ভারত-চীন উভয়ের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রাখতে হবে – মোস্তাফিজুর রহমান

In an interview with Shokaler Khobor, Professor Mustafizur Rahman talks about bilateral relationship with India and China, published on Saturday, 6 June 2015.

ভারত-চীন উভয়ের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রাখতে হবে : মোস্তাফিজুর রহমান

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আসন্ন বাংলাদেশ সফর নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। তার এ সফরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে কতটা লাভবান হতে পারে সে দিকটিও বিশ্লেষণ করছেন অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে সকালের খবরের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান। তার সাক্ষাত্কারের বিশেষ অংশ নিচে দেওয়া হল। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন সকালের খবরের সিনিয়র প্রতিবেদক এসএম আলমগীর।

সকালের খবর : ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক। দুই বৃহত্ প্রতিবেশী ভারত ও চীনের সঙ্গে রয়েছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কিন্তু দু’দেশই চায় বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কী কৌশল হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান : বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি হল সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা। সে ক্ষেত্রে আমরা প্রতিবেশী বন্ধু যে দেশ থেকে কম মূল্যে পণ্য পাব সে দেশ থেকেই আমদানি করব। বাংলাদেশকে ভারত বা চীনের যেকোনো দেশের একটি দেশকে নির্ধারণ করে নেওয়া ঠিক হবে না। ভারত-চীন দুটোই অর্থনৈতিকভাবে অনেক বড় শক্তিশালী দেশ। দুটি দেশের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে কাজ করতে হবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা, রফতানির সুযোগ ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ, বিনিয়োগ আকর্ষণের সম্ভাবনা-এসব বিষয়ে দুই দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রেখে কাজ করা উচিত হবে বলে আমি মনে করি।

সকালের খবর : বাংলাদেশের অধিকাংশ মেগা প্রজেক্টে চীনের আধিপত্য রয়েছে। আবার ভারত মহাসাগরের গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের কাজও করছে চীন। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র বন্দরের কাজ পেতে চাইছে ভারত-চীন উভয় দেশই। এ ধরনের বড় প্রকল্পে ভারত আধিপত্য বিস্তার করতে চাচ্ছে কি না?

প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান : একবিংশ শতাব্দীর বড় অর্থনৈতিক শক্তিশালী দুই দেশ হচ্ছে চীন ও ভারত। আর বাংলাদেশ এই দুই বৃহত্ দেশের খুবই কাছের প্রতিবেশী। এটা বাংলাদেশের জন্য খুবই ইতিবাচক একটা দিক। বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে চীন ও ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাণিজ্য সহজীকরণ-এগুলোকে যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে তাহলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব আনবে। বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের জন্য চীন হচ্ছে প্রধান বাজার। এর পরেই আছে ভারত। এই দুটি দেশ থেকে যেকোনো পণ্য কম মূল্যে আমদানি করা যায়। এর ফলে যেসব ব্যবসায়ী কাঁচামাল আমদানি করেন তারাও অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে আনতে পারবেন। ভোগ্যপণ্য যদি আমরা কম মূল্যে এই দুই দেশ থেকে আমদানি করতে পারি তাহলে সাধারণ ভোক্তারাও সুবিধা পাবেন। অন্যদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থা যদি নিবিড় করা যায় তাহলে বিশ্ববাজারে আমরা প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে পারব।

বাংলাদেশ-ভারত ও চীনের সঙ্গে নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা করতে পারলে সেটা হবে সবচেয়ে ভালো উদ্যোগ। এখন আমরা বাংলাদেশ-চায়না-ইন্ডিয়া-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের (বিসিআইএম) কথা বলছি। এই বিসিআইএম আমাদের জন্য সফল হবে কি না সেটাও অনেকটা নির্ভর করবে চীনের ইউনান প্রদেশ, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং মিয়ানমারের সঙ্গে কতটা নিবিড় বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরি করতে পারছি তার ওপর। এর জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থারও অনেক উন্নতি ঘটাতে হবে।

সকালের খবর : ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটানের সঙ্গে উপ-আঞ্চলিক করিডোর করতে হলে বাংলাদেশকে কী ধরনের কাজ করতে হবে?

প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান : ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটানের সঙ্গে উপ-আঞ্চলিক করিডোরের জন্য অবকাঠামো ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। ভারত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট চাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে কী ধরনের সার্ভিস চার্জ হবে, সেখানে বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে-সেখানে ভারত কীভাবে সহায়তা করতে পারে সেটা দেখতে হবে। ভারতে আমরা যেসব পণ্য রফতানি করি সেগুলোর মান নিয়ে ভারত প্রশ্ন তোলে। এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক যে স্ট্যান্ডার্ড রয়েছে সেগুলোকে যদি আমরা গ্রহণ করি তাহলে ভালো হয়। এর জন্যও আমরা চুক্তি করতে পারি। এর জন্য অবশ্য আমাদের বিএসটিআইকে অনেক শক্তিশালী করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভারত প্রযুক্তিগত ও কারিগরি সহায়তা দিতে পারে। এসব মিলে আমার মনে হয় আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা, বিসিআইএম ইকোনমিক করিডোর, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য-এই যে বিভিন্ন ধরনের সম্ভাবনা আছে, সেসব সম্ভাবনাকে বাংলাদেশ যদি ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারে এবং সব বিষয়ে আলাপ-আলোচনাগুলো যদি আমরা ভালোভাবে করতে পারি, কৌশল যদি সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারি তাহলে উইন-উইন ফলাফল আমরা পেতে পারি। যেটাতে সবারই লাভ হবে।

সকালের খবর : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আসন্ন বাংলাদেশ সফরে তিস্তা চুক্তি নাকি হচ্ছে না। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান : তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই অগ্রসর হতে হবে। ইতোমধ্যেই জানা গেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এবারের বাংলাদেশ সফরে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। তবে আমাদের জাতীয় একটা আকাঙ্ক্ষা এবং দাবি থাকবে তিস্তা চুক্তি যাতে হয় এবং সেটা এমনভাবে হতে হবে যাতে ন্যায্যতার ভিত্তিতে পানি বণ্টন চুক্তি হয়। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিচার-বিবেচনা থাকতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের বোঝাপড়ারও বিষয় থাকতে পারে। বাংলাদেশকে তো আলাপ-আলোচনা করতে হবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে। অন্য যেসব ক্ষেত্রে আমাদের আলোচনা হবে তার আলোকে সামগ্রিক একটা প্রেক্ষাপটে ইতিবাচক একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সেটাকে কাজে লাগিয়ে এই তিস্তা চুক্তি করা সম্ভব বলে আমার মনে হয়।

সকালের খবর : ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এই বাণিজ্য ঘাটতি দূর করার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান : বাণিজ্য ঘাটতিকে বিশ্লেষণ করতে হবে বৈশ্বিক দিক দিয়ে। বর্তমানে বৈশ্বিক বাণিজ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি বড় কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নয়। বৈশ্বিক বাণিজ্য ঘাটতি কীভাবে কমানো যায় সেদিকেই বেশি নজর দিতে হবে। কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বেশি হবে, আবার কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত হবে। আমেরিকার সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য অনেক উদ্বৃত্ত আছে। কিন্তু ভারত ও চীনের সঙ্গে অনেক বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। সুতরাং ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি থাকতেই পারে। তবে চিন্তার বিষয় হল ভারতের যে অভ্যন্তরীণ ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে, যেখানে আমাদের জন্য অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতের এই বিশাল বাজারে চীন ৭০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে। সেখানে আমরা মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলারের মতো পণ্য রফতানি করছি। সুতরাং এই জায়গায় অনেক বড় সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতে রফতানি বাড়িয়ে কীভাবে ঘাটতি কমিয়ে আনা যায় সে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।