়িভাড়া আইনে ভাড়াটিয়াদের বেশ সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং আইন বাস্তবায়নেও বেশ কঠোরতা রয়েছে। জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের সংশোধিত বাড়িভাড়া আইন ১৯৯৭-এ বলা হয়েছে-বাড়িভাড়া নির্ধারণ হবে চলতি বাজার দরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। বাড়িভাড়া নিয়ে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটেদের মধ্যে বিবাদ ঘটলে ভাড়াটেরা রেন্ট কন্ট্রোলে গিয়ে ভাড়া জমা দিয়ে আসেন। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বাড়িভাড়া আইনে বলা হয়েছে-ভাড়াটের প্রতি নিছক বিদ্বেষবশত তাকে বাড়ি থেকে নামানো যাবে না। ভাড়াটেদের জন্য এ ধরনের আরও অনেক সুবিধা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে বাড়িভাড়া আইনে।

সাধারণত প্রতিবছরের জানুয়ারিতে সব বাড়ির মালিকই বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করেন। এছাড়া অনেক বাড়ির মালিক বছরের মাঝামাঝি সময় আরেকবার ভাড়া বৃদ্ধি করেন। এছাড়া সরকার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ালে সে সময়ও বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করেন বাড়ির মালিকরা। রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, কল্যাণপুর, মালিবাগ, মগবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সব এলাকার অনেক বাড়ির মালিক জুন মাসে বাড়িভাড়া বাড়িয়েছেন। গত জানুয়ারিতেও একদফা বাড়িভাড়া বাড়িয়েছিলেন তারা।

এমন তথ্যই জানালেন মোহাম্মদপুর শেরশাহ শূরি রোডের বাসিন্দা জুলফিকার রহমান। তিনি বলেন, গত জানুয়ারিতে আমাদের বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়িয়েছিলেন দেড় হাজার টাকা। আবার জুন মাসের ১ তারিখে জানিয়ে দেন আরেক দফা এক হাজার টাকা ভাড়া বাড়ছে, যা দিতে হবে জুলাই মাসের ভাড়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, বাড়িওয়ালার এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমি প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। কিন্তু বাড়ির মালিকের পরিষ্কার কথা-না পোষালে বাসা ছেড়ে দেন। হঠাত্ করে তো আর বাসা ছেড়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া রোজার মাস ও সামনে ঈদ থাকায় আপাতত বাড়ির মালিকের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়েছে। শুধু জুলফিকার রহমান নন, রাজধানীর প্রত্যেক ভাড়াটিয়ার একই দশা।

অথচ মানসম্মত ভাড়া সম্পর্কে বাড়িভাড়া আইন-১৯৯১-এর ১৫ (১) ধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, ভাড়ার বার্ষিক পরিমাণ ভাড়াটিয়ার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি সাপেক্ষে দুই বছর পরপর ১৫ শতাংশ হারে ভাড়া বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বাজারদর এমনকি জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টির সঙ্গেও সঙ্গতি রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রাজধানী ঢাকার কোনো বাড়ির মালিকই বাড়িভাড়ার ওই আইনের তোয়াক্কা করেন না।

জানা গেছে, রাজধানীর প্রায় দুই কোটি মানুষের মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগ ভাড়াটিয়া। আর মাত্র ৫ ভাগ বাড়ির মালিক। ঢাকা সিটি করপোরেশন শুধু হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ের মধ্যেই তার দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখছে। অঞ্চলভেদে ধারণা করে একটি ভাড়া নির্ধারণ করে সিটি করপোরেশন। তার আলোকেই ট্যাক্স আদায় করছে সংস্থাটি।

ঢাকা সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, সিটি করপোরেশন কর্তৃক নির্ধারিত গুলশান এলাকার প্রতি বর্গফুট বাড়িভাড়া ১৫ থেকে ১৮, বনানীতে ১৪ থেকে ১৬, মহাখালীতে ১১ থেকে ১২, নাখালপাড়ায় ৬ থেকে ৭, কল্যাণপুর-পল্লবীতে ৬, উত্তরাতে ৫ থেকে ৯, শান্তিবাগে ৫ থেকে ৬, নয়াপল্টনে ৯, শান্তিনগরে ৮ থেকে ৯, ঝিগাতলায় ৮ ও ধানমণ্ডিতে ১১.২৫ টাকা। কিন্তু বাড়ির মালিকরা ভাড়া আদায় করছেন এর চেয়ে ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি হারে। ধানমণ্ডি এলাকায় প্রতি বর্গফুট বাড়িভাড়া ১১ দশমিক ২৫ টাকা হলেও নেওয়া হচ্ছে ৩৩ থেকে ৬০ টাকা হারে। মোহাম্মদপুরে প্রতি বর্গফুটের জন্য ৭ দশমিক ৫০ টাকার স্থলে নেওয়া হচ্ছে ৩০-৪০ টাকা এবং মিরপুরে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ৫ টাকার জায়গায় নেওয়া হচ্ছে ২০-৩০ টাকা এবং ক্ষেত্রবিশেষে এরচেয়েও বেশি।

এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বাড়িভাড়া ঠিকমতো নেওয়া হচ্ছে কি না এটা দেখার জন্য রাজধানীর এলাকাভিত্তিক একজন করে রেন্ট কন্ট্রোলার থাকার কথা। কিন্তু সেটি চোখে পড়ে না। এ ধরনের কার্যক্রম বাড়ানো দরকার। তিনি আরও বলেন, একজন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মাসিক যে আয় তার অর্ধেকের বেশি চলে যায় বাড়িভাড়া দিতে। এসব পরিবারকে সংসার চালাতে হয় খুবই কষ্টে। সুতরাং শ্রমজীবী এসব মানুষের কথা বিবেচনায় রাখা উচিত বাড়িভাড়া বাড়ানোর সময়।

হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়সহ বাড়িভাড়া তদারক করার ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল সকালের খবরকে বলেন, সিটি করপোরেশন হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় করে থাকে। এছাড়া আইনে আমাদের তেমন কোনো কাজ নেই বাড়িভাড়ার ব্যাপারে। হাইকোর্ট কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু সেটি সিটি করপোরেশনকে নয়। তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময় নতুন করে আর হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানো হয়নি। সুতরাং নতুন করে ভাড়া বৃদ্ধির তো কোনো কারণই নেই।