Professor Mustafizur Rahman on information technology

Published in Bonik Barta on Saturday, 1 August 2015.

তথ্যপ্রযুক্তি : স্বপ্ন অসীম অর্জন সামান্য

সুমন আফসার ও বদরুল আলম

২০০৭ সালে এটুআই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে শুরুটা হয়েছিল ভালোই। ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র, ই-বুক, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, ইন্টারনেট— সবশেষ থ্রিজি। তথ্যপ্রযুক্তিকে ঘিরে আমাদের অনেক স্বপ্ন। সরকারের সব উদ্যোগেই তার উপস্থিতি। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতিতে হোঁচট খাওয়ার চিত্রটি স্পষ্ট হয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) ‘মেজারিং দি ইনফরমেশন সোসাইটি ২০১৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশের অর্জন সামান্যই। এক পা এগোলে, দু পা পিছিয়ে পড়ছে।

ব্যক্তিখাতে ব্যবহার, দক্ষতা, দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা, ডিজিটাল কনটেন্টের সহজলভ্যতা ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ সরবরাহের অভাবে অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত প্রভাব রাখতে পারছে না খাতটি। এর ওপর ইন্টারনেট সেবার নিয়মিত গ্রাহকের সিংহভাগই রাজধানী ও বড় শহরকেন্দ্রিক। এখনো অভিজাত শ্রেণীর সেবা হিসেবেই মূলত পরিগণিত হচ্ছে ইন্টারনেট।

টেলিযোগাযোগ খাত বিষয়ক জাতিসংঘের সংস্থা আইটিইউর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট অবকাঠামো সম্প্রসারণ ও সেবাটি পৌঁছে দেয়ার নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও এখনো দেশের অধিকাংশ অঞ্চলই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পাচ্ছে না সেবাটি। যদিও গত কয়েক বছরে ব্যান্ডউইডথের মূল্য কমেছে। পাশাপাশি চালু হয়েছে ডাটাভিত্তিক থ্রিজি প্রযুক্তি। ‘মেজারিং দি ইনফরমেশন সোসাইটি ২০১৪’ শীর্ষক আইটিইউ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্রডব্যান্ড সেবা নিশ্চিতে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যেও অনেকখানি পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।

বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা মৌলিক প্রয়োজনীয়তা। বইয়ের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অন্বেষণের পরিধি বাড়াতে দ্রুতগতির ইন্টারনেটের কার্যকারিতা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। যদিও এক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। একই হার বাংলাদেশের তুলনায় ছোট অর্থনীতির দেশ নেপালেও। অন্যদিকে এশিয়ার মধ্যে থাইল্যান্ডের শতভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট সেবা রয়েছে। একই অবস্থা মঙ্গোলিয়ায়ও। স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে ভুটানের ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা তুলনামূলক বেশি, যা ৪৩ শতাংশ।

মাথাপিছু তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারেও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। আইটিইউর প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের মাত্র ৫ শতাংশ পরিবারে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। একই কাতারে আছে আফগানিস্তান ও মিয়ানমার। যদিও দক্ষিণ কোরিয়ায় এ হার ৯৮ শতাংশ এবং জাপান, সিঙ্গাপুর ও চীনে ৮৩-৮৬ শতাংশ।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদার এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে সরকার। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেও কাজ চলছে। এসব কার্যক্রম সম্পন্ন হলে তার সুফল পাওয়া যাবে।

তিনি বলেন, এরই মধ্যে সরকারের কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। আর এর মাধ্যমে জনসেবা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথও সুগম হয়েছে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের মতোই এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তথ্য ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সবচেয়ে বিচিত্র বলে মনে করছে আইটিইউ। সংস্থাটির মতে, এ অঞ্চলের ২৯টি দেশের মধ্যে র্যাংকিংয়ে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুর। বাংলাদেশের অবস্থান এক্ষেত্রে ২৯তম। আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে (আইডিআই) বাংলাদেশের স্কোর ১ দশমিক ৯৭। আইটিইউর গড় স্কোর যেখানে ৪ দশমিক ৫৭।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে চেষ্টা চলছে। প্রত্যাশিত গতিতে না হলেও সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রমে এর ব্যবহার বাড়ছে। প্রশাসনিক কাজে ইন্টারনেট ব্যবহারের গতি বৃদ্ধি পেলে তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে ব্যক্তিখাতেও। বর্তমানে ব্যক্তিখাতে প্রত্যাশিত মাত্রায় ইন্টারনেন্ট ব্যবহার বাড়ছে না। যদিও বিশ্বের অনেক দেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে সদস্য দেশগুলোয় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার পরিমাপ ও পরবর্তীতে তা প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করে আইটিইউ। আর দেশগুলোর সরকার, অপারেটর, গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা এ মানদণ্ড অনুযায়ী বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে নিজেদের অবস্থানের তুলনা করতে পারে। ১১টি সূচকের ভিত্তিতে প্রতিটি দেশের জন্য সামগ্রিক উন্নয়ন সূচক প্রকাশ করা হয়, যা আইসিটি উন্নয়ন সূচক (আইডিআই) নামে পরিচিত।

সূচক পরিমাপে মূলত তিনটি ক্ষেত্র বিবেচনা করা হয়েছে। এগুলো হলো— প্রবেশগম্যতা (অ্যাকসেস), ব্যবহার ও দক্ষতা। প্রবেশগম্যতা উপসূচকটি তৈরি হয়েছে আইসিটি সক্ষমতার ভিত্তিতে, যাতে প্রাধান্য পেয়েছে পাঁচটি অবকাঠামোগত সুবিধা ও প্রবেশগম্যতার বিষয়টি। ব্যবহার উপসূচকটিতে আইসিটির উপস্থিতি নির্ণয়ে তিনটি ক্ষেত্রে এর ব্যবহার পরিমাপ করা হয়েছে। আর সংশ্লিষ্ট তিনটি খাতে আইসিটি বিষয়ক দক্ষতা প্রকাশ পেয়েছে দক্ষতা উপসূচকটিতে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন সূচক বিষয়ক আইটিইউর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৬৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৫। আগের বছরের তুলনায় মাত্র এক ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। এতে বাংলাদেশের আইডিআই দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৯৭, যা আগের বছর ছিল ১ দশমিক ৯। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান ছাড়া অন্যদের চেয়ে এখনো সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে শ্রীলংকা। আগের বছরের চেয়ে তিন ধাপ পিছিয়ে গেলেও শ্রীলংকার অবস্থান ১১৬। তালিকায় ভুটান ১২৩, ভারত ১২৯, নেপাল ১৩১, পাকিস্তান ১৪২ ও আফগানিস্তান ১৫৫তম স্থানে রয়েছে। অবস্থানের উন্নয়ন হয়েছে ভুটান ও নেপালের আর অপরিবর্তিত রয়েছে ভারতের। শ্রীলংকার পাশাপাশি পাকিস্তানেরও অবস্থানের অবনমন ঘটেছে।

আইটিইউর সর্বশেষ প্রতিবেদনে তালিকার শীর্ষে রয়েছে ডেনমার্ক। এবারই দক্ষিণ কোরিয়াকে পেছনে ফেলে আইডিআই বিবেচনায় এক নম্বরে উঠে এসেছে দেশটি। দীর্ঘদিন এ তালিকার শীর্ষে থাকা দক্ষিণ কোরিয়া নেমে গেছে দ্বিতীয় স্থানে। শীর্ষে থাকা এ দেশ দুটির আইডিআই যথাক্রমে ৮ দশমিক ৮৬ ও ৮ দশমিক ৮৫। সূচকে আগের বছরের চেয়ে দুটি দেশেরই উন্নয়ন ঘটেছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ পাঁচে দক্ষিণ এশিয়া ছাড়াও রয়েছে হংকং, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুর।

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির এ সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই তা হয়নি। ফলে গত এক-দেড় বছরে বড় কোনো অগ্রগতি ঘটেনি খাতটিতে।

তিনি বলেন, জেলা পর্যায়ে থ্রিজি সেবা চালু হলেও এর মূল্য এখনো অনেকেরই সামর্থ্যের বাইরে। এছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি ঘটলেও তা চলছে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া। এসবই খাতটির অগ্রগতিতে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে সরকারি কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার যে প্রত্যাশিত মাত্রার নয়, তা উঠে এসেছে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগ পরিচালিত ‘ই-গভর্মেন্ট সার্ভে ২০১৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও। প্রতিবেদনের ই-গভর্মেন্ট ইনডেক্সে (ইজিডিআই) ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৮তম। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে দুই ধাপ।

তথ্য ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট নয় সরকারও। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ-সংক্রান্ত উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা ও মূল্যায়ন নির্দেশিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। নাগরিক ভোগান্তি দূর করাকে ক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করে সেখানে বলা হয়েছে, তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সরকারি কর্মচারী বৃদ্ধির মাধ্যমে নাগরিক সেবা সহজীকরণ ও সুশাসন সুসংহত করতে জনপ্রশাসনে উদ্ভাবন চর্চার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইতিবাচক হলেও বাংলাদেশের সরকারি দফতরগুলোয় সাফল্য সমান নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভাবন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ইনোভেশন টিমের গুরুত্বও উল্লেখ করা হয়েছে প্রকাশিত নির্দেশিকায়।

বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক অপারেটরস গ্রুপের (বিডিনগ) বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি ও অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সাবেক সহসভাপতি সুমন আহমেদ সাবির বলেন, বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব বিশ্বের অন্য অনেক দেশের চেয়ে বেশি। ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বাড়লেও তা পরিসংখ্যানে তুলনামূলক কম প্রতিফলিত হয়। তবে এ খাতে উচ্চহারের করারোপ থাকায় এখনো এটি ক্রয়ক্ষমতার বাইরেই রয়েছে অনেকের। ফলে আগ্রহ থাকলেও অনেকেই মানসম্মত ইন্টারনেট সেবা নিতে পারছে না।