Dr Khondaker Golam Moazzem on labour market and industrial productivity

Published in Bonik Barta on Tuesday, 23 September 2014.

অর্থনীতিতে উন্নতি শ্রমবাজারে অবনতি

বদরুল আলম

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখন সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। অনুমান করা হচ্ছে, পাঁচ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৭-৮ শতাংশের মধ্যে থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা অন্য রকম। মোট শ্রমশক্তির অত্যন্ত ক্ষুদ্র অংশ বিধিবদ্ধ ক্ষেত্রে কাজ করে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও অন্যান্য বেসরকারি গবেষণা সংস্থার হিসাব বলছে, বর্তমানে মোট কর্মসংস্থানের ৯০ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে শ্রমবাজারের সঙ্গে যুক্ত, যেখানে কাজের নিরাপত্তা ও সিংহভাগ সুবিধা অনুপস্থিত। যদিও উন্নয়নের যথার্থ চক্র হলো— যখন একটি অর্থনীতির মাথাপিছু আয় বাড়ে, শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটে, তখন বিধিবদ্ধ কর্মসংস্থানের সুযোগও বেশি সৃষ্টি হয়।

cpd-khondaker-golam-moazzem-labour-market-industrial-productivity-bonik-barta

প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার বাড়াতে গত দুই দশকে দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র (পিআরএসপি), পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসহ রাষ্ট্রীয় যত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, ফল হয়েছে ঠিক তার উল্টো। ১৯৯৯-২০০০ সালে বাংলাদেশে মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ২৫ শতাংশ ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বা বিধিবদ্ধ ক্ষেত্রে। এখন এ হার ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। বিধিবদ্ধ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এ হার দক্ষিণ এশিয়াসহ উদীয়মান অর্থনীতির মধ্যে সবচেয়ে কম। ফলে অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও বাংলাদেশের শ্রমবাজারে ক্রমান্বয়ে কাঠামোগত অবনতি ঘটছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার যেভাবে কমছে, তাতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উন্নয়ন বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে; যা সামাজিক শৃঙ্খলায় বড় ধরনের উত্তাপ সৃষ্টি করবে।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নে এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। সরকার তার বিভিন্ন সময়ের উন্নয়ন দলিলে বিধিবদ্ধ কর্মসংস্থানের হার বাড়ানোর প্রক্ষেপণ করলেও তেমন কোনো অগ্রগতি আসেনি। যদিও বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার পদক্ষেপের সঙ্গে শ্রমবাজারের উন্নতি সম্পর্কযুক্ত। তাছাড়া দেশে নগরকেন্দ্রিক বেকারত্বের হার বাড়লে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ঝুঁকির মুখে পড়বে।

বিবিএসের শ্রম জরিপের তথ্য বলছে, ১৯৯৯-২০০০ সালে বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের হার ছিল ৭৫ শতাংশ। ২০০৫-০৬ সালে এ হার বেড়ে হয় ৭৮ শতাংশ। ২০১০ সালে তা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭ শতাংশে। আর আইএলও বলছে, বর্তমানে এ হার ৯০ শতাংশে ঠেকেছে। সংস্থাটি তাদের ‘সিকিং বেটার এমপ্লয়মেন্ট কন্ডিশনস ফর বেটার সোশিয়োইকোনমিক আউটকামস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে শ্রমবাজার একটি করুণ অধ্যায়ের দিকে এগোচ্ছে। দুই দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ৫ শতাংশ হলেও শ্রমবাজারের কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। সংস্থাটি আরো বলছে, শ্রমবাজারের এ দুর্বল অবস্থার সবচেয়ে বড় অভিঘাত এসেছে তরুণদের ওপর। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১৫ থেকে ২৫ বছরের কর্মক্ষম তরুণ যারা শ্রমবাজারের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়, তাদের এক-তৃতীয়াংশ হয় বেকার অথবা অর্ধবেকার।

দেশের শ্রমবাজারের এ বাস্তবতা নিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজার শক্তিশালী না হওয়ায় অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজার বড় হচ্ছে। আর আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজার শক্তিশালী না হওয়ার অন্যতম কারণ নিম্ন উৎপাদনশীল শিল্প খাত। তবে এর কাঠামোগত পরিবর্তনে একটি বাড়তি ব্যয় রয়েছে। এজন্য সচেতনতাও প্রয়োজন। যদি হঠাৎ করে এ পরিবর্তন করতে যাওয়া হয়, তাহলে সেবা ও শিল্প উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে, সক্ষমতা হারিয়ে খাতগুলো কিছুটা ঝুঁকির মুখে পড়বে।

আইএলওর প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক নিয়োগের বেশির ভাগই কৃষির সঙ্গে যুক্ত। মোট অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মীর প্রায় ৪০ শতাংশ এ খাতে নিযুক্ত। শিল্প খাতে যুক্ত আছে ১০ শতাংশ, সেবা খাতে ৯ দশমিক ১ এবং যোগাযোগ ও পরিবহন খাতে ৫ শতাংশ। বাকি খাতগুলোয় রয়েছে আরো এক-তৃতীয়াংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবী। আইএলও বলছে, প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবীর মজুরির মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। নির্মাণ খাতের উদাহরণ তুলে ধরে সংস্থাটি দেখিয়েছে, এ খাতের অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মী সপ্তাহে মজুরি পান গড়ে মাত্র ৯৪২ টাকা। অন্যদিকে শ্রম আইন মেনে বিধিবদ্ধভাবে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়, তারা সপ্তাহে মজুরি পান গড়ে ৭ হাজার টাকা বা তার কিছুটা বেশি। এ পার্থক্য অন্যান্য খাতেও বিদ্যমান। যেমন পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের অনানুষ্ঠানিক কর্মীদের তুলনায় আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের মজুরি ৩ দশমিক ৭ গুণ; বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি বিতরণ এবং কৃষি ও মত্স্য খাতে ৩ দশমিক ৪ গুণ।

বণিক বার্তার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত তৈরি পোশাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ও নিয়োগপত্র ছাড়া শ্রমিকের মধ্যে মজুরি প্রাপ্তির বড় ব্যবধান রয়েছে। কখনো সেটা ২৫ শতাংশ, কখনো ৫০ শতাংশ। ক্ষেত্রেবিশেষে তা কয়েক গুণও হয়। শুরুতে অধিকাংশ শ্রমিকই শ্রম আইনের সুযোগগুলো থেকে বঞ্চিত হন। প্রাতিষ্ঠানিক নিয়োগ পেতে অপেক্ষা করতে হয় সর্বনিম্ন এক বছর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার পাঁচ বছর পর্যন্তও।

এ ব্যাপারে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, তৈরি পোশাক খাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক নিয়োগ দিন দিন কমে আসছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও স্থানীয় কঠোর পর্যবেক্ষণের কারণে এ খাতে বিধিবদ্ধ নিয়ম না মেনে কারখানা পরিচালনা এখন অনেকটাই অসম্ভব। এখন পোশাক খাতে ৮০ শতাংশের বেশি শ্রমিকের নিয়োগ আনুষ্ঠানিক।