Dr Khondaker Golam Moazzem on flat VAT rate

Published in Kaler Kantho on Monday, 15 June 2015.

ভ্যাটের ভার বাড়ল
কঠিন প্রতিযোগিতায় স্থানীয় শিল্প

ফারজানা লাবনী

একদিকে ভ্যাটের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে স্থানীয় শিল্প। অন্যদিকে সম্পূরক শুল্কে ছাড় পাচ্ছে আমদানি পণ্য। এবারের বাজেটে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অঙ্গীকার পূরণে অর্থমন্ত্রীর এমন প্রস্তাবে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশীয় শিল্প খাতগুলো।

বেঙ্গল গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপসহ এ দেশের প্লাস্টিক খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও রপ্তানি করছে। এসব প্রতিষ্ঠান চীন, তাইওয়ান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের আমদানি করা নিম্নমানের প্লাস্টিক পণ্যের সঙ্গে কঠিন প্রতিযোগিতায় টিকে আছে। অথচ প্রস্তাবিত বাজেটে প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ক্ষেত্রবিশেষ ৬০ থেকে কমিয়ে ৪৫ শতাংশ, ৪৫ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ এবং ২০ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করায় আমদানি প্লাস্টিক কম দামে দেশে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ভ্যাটের সর্বোচ্চ হার ১৫ শতাংশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত প্লাস্টিকের দাম বাড়বে, যা ক্রেতাকে বিদেশি পণ্য কিনতে বাধ্য করবে।

এ বিষয়ে বেঙ্গল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, এ দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ধনী সবাই প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারে নির্ভরশীল। স্থানীয় প্লাস্টিক শিল্প দেশের চাহিদা পূরণ করে রপ্তানিও করছে। বাজেটে প্লাস্টিক খাতে সম্পূরক শুল্ক কমানোর ফলে নিম্নমানের বিদেশি পণ্য কম দামে বাজারে বিক্রি হবে। অন্যদিকে ভ্যাট বাড়ছে। ফলে স্থানীয় প্লাস্টিক শিল্প টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রতিবছরই বাড়িয়ে চলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আর এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রতিবছরই ভ্যাটের ভার বাড়ছে। আর এই বাড়তি বোঝা একই হারে নিঃস্ব থেকে সম্পদশালী ব্যক্তির ওপর গিয়ে পড়ছে। শুধু তাই নয়, আইএমএফের ছকে প্রণীত ভ্যাট আইন ২০১২ অনুসারে ভ্যাট বা মূসক (মূল্য সংযোজন কর) আদায়ের সূত্র মানতে গিয়ে স্থানীয় শিল্পকে কঠিন প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেওয়া হলো প্রস্তাবিত বাজেটে।

আগামী অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এক লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকার উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রত্যক্ষ করে ঝুঁকলেও পরোক্ষ করের নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। প্রস্তাবিত বাজেটে আয়কর আদায়ে ৬৫ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা এবং ভ্যাট আদায়ে ৬৩ হাজার ৯০২ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। হিসাব কষে দেখা যায়, আয়কর থেকে ভ্যাট আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা মাত্র দুই হাজার ৩০ কোটি টাকা কম, যা চলতি অর্থবছরের ভ্যাট আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা বেশি। চলতি বছরেও গতবারের চেয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে মূসক আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।

বাজেটে বিশাল লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নাগরিক তথা করদাতাদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে এনবিআরকে। আয়কর সরাসরি করদাতাদের কাছ থেকে আদায় হয়। আর মূসক এক ধরনের ভোক্তা কর। উৎপাদন ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এই কর ক্রেতার কাছ থেকে আদায় করে দেয়। পরোক্ষ কর হিসেবে ভ্যাট একই হারে সব ধরনের ক্রেতাকেই বইতে হয়। রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে সহজ ও নিরাপদ হাতিয়ার হিসেবে এর প্রয়োগ নব্বই-পরবর্তী সব সরকারের আমলেই হয়েছে। আগামী অর্থবছরে শুধু এর ধারাবাহিকতাই থাকছে না, আওতাও বাড়ছে। ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরে সবার অলক্ষ্যে সাধারণ মানুষকে এই বাড়তি কর গুনতে হবে নিত্যদিনের কেনাকাটায়।

সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ভ্যাট সম্পদশালী ও দরিদ্র সবাই সমানভাবে পরিশোধে বাধ্য হয়। ভ্যাট রাজস্ব আদায়ের নিশ্চিত হাতিয়ার হওয়ায় এনবিআর এ খাত বেছে নিয়ে থাকে। খুব কৌশলে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের ওপর রাজস্বের বোঝা চাপানো হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ভ্যাট আইন ২০১২ বাস্তবায়নে আইএমএফের কাছে অঙ্গীকার করায়, সেই কথা রাখতে গিয়ে এমন সব পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে যা জনভোগান্তির। ভ্যাট বাড়াতে হচ্ছে। এতে পণ্যের দাম বাড়বে। আবার সম্পূরক শুল্ক কমিয়ে স্থানীয় শিল্প সক্ষমতা নষ্ট করা হচ্ছে। যদিও ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে অর্থমন্ত্রী ছোটখাটো কিছু বিষয় দিয়ে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। বাজেট প্রস্তাব পেশকালে অর্থমন্ত্রী বলেন, ভ্যাট আইন ২০১২ কার্যকরে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এ লক্ষ্যে সম্ভাব্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

অর্থমন্ত্রীর এ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে চলতিবারে এবং আগামী অর্থবছরে সম্পূরক শুল্ক কমানো হচ্ছে। এতে রাজস্ব আদায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা কমছে। রাজস্ব আদায় কমে গেলেও তা কয়েক গুণ বেশি আদায় করতে ভ্যাট খাতে ব্যাপক সংস্কার করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে নতুন অনেক খাত ভ্যাটের আওতায় আসছে। ট্যারিফ ভেলুতে আসছে পরিবর্তন। উপজেলা পর্যায়ের ছোট দোকানদারের জন্যও ভ্যাট বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। পণ্য বিক্রিতে একজন ক্রেতাকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। সীমিত কিছু ক্ষেত্র এ বিধানের বাইরে থাকছে।

বর্তমানে অনলাইন ক্রেতার সংখ্যা কম নয়। এ ব্যবসায় নতুন নতুন উদ্যোক্তাও যোগ হচ্ছে। নতুন বাজেটে অনলাইন পণ্য ও সেবার বিক্রয় বা সরবরাহে ৪ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এতে অনলাইনে বিক্রি করা সব পণ্যের দাম বাড়বে, যা বহন করতে হবে ক্রেতাকে।

সাজসজ্জা বা বিউটিফিকেশন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও এবারে ভ্যাটের আওতায় আনা হলো। সোনা ও রুপার ব্যবসায় ভ্যাট বাড়ল। ১৬ বর্গফুটের অধিক ভবন নির্মাণে ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ভ্যাট ৪.৫ শতাংশ হলো। এসব ক্ষেত্রেও বাড়তি দাম আসবে ক্রেতার ওপর।

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর সংকুচিত মূল্য ভিত্তিতে ১০ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হলো।

১৬ কোটি মানুষের এ দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে। মোবাইল ফোনের ওপর নজর পড়ল অর্থমন্ত্রীর। মোবাইল সিম কার্ডের মাধ্যমে প্রদত্ত সেবার ওপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে ব্যবহারকারীর ওপর।