Dr Khondaker Golam Moazzem on rice import and agriculture

Published in The Daily Naya Diganta on Thursday, 8 January 2015.

ছয় মাসে ৪,৫৮,০০০ মেট্রিক টন আমদানি
চাল নিয়ে চালবাজি

জিয়াউল হক মিজান

সরকারিভাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, বিশেষ করে চাল উৎপাদনে ঘাটতি পূরণের প্রচারণা চলছে গত ছয় বছর ধরেই। প্রচারণার সমর্থনে শ্রীলঙ্কার সাথে ৫০ হাজার টন চাল রফতানির চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তির ফলস্বরূপ ইতোমধ্যে সাড়ে ১২ হাজার টন চাল রফতানিও হয়েছে। নতুন করে প্রচারণা শুরু হয়েছে ভারতের মতো রফতানিকারক দেশেও চাল রফতানির। বাস্তবতা হলো গত ছয় মাসে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে চার লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন চাল। কেবল গত নভেম্বর মাসেই আমদানি হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি ডলারের চাল। নতুন করে এলসি খোলা হয়েছে হাজার কোটি টাকার খাদ্যপণ্য আমদানির। বিশ্লেষকদের মতে, বিপুল পরিমাণ আমদানি করার পরও চাল রফতানির এমন প্রচারণায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের কয়েক কোটি কৃষক। উৎপাদনের এই ভরা মওসুমেও বাজারে চালের দাম কমছে না। অথচ কৃষক পাচ্ছে না তার ন্যায্যমূল্য। বাজার অস্থিতিশীল করে কিছু সুবিধাবাদী গোষ্ঠীকে লাভবান করে দেয়ার এ ভয়ঙ্কর প্রচারণাকে তারা দেখছেন চাল নিয়ে চালবাজি হিসেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে দেশে তিন লাখ ৭৪ হাজার টন চাল আমদানি হয়। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই আমদানি হয়েছে সাড়ে চার লাখ টনের বেশি। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আমদানি হয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৮২ শতাংশ বেশি চাল। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে যেখানে সাত কোটি ১৫ লাখ ৩০ হাজার ডলারের চাল আমদানি হয়েছিল সেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময় আমদানি হয় ১৩ কোটি টাকার চাল। আগের বছরের নভেম্বরে যেখানে এক কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার ডলারের চাল আমদানি হয়েছিল সেখানে গত নভেম্বরে আমদানি হয়েছে ছয় কোটি ৩৫ লাখ ৯০ হাজার ডলারের চাল। আমদানি বৃদ্ধির এ হার আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চার গুণেরও বেশি।

লাখ লাখ টন চাল আমদানির মধ্যেই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ থেকে ১২ হাজার ৫০০ টন চাল নিয়ে একটি জাহাজ যাত্রা করে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর উদ্দেশে। বিদায়ী বছরের জুন মাসে জরুরিভিত্তিতে চাল কিনতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠায় শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয়। গত ২২ আগস্ট লিখিতভাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চাল কেনার বিষয়টি জানায় দেশটির ঢাকাস্থ হাইকমিশন। ১১ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে শ্রীলঙ্কায় ৫০ হাজার থেকে এক লাখ মেট্রিক টন চাল রফতানি করা হবে বলে ঘোষণা দেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। সেপ্টেম্বরে শ্রীলঙ্কায় চাল রফতানির বিষয়টি নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয় অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। ৩ ডিসেম্বর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কে বাংলাদেশ সরকার এবং শ্রীলঙ্কা সরকারের মধ্যে চাল রফতানির বিষয়ে একটি চুক্তি স্বারিত হয়। প্রতি টন চালের দাম নির্ধারণ করা হয় ৪৫০ ডলার। তারই ধারাবাহিকতায় ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রথম চালান হিসেবে বাংলাদেশ থেকে ১২ হাজার ৫০০ টন চাল নিয়ে একটি জাহাজ কলম্বোর উদ্দেশে যাত্রা করে।

এ দিকে চাল রফতানি নিয়ে সরকারের কৌশল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে জানায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। সূত্র মতে, প্রথম দফায় রফতানিকৃত চাল মানসম্মত না হওয়ায় সরকারি উদ্যোগে শ্রীলঙ্কায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল রফতানি অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। অপর একটি সূত্র মতে, ভারত থেকে আরো কম দামে চাল সরবরাহের প্রস্তাব পাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে টনপ্রতি ৪৫০ ডলার মূল্যে চাল কিনতে নারাজ শ্রীলঙ্কা। এজন্য তারা বাংলাদেশ থেকে নেয়া চালের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাদের দাবি, সরবরাহকৃত চালে ৫ শতাংশের বেশি বড় ভাঙা দানা থাকতে পারবে না। ছোট ভাঙা দানা দেয়া যাবে না এক শতাংশের বেশি। তা ছাড়া কোনো মিশ্রণ ও ধান থাকতে পারবে না এ চালে। অথচ বাংলাদেশ থেকে রফতানি করা চালে রয়েছে ৮ শতাংশ বড় ভাঙা দানা এবং ৪ শতাংশ ছোট ভাঙা দানা। আর বিভিন্ন জাতের চালের মিশ্রণ রয়েছে ৮ শতাংশ। গড়ে প্রতি কেজি চালে একটি করে ধান রয়েছে বলেও জানায় বাংলাদেশ সরকার।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, শ্রীলঙ্কায় চাল রফতানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সরকার এবার ভারতে চাল রফতানির প্রচারণায় নেমেছে। গত ২৯ ডিসেম্বর চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং আইর বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বলেন, সরকার চাল রফতানি করার জন্য ভারতীয় প্রস্তাবও বিবেচনা করছে। ভারতে ৩০ হাজার টন চাল রফতানি করা হবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি। তিনি বলেন, এত দিন বাংলাদেশই ভারত থেকে চাল এনে নিজেদের চাহিদা পূরণ করত, এবার চালের উৎপাদন বেশি হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে ভারতে চাল যাবে। অথচ বাস্তবতা হলো বিদায়ী বছরে বাংলাদেশ যে ১২ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করেছে তার প্রায় পুরোটাই এসেছে ভারত থেকে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, চাল নিয়ে প্রতি বছরই যে ধূম্রজাল সৃষ্টি হচ্ছে তার প্রধান কারণ জনসংখ্যার সঠিক শুমারি না হওয়া। তিনি জানান, দেশে প্রতি বছর তিন লাখ টনের মতো চাল উৎপন্ন হয়। জনসংখ্যা ১৬ কোটি ধরে হিসাব করায় দেশের মোট চাহিদাও প্রায় সমান। অথচ গত কয়েক বছরে দেশে জনসংখ্যা অনেক বেড়েছে। বাড়তি জনসংখ্যা হিসাবে না এলেও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ প্রতি বছরই উৎপাদন বৃদ্ধির খবর দিয়ে যাচ্ছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বিভ্রান্তির। সরকারিভাবে উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদনের কথা বলা হলেও বাস্তবে এখনো প্রতি বছর ২০ থেকে ২৫ লাখ টন ঘাটতি থেকে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। দেশে বর্তমানে ১৩ লাখ টনের মতো খাদ্যশস্য মজুদ আছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

চাল রফতানি নিয়ে সরকারের এমন প্রচারণায় দেশের বাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকারের প্রচারণায় আকৃষ্ট হয়ে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে চাল আমদানি শুরু করেছেন। তা ছাড়া দাম নিয়ে বাজারে যারা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান তারাও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। ফলস্বরূপ আমরা দেখছি, একটা মওসুম পেরিয়ে গেলেও বাজারে চালের দাম কমেনি। অথচ মধ্য স্বত্বভোগীরা কৃষকদের চালের ন্যায্যমূল্য দিচ্ছেন না। কৃষকের ন্যায্যমূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক চিত্রটিই জনসমক্ষে তুলে ধরা দরকার বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনৈতিক গবেষক।