বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় হবে – মোস্তাফিজুর রহমান

Professor Mustafizur Rahman writes on the Indian Prime Minister Narendra Modi’s visit to Bangladesh, bilateral trade and relationship, published in Samakal on Saturday, 6 June 2015.

বিশেষ লেখা
বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় হবে

ড. মোস্তাফিজুর রহমান

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সেবা খাত, যোগাযোগ_ অনেক কিছুই এর আওতায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের মধ্য দিয়ে এ সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাবে, এমন প্রত্যাশা বিভিন্ন মহলে রয়েছে। এ সময়ে নতুন কিছু চুক্তি কিংবা সমঝোতা স্মারক সই হবে। দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে যে কোনো আলোচনাতেই বাণিজ্য ঘাটতির প্রসঙ্গ উঠে আসে। ভারত বাংলাদেশকে তার অন্যতম প্রধান বাণিজ্য গন্তব্য দেশ হিসেবে গণ্য করে। বৈধ পথ ছাড়াও ভারতের বিপুল পরিমাণ পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে থাকে। বাংলাদেশ ভারত থেকে বছরে বৈধ পথেই ৬৫০ কোটি

ডলারের মতো পণ্য আমদানি করে এবং সে দেশে রফতানি করে মাত্র ৫০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য। আমাদের প্রতিবেশী এ দেশটিতে এখন অস্ত্র এবং মাদক ও তামাক জাতীয় দ্রব্য বাদে যে কোনো ধরনের পণ্য রফতানি করতে পারি। আমাদের রফতানি পণ্যে ভারতে কোনো ধরনের শুল্ক আরোপ করা হয় না। কিন্তু তারপরও বাণিজ্য ভারসাম্য বিপুলভাবেই ভারতের অনুকূলে রয়ে গেছে। এবারের শীর্ষ বৈঠকে এ ইস্যুটিও উঠবে তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ ও ভারত সার্কের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বিসিআইএম এবং বিমসটেকেরও সদস্য এ দুটি দেশ। দ্বিপক্ষীয় ছাড়াও এসব উপ-আঞ্চলিক ও আঞ্চলিক ফোরামের মাধ্যমে আমাদের সম্পর্ক আরও বিকশিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ভারত বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। এজন্য তারা বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা চাইছে। এর আগে তারা বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল, যার মধ্যে ২০ কোটি ডলার অনুদান ঘোষণা করা হয়। এ অর্থ পদ্মা সেতুতে ব্যয় হচ্ছে। বাকি ৮০ কোটি ডলারের জন্যও সুদ ধরা হয়েছে স্বল্প হারে এবং পরিশোধের মেয়াদ দীর্ঘ। ভারত আরও ২০০ কোটি ডলার ঋণ প্রদানে ইচ্ছুক, এমন খবর প্রকাশ হয়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় এ বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে। সব মিলিয়ে বলতে পারি যে, সম্পর্ক নিবিড় করার চেষ্টা দুই তরফেই রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দু’দিনের সফরে আজ শনিবার ঢাকা আসছেন।

এটা সবার জানা যে, ভারত এ অঞ্চলের বড় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে চলেছে। এশিয়ার আরেক দেশ চীন কেবল জনসংখ্যার হিসাবেই শীর্ষে নয়, তারা বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তিও। এ দুটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ এবং এ বিষয়টি আশপাশের সব দেশ তো বটেই, উন্নত বিশ্বও অবহিত। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বিশ্বে বাংলাদেশের সুন্দর ভাবমূর্তি গড়ে তোলায় আমরা এ অবস্থান কাজে লাগাতে পারি। বাংলাদেশ ট্রান্স এশীয় সড়ক ও রেলপথের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করবে বাংলাদেশ এবং এ প্রকল্প বাস্তবায়নে একাধিক বন্ধু দেশ অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা দিতে চাইছে। তবে এসব বড় বড় অবকাঠামো সুবিধা কেবল বাংলাদেশ এককভাবে ব্যবহার করলে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না। আশপাশের ছোট-বড় সব দেশের জন্যও এ সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। চীনের দক্ষিণ অংশের বিশাল ভূখণ্ড, ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশের বিভিন্ন রাজ্য, নেপাল, ভুটান_ সবাই যদি তাদের আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর এবং রেল, নৌ ও সড়ক অবকাঠামো ব্যবহার করে, তাহলে এখানে বিনিয়োগ থেকে সর্বোত্তম সুফল মিলবে। তবে এটাও মনে রাখা চাই যে, আমাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ অবকাঠামো সুবিধা এখন পর্যন্ত দুর্বল। আমাদের নিজের সীমিত অর্থনৈতিক শক্তির জন্যও সেটা অপর্যাপ্ত। আঞ্চলিক অর্থনীতির প্রয়োজনে তার ব্যবহার করতে হলে বাংলাদেশের ভেতরের অবকাঠামো ক্ষমতা অনেক উন্নত করতে হবে এবং এটা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের বড় ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি জনপ্রিয় স্লোগান হচ্ছে_ মেক ইন ইন্ডিয়া। বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক উন্নত করার ধারা বজায় থাকলে মেক ইন ইন্ডিয়া কর্মসূচির সঙ্গে বাংলাদেশও সংযুক্ত হতে পারে। বর্তমান দুনিয়ায় অর্থনীতিতে ভ্যালু চেইন জনপ্রিয় ধারণা। বাংলাদেশেও এর আওতায় ভারতের উদ্যোক্তাদের জন্য বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।

ভারত যে বাংলাদেশের পণ্য রফতানিতে ‘শূন্য শুল্ক’ সুবিধা দিয়েছে সেটা ততটা কার্যকর হতে না পারার একটি প্রধান কারণ অশুল্ক বাধা বা এনটিবি। এ বাধা দূর করায় ভারতকে আরও অনেক কিছু করতে হবে। আমাদের দুই দেশের ৯০ শতাংশ বাণিজ্য হয় স্থলপথে। কিন্তু বেনাপোল এবং অন্যান্য সীমান্ত প্রবেশপথের অবকাঠামো এখন পর্যন্ত দুর্বল রয়েছে। সড়কপথ উন্নত করা ছাড়াও সেখানে কাস্টমস এবং পণ্যের মান যাচাইসহ বিভিন্ন সুবিধা উন্নত করার আলোচনা অনেক দিন ধরেই চলছে। এবারে সফরে এ বিষয়ে পদক্ষেপের বিষয়ে আমরা একমত হতে পারব বলে আশা করছি। পণ্যের মানের বিষয়ে বাংলাদেশের সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ইতিপূর্বে বাংলাদেশকে যে ১০০ কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছে তার একটি অংশ এ কাজে ব্যবহার হয়েছে। এ ধরনের সুবিধা বাড়ানোর আলোচনা চলছে বলে জেনেছি। অশুল্ক বাধা দূর করার সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। বাণিজ্য বাড়াতে রেল ও সড়কপথের উন্নয়নও গুরুত্বপূর্ণ। ভারত থেকে নতুন যে ঋণ সহায়তা পাওয়া যেতে পারে তার প্রধান অংশ এ লক্ষ্য অর্জনে ব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা। অবকাঠামোগত আরও পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে আশুগঞ্জ থেকে কলকাতার নৌপথ। এ পথের নাব্যতা বাড়াতে ব্যাপক কর্মসূচি নিতে হবে। এর বিনিয়োগে অর্থের জোগান দিতে পারে ভারত। আশুগঞ্জ থেকে আগরতলার সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নের জন্যও পদক্ষেপ নিতে হবে। বাণিজ্য এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে কানেকটিভিটি ক্ষেত্রে মাশুল-চার্জ কী হারে নির্ধারিত হবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য কিছু কাজ ইতিমধ্যে করা আছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়াও নেপাল ও ভুটান জড়িত। ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ওই দুটি দেশের পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করবে, এমন সমঝোতা হয়েছে। তাদের পণ্য বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে গেলেও ভারতের আপত্তি নেই। এ সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক সম্পর্ক উন্নয়নেও সহায়ক হবে।

জ্বালানি ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই ফলপ্রসূ সহযোগিতা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে। ত্রিপুরার পালাটানা থেকেও বিদ্যুৎ আসবে। এ কেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশ বিপুল সহায়তা দিয়েছে। বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনেও ভারত সহায়তা দিচ্ছে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বাণিজ্য, উভয় ক্ষেত্রেই দুই দেশ সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। আমরা আশা করব যে, এবারে এ সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে আলোচনা হবে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে উদ্বৃত্ত যে জ্বালানি সম্পদ রয়েছে কিংবা যে নতুন জ্বালানি সৃষ্টি করা সম্ভব, তার অংশ বাংলাদেশ পেতে চায় এবং ভারতও সেটা দিতে পারে। এজন্য একটি আঞ্চলিক বিদ্যুৎ গ্রিড গড়ে তুলতে পারলে উভয় দেশেরই লাভ।

বাংলাদেশে এখন সীমিত পরিসরে ভারতের বিনিয়োগ রয়েছে। তবে বাংলাদেশকে প্রদত্ত শূন্য শুল্ক সুবিধার সামান্যই এখন পর্যন্ত কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে। এ সুবিধা যেমন বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের গ্রহণ করতে হবে, তেমনি ভারতেও উদ্যোক্তারা ভারতের বাজারে পণ্য রফতানির জন্য বাংলাদেশে শিল্প-বাণিজ্যের অনেক অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেন। এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরাও এ সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন। ভারত বছরে ৪৫ হাজার কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। এর মধ্যে বাংলাদেশের হিস্যা ৫০ কোটি ডলারের মতো। বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন বাড়ানো গেলেই কেবল ভারতে রফতানি বাড়তে পারে। ভারতের উদ্যোক্তারা চাইছেন বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা। সেখানে ভারতের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবেন। উৎপাদন হবে বাংলাদেশে, কিন্তু রফতানি গন্তব্য হবে ভারত কিংবা তৃতীয় কোনো দেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগেও বিনিয়োগ সম্ভব। এটাও মনে রাখতে হবে যে, বর্তমান দুনিয়া হচ্ছে প্রতিযোগিতার যুগ। এক দেশের পণ্য অন্য দেশের বাজারে প্রবেশ করতে পারে কেবল মূল্য ও মানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই। যত বন্ধু দেশই হোক, কেউ এ ক্ষেত্রে ছাড় দেবে না। পণ্য সময়মতো গন্তব্যে পেঁৗছানোও গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্য সম্পর্ক জোরালো করতে হলে এসব বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব এ বিষয়ে সচেতন বলেই আমার ধারণা। নরেন্দ্র মোদি ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব হিসেবে সুপরিচিত। এ ব্যাপারে তার অঙ্গীকার নিয়ে কোনো সংশয় নেই। দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী হলে ভূরাজনৈতিক সম্পর্কেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, সেটা তিনি উপলব্ধি করেন। উভয় দেশই শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতার পরিবেশে বসবাস করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা এমন অর্থনৈতিক সম্পর্ক চাই যাতে উভয় দেশ লাভবান হতে পারে। নরেন্দ্র মোদির এবারের সম্পর্ক এ লক্ষ্য অর্জনে মাইলফলক হয়ে থাকবে, এটাই প্রত্যাশা। ভারত আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতেও তাদের গুরুত্ব ক্রমাগত বাড়ছে। তারা বাংলাদেশকে এ অগ্রযাত্রার সঙ্গী করতে পারে। তাদের সঙ্গে চীনের ব্যাপক অর্থনৈতিক সহযোগিতা রয়েছে। আবার প্রতিযোগিতাও রয়েছে। দুই দেশের সঙ্গেই রয়েছে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আমাদের উন্নয়নে তারাও সহযোগী। আবার দুই দেশের মধ্যে একটি কার্যকর অর্থনৈতিক সেতুবন্ধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ রাখতে পারে বিপুল অবদান। এভাবে আমরা দুই দেশের আড়াইশ’ কোটিরও বেশি লোকের বিশাল বাজারে নিজেদের হিস্যা বাড়িয়ে নিতে পারব।