উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য কাঙ্ক্ষিত সক্ষমতা – খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, কিশোর কুমার বসাক

Bangladesh: economic competitiveness desired for higher growth, writes Khondaker Golam Moazzem and Kishore Kumer Basak, published in Bonik Barta on Wednesday, 24 September 2014.

উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য কাঙ্ক্ষিত সক্ষমতা

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, কিশোর কুমার বসাক

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কি কোনো প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে আছে? কয়েক বছর ৬ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রত্যাশা পূরণ না হওয়া কি সীমিত সক্ষমতাকে ইঙ্গিত করে? সম্ভবত বিষয়টি এ রকমই। চলতি বছর বিশ্ব প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম (১৪৪ দেশের মধ্যে)। গত বছর এ অবস্থান ছিল ১১০তম (১৪৮টি দেশের মধ্যে)। বাংলাদেশ ১০০-এর নিচে অবস্থানকারী দেশের তালিকা থেকে বের হতে পারছে না। আরো স্পষ্ট করে বললে বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নয়ন খুব দৃশ্যমান নয়। প্রায়ই বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতির কথা শোনা যায়, কিন্তু সার্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জনে এর ইতিবাচক প্রভাব সামান্যই। কারণ বাংলাদেশ মৌলভিত্তির সূচকগুলোয় যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি অর্জন করতে পারছে না।

অর্থনৈতিক অগ্রগতির মৌলভিত্তির সূচকগুলোয় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়। এ সূচকগুলো হলো— প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতি, অবকাঠামোগত প্রস্তুতি, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন। প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতি, অবকাঠামোগত প্রস্তুতি, স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে নিচের সারির দেশগুলোর কাছাকাছি। এ অবস্থানগুলো হলো— যথাক্রমে ১৩১তম, ১২৭তম ও ১০২তম। তবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশের অবস্থান যথেষ্ট ভালো (৭২তম)। কিন্তু এককভাবে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চক্রে গতিবৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়।

অর্থনৈতিক উত্কর্ষ-সম্পর্কিত কোনো কোনো সূচকে বাংলাদেশ ভালো করছে। এগুলোর মধ্যে পণ্যবাজারের দক্ষতা, আর্থিক খাতের উত্কর্ষ, বাজারের আকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি মধ্যম মানের। উত্কর্ষের অন্যান্য সূচকে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে রয়েছে যেমন— প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি, উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, শ্রমবাজারের দক্ষতা ইত্যাদি। মৌলভিত্তির সূচকের দুর্বল অবস্থানের জন্য অর্থনৈতিক উত্কর্ষ-সম্পর্কিত কোনো কোনো সূচকের ভালো অবস্থান প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধিসহ কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জনে সহায়তা করতে পারছে না।

অবকাঠামোগত দুর্বলতা: অপর্যাপ্ত অবকাঠামো বাংলাদেশের অনুকূল ব্যবসায় পরিবেশের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় বলে ব্যবসায়ীরা মনে করেন। উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা বিদ্যুত্ সরবরাহের ক্ষেত্রে উন্নতিকে দুর্বল হলেও গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করছেন। তবে অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধার ক্ষেত্রে সমান অগ্রগতি প্রতিফলিত হয়নি। সড়ক যোগাযোগ খাতে সীমিত অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু রেল যোগাযোগ, আকাশপথে যোগাযোগ, বন্দরের সুবিধা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অগ্রগতি সামান্যই। সার্বিকভাবে ৭৯ শতাংশ উত্তরদাতা অবকাঠামোগত প্রস্তুতি বেশ খারাপ পর্যায়ে রয়েছে বলে মনে করেন। একই সঙ্গে শিল্প-কারখানায় অপর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ, শিল্প স্থাপনের জন্য জমি সংকট এবং জমির উচ্চমূল্য সহায়ক বিনিয়োগ পরিবেশের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখছেন।

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা: সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা ও বিভিন্ন নীতিমালা বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে উদ্যোক্তারা হতাশ। ৮৫ শতাংশের অধিক উত্তরদাতা প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন। উদ্যোক্তারা মনে করেন যে, ব্যবসায়িক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনি কাঠামো অত্যন্ত দুর্বল, সংস্কার কার্যক্রমে রয়েছে ধীরগতি এবং যথেষ্ট ফলদায়ক সরকারি ব্যয় কাঠামোর ঘাটতি রয়েছে। কয়েক বছর ধরেই প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম নিয়ে উদ্যোক্তাদের মতামত নিম্নমুখী। ৮০-৯০ শতাংশ উদ্যোক্তাই মনে করেন যে, ব্যবসায়িক প্রতিটি কাজে যেমন— কর প্রদান, আমদানি-রফতানি, গ্যাস-পানি-বিদ্যুত্ সংযোগ থেকে শুরু করে সরকারি ঠিকাদারিতে অনৈতিক লেনদেন রয়েছে এবং তা কমছে না। আর্থিক খাতের সক্ষমতা আন্তর্জাতিক মানের নয় বলে মন্তব্য করেছেন ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা। তবে আর্থিক বাজারে ভিন্ন ভিন্ন পণ্য ও সেবা নিয়ে আসছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো বলেই মনে করেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন এবং আয়-ব্যয়ের বিবরণের মান বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুর্বল।

শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা: বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা একটি প্রতিযোগীসক্ষম অর্থনীতির প্রয়োজনের নিরিখে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। উদ্যোক্তারা মনে করেন, দেশের শিক্ষিত প্রতিভাবান দক্ষ জনগোষ্ঠীর জন্য দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ করা যাচ্ছে না। ফলে তারা বিদেশে চলে যাচ্ছেন। একই রকম সংকট রয়েছে দেশে দক্ষ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীর; যাদের শিল্প, গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যাপকভাবে প্রয়োজন। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণিত-বিজ্ঞানচর্চার অভাব এবং ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা শিক্ষার অপ্রতুলতা নিয়ে মতামত দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যে ধরনের স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকে, তা নিম্নমানের বলে ৭৭ শতাংশ উত্তরদাতা মন্তব্য করেছেন। এখনো ভালো স্বাস্থ্যসেবা উঁচু শ্রেণীর নাগরিকদের কাছেই সহজলভ্য। দেশে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে— আগামী পাঁচ বছরে হূদরোগ ও ডায়বেটিসের প্রকটতা বাড়বে, যা দেশে দক্ষ জনগোষ্ঠীর প্রাপ্যতা ও ব্যবহারের সুযোগ সীমিত করবে।

বিশ্ব সক্ষমতা প্রতিবেদন থেকে প্রতীয়মান হয়, কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা সক্ষমতার একটি বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। একই চিত্র দেখা যায় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের কাছে ওঠানামা থেকে। সম্ভবত প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ক্ষেত্রে নিচের দিকে টেনে ধরছে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিকে ৬ শতাংশের বৃত্তের বাইরে নিতে হলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় দেশকে প্রথম ৮০টি দেশের মধ্যে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে বিভিন্নমুখী সংস্কারে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং তা বাস্তবায়নে কার্যকরী পদক্ষেপ দরকার।

সরকারি সেবায় সংস্কার: সরকারি সেবা প্রদানে দক্ষতা ও উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি, স্বল্পতম সময়ে আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রদান নিশ্চিত করা, আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতা দূর করা, সাপ্লাই চেইন ও বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য সহায়ক উন্নয়নে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, একই সঙ্গে সরকারি ব্যয়ের সদ্ব্যবহার এবং প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ বিশেষত বিনিয়োগ বোর্ডের পুনর্গঠন জরুরি।

প্রশাসনিক সংস্কার: সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী করা, স্বল্পতম সময়ে আইনি ও প্রশাসনিক কার্য সম্পাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি জরুরি।

করপোরেট ব্যবস্থাপনায় সংস্কার: করপোরেট ব্যবস্থাপনাকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক করা, আর্থিক প্রতিবেদন আইনের খসড়া চূড়ান্ত এবং তা বাস্তবায়ন, শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে উন্নত করার পাশাপাশি শেয়ারবাজারে আইন প্রয়োগে আরো কঠোর হওয়া জরুরি।

আর্থিক ব্যবস্থার সংস্কার: আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং এ খাতকে আরো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে দ্বৈত নীতিকাঠামো বর্জন করা, সরকারি-বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে উন্নত করে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করা জরুরি।

সামাজিক এবং পরিবেশগত সংস্কার: পরিবেশ আইনের উন্নতি সাধনসহ এর যথাযথ প্রয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

সার্বিকভাবে উদ্যোক্তারা দেশের ব্যবসায় পরিবেশ ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে আশাবাদী। তবে একটি কার্যকর প্লাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা সবাই স্বীকার করেছেন। বর্তমানে সরকারি-ব্যবসায়ী কোনো ফোরাম না থাকার কারণে ব্যবসায়ীদের সমস্যা সমাধান অনেকটা একরৈখিকভাবে সরকারি সিদ্ধান্তে বাস্তবায়নের চেষ্টা হচ্ছে। অথচ একটি কার্যকর প্লাটফর্ম যেমন— প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ‘বেটারবিজনেস ফোরাম’-এর মতো আরেকটি ফোরাম সে চাহিদা পূরণ করতে পারে। এ ধরনের প্লাটফর্মে সরকার ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে পারে। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজের কাঠামো নিয়ে আরো স্বচ্ছ ধারণা পেতে পারে।

লেখকদ্বয় যথাক্রমে অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ও সিনিয়র গবেষণা সহযোগী, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)