Professor Mustafizur Rahman on civil society

Published in Manabzamin on Thursday, 9 July 2015.

বিভক্তির কবলে বিশ্বাস
সবাই বিভাজিত, দুর্ভাগ্যজনক

উৎপল রায়

শক্তিশালী সুশীলসমাজ শক্তিশালী গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ; কিন্তু বিভক্তির কারণে সুশীলসমাজ তাদের ভূমিকা পালন করতে পারছে না। মুক্তিযোদ্ধা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, গণতন্ত্র যাই বলেন, সবকিছুই মানুষের বিবেকের দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু বর্তমানের সুশীলসমাজ বা সিভিল সোসাইটি বলে যাদের অভিহিত করি তারা তাদের বিবেক দ্বারা পরিচালিত হন না। সুশীলসমাজের এ প্রতিনিধিরা ইঁদুরের মতো আচরণ করেন। একদিকে প্রবেশ করেন, অন্যদিকে খুব সতর্কতার সঙ্গে বেরিয়ে যান। রাষ্ট্রীয়ভাবেও তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। কিন্তু জনগণ যে বিশ্বাস করবে সে অনুযায়ী তারা কাজ করছেন না। তাই আমি এদের সুশীলসমাজ বলতে রাজি নই। এরা সুযোগ-সন্ধানী চরিত্র। এদের কার্যকলাপে আমি লজ্জা পাই। জনগণের আদালতে এদের বিচার হওয়া উচিত। আর না হলে ইতিহাসই এদের বিচার করবে। তিনি বলেন, দেশে এত এত সমস্যা। কিন্তু সিভিল সোসাইটি চুপ করে আছে। শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী সবাই বিভাজিত। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। কলুষিত রাজনীতির জন্য সুশীলসমাজ বিভক্ত উল্লেখ করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, কোথাও জবাবদিহিতা নেই। রাজনীতিতেও নেই। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চা, জবাবদিহিতা থাকলে আজ এ অবস্থা হতো না। রাজনীতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ আছে, সম্মান অছে। কিন্তু দুটো বড় রাজনৈতিক দল এখন রাজনীতিবিদ তৈরি করতে পারছে না। আর তৈরি হবে কীভাবে? আসমান থেকে তো রাজনীতিবিদ তৈরি হবেন না? ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে রাজনীতিবিদ তৈরি হয়। কিন্তু ডাকসুর নির্বাচন হয় না অনেক দিন। এ বিষয়ে সুশীলসমাজ কথা বলে না। ছাত্র রাজনীতি যদি না থাকে তাহলে দেশে সুষ্ঠু রাজনীতি আসবে না। এ রকম আরও অনেক বিষয় আছে। এসব বিষয়ে সুশীলসমাজের কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু তারা তা বলছে না। ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ভিন্ন মত-পথ থাকতেই পারে। কিন্তু সত্য কথা বলতে হবে। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সব পেশার মানুষকেই সহনশীল হতে হবে। অন্যের মতামতকে মর্যাদা দিতে হবে। কিন্তু সত্য কথা বলতে গেলেই সুশীলসমাজ ভয় পায়। এত ভয় কিসের তাদের? এই বিভেদ, বিভক্তি আর বিভাজনের বীজকে লুকিয়ে রেখে তো কোন লাভ নেই।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান

সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্বাধীন পর্যালোচনা, স্বাধীন মূল্যায়নের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি তথা সুশীলসমাজ অনেক অবদান রেখেছে। শক্তিশালী সুশীলসমাজ শক্তিশালী গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যে আলোকিত দর্শন প্রয়োজন তা সিভিল সোসাইটি ধারণ করে। অর্থনৈতিক, সামাজিক সব ক্ষেত্রে তাদের নীতি-দর্শন প্রয়োগ করে অনেক ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান করে। এ ছাড়া স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সরকারের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিতে পারে সিভিল সোসাইটি। কিন্তু বর্তমানে দেশের সিভিল সোসাইটির অনেক দুর্বলতা রয়েছে। ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের দেশের সিভিল সোসাইটির মধ্যে বিভাজন ও মতপার্থক্য আছে। তবে, অন্ধ আনুগত্য থেকে যদি প্রকৃত গণতান্ত্রিক চর্চার দিকে সিভিল সমাজ ধাবিত হয় তাহলেই কেবল ইতিবাচক কিছু হবে বলে আমার বিশ্বাস।

মোয়াজ্জেম হোসেন

দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বর্তমান সিভিল সোসাইটি এত বেশি বিভাজিত ও বিভক্ত হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে এখন দলীয়ভাবে সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। দলীয় ও ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার মতো মানসিকতা তাদের এখন নেই। তিনি বলেন, সুশীলসমাজের এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দেশের গুরুত্বপূর্ণ ইনস্টিটিউটগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে মেধা, দক্ষতা, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিচালিত করতে পারলে এ থেকে কিছুটা উত্তরণ ঘটানো সম্ভব।

গোলাম মোর্তোজা

সিভিল সোসাইটির বিভাজন ও বিভক্তি প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক সম্পাদক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক গোলাম মোর্তোজা বলেন, আমাদের দেশের সরকারগুলো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে অধিকাংশ সময়ই জনস্বার্থে কাজ করে না। তারা সত্যের পরিবর্তে অসত্য কথা বলে। নাগরিক সমাজের কাজ সরকারের জনস্বার্থবিরোধী কাজের প্রতিবাদ করা। অসত্যের বিপরীতে সত্য বলা। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে করা হলেই জনগণের কাছে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা পায়। কারণ, নাগরিক সমাজ বিশেষ কোন দল বা মতকে সমর্থন করেন না। তারা সব সময় সত্যের পক্ষে, জনগণের পক্ষে কথা বলেন। যে কারণে নব্বইয়ে দশক পর্যন্ত সব কটি আন্দোলনে নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি বলেন, নাগরিক সমাজ মূলত একটি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো আমাদের সমাজের সর্বত্র যে বিভাজন তৈরি হয়েছে, বর্তমান সুশীল বা নাগরিক সমাজও তার বাইরে থাকতে পারেনি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক, নাগরিক সমাজের বড় অংশটি নিজেদের আওয়ামী লীগ-বিএনপির কর্মীতে পরিণত করেছেন। এখন নাগরিক সমাজ নাম নিয়ে চলছে দলদাস বিবেকহীনদের রাজত্ব। রাজনৈতিক দলের পক্ষে তারা অবলীলায় মিথ্যা বলেন। এমনকি পদ-পদবি এবং আর্থিক সুবিধা পেয়ে, রাজনৈতিক দলের কাছে তারা নিজেদের বিবেক বিক্রি করে দিয়েছেন। এ কারণেই নাগরিক সমাজ তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তাই, জনগণ এখন আর আগের মতো তাদের কথা বিশ্বাস করে না। রাজনৈতিক নেতারা তাদের করুণা করেন, সম্মান করেন না। গোলাম মোর্তোজা আরও বলেন, ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। যেহেতু ফ্যাসিবাদী মানসিকতা নিয়ে দেশ শাসন চলছে, এর মধ্যে যারা বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়ে সত্য বলছেন, বলার চেষ্টা করছেন তাদের নানাবিধ সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এমনকি অসম্মান, চরিত্রহননের মতো কাজও চলছে তাদের বিরুদ্ধে। সংখ্যায় কম হওয়ায় তারা খুব সুবিধা করতে পারছেন না। এ ছাড়া সমূহ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য নীরব থাকার নীতিও গ্রহণ করেছেন অনেকে। এজন্যই সমাজে আজ বেশি প্রয়োজন ছিল একজন এবিএম মূসা, ফয়েজ আহমদ, ড. আহমদ শরীফ, আহমদ ছফা বা হুমায়ুন আজাদের মতো মানুষ। চরম প্রতিকূলতায় দাঁড়িয়েও যারা সত্য বলতেন।