Dr Khondaker Golam Moazzem on savings and investment

সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমলেও ব্যাংকের আমানতের সুদহারের তুলনায় অনেক বেশি। এজন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। তবে মুনাফা কমায় সামনের দিনগুলোতে বিক্রি কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন। এই গবেষকের মতে, শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিনের মন্দা এবং ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমানোয় নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন সবাই।

Published in Janakantha on Wednesday, 28 October 2015.

সঞ্চয়পত্র এখনও মধ্যবিত্তের ভরসা

রহিম শেখ

রাজধানীর রামপুরা বনশ্রী এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন ফারহানা ইসলাম, স্বামী সিঙ্গাপুরে চাকরি করেন। সেখান থেকে যে টাকা পাঠান তা দিয়ে বাসা ভাড়া, ছেলের লেখাপড়া এবং অন্যান্য খরচ মিটিয়ে যা অবশিষ্ট থাকে তা সঞ্চয় করেন। জমানো সেই টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনেছেন ফারহানা। নিজের নামে কেনা পরিবার সঞ্চয়পত্রের মাসিক মুনাফা তুলতে মঙ্গলবার মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকে এসেছিলেন তিনি। ব্যস্ততার কারণে গত কয়েক মাসের মুনাফা তোলেননি। পাঁচ মাসের মুনাফা একসঙ্গে তুলে তার সঙ্গে কিছু টাকা যোগ করে আরও এক লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনলেন তিনি। সুদের হার কমানোর পরও বিনিয়োগ করছেন কেন- জানতে চাইলে এই নারী জনকণ্ঠকে বলেন, জানি, এখন মাসে একটু কম টাকা পাওয়া যায়। তাতে কী, মাস শেষে তো নিশ্চিত টাকাটা পাওয়া যাবে। কোন ঝামেলা নেই। ব্যাংকে রাখলে তো আরও কম পেতাম। পাঁচ বছর মেয়াদী এক লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনলে আগে মাসে এক হাজার ৭০ টাকা মুনাফা পাওয়া যেত, সুদের হার কমানোয় এখন পাওয়া যাচ্ছে ৯৬০ টাকা। মুনাফা কম পাওয়ায় সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কিছুটা কমেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, তিন মাসের হিসেবে কমলেও প্রতি মাসেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। অর্থবছর শেষে বিক্রিতে রেকর্ড গড়বে সঞ্চয়পত্র।

জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের মঙ্গলবার প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এ খাতে নিট বিক্রি হয়েছে ছয় হাজার ৬৯২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ১২৮ কোটি টাকা কম। গত অর্থবছরের তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মাসে সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রি আসে ছয় হাজার ৮২০ কোটি টাকা। গেল তিন মাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে পরিবার সঞ্চয়পত্র। পরিবার সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৯০৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৬০১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা এবং পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে ৭১২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। মূলত এই তিন ধরনের সঞ্চয়পত্রের বিক্রিই বেশি হয়ে থাকে। পরিসংখ্যান বলছে, গত জুলাই মাসে সঞ্চয়পত্রে বিক্রি আসে এক হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা, গত বছরের চেয়ে ১১৮ কোটি টাকা বেশি। আগস্ট মাসে সঞ্চয়পত্রে বিক্রি আসে দুই হাজার ৬৫১ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ১৮০ কোটি টাকা বেশি। একক মাস হিসেবে সেপ্টেম্বরে বিনিয়োগ আসে দুই হাজার ৬৫ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৪২৭ কোটি টাকা কম। জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে চার হাজার ৫২৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা। আর সুদ হিসাবে পরিশোধ করা হয়েছে দুই হাজার ৬২৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা। জুলাই মাসে ডাকঘরের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হয়েছে। এই সময়ে ডাকঘরের মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে তিন হাজার ৩৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে দুই হাজার ৩২৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। সঞ্চয়পত্র ব্যুরোর মাধ্যমে নিট বিনিয়োগ এসেছে ৯৭৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা।

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমলেও ব্যাংকের আমানতের সুদহারের তুলনায় অনেক বেশি। এজন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। তবে মুনাফা কমায় সামনের দিনগুলোতে বিক্রি কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন। এই গবেষকের মতে, শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিনের মন্দা এবং ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমানোয় নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন সবাই।

ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদের হার হ্রাস এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে একটু বেশি লাভের আশায় সবাই ‘নিরাপদ’ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছেন বলে মনে করেন অর্থনীতি গবেষক জায়েদ বখত। তিনি বলেন, সুদের হার কমানোর পরও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে এখনও অন্য যে কোনো স্কিম থেকে বেশি মুনাফা পাওয়া যায়, সে কারণেই বিক্রি বাড়ছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় ঋণের ভার কমাতে গত ২৩ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার প্রায় ২ শতাংশ করে কমায় সরকার। তবে ওই সময়ের আগে যারা সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন, তারা আগের সুদেই মুনাফা পাবেন বলে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর জানায়। বিক্রি ক্রমাগত বাড়তে থাকায় ঋণের বোঝা কমাতে সরকার ‘বাধ্য হয়েই’ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়েছে বলে মনে করেন জায়েদ বখত। ২৩ মে’র আগ পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদী পরিবার ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র কিনলে ১৩ দশমিক ৪৫ ও ১৩ দশমিক ২৬ শতাংশ হারে সুদ পাওয়া যেত। সুদের হার কমানোর পর এখন কেউ পাঁচ বছর মেয়াদী পারিবারিক সঞ্চয়পত্র কিনলে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ হারে সুদ পাবেন। আর পাঁচ বছর মেয়াদী পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ হয়েছে। তিন বছর মেয়াদী তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে সুদহার ঠিক করা হয়েছে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে তিন বছর মেয়াদী ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে সুদহার ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ এবং পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ করা হয়েছে। চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের।