Professor Mustafizur Rahman on kitchen market

দীর্ঘমেয়াদে বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নতি প্রয়োজন। দেশে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় দুর্বলতা রয়েছে। চাহিদা ও উৎপাদন বিবেচনা করে পণ্য আমদানি করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের বড় দায়িত্ব রয়েছে।

Published in Alokito Bangladesh on Saturday, 12 September 2015.

নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস
বেসামাল কাঁচাবাজার

জাহিদুল ইসলাম

একের পর এক অজুহাতে বেড়েই চলেছে নিত্যপণ্যের দাম। বেসামাল বাজারে সবজির দাম অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজির নিচে রাজধানীর বাজারে এখন আর কোনো সবজি পাওয়া যাচ্ছে না। ভর মৌসুমে ৮ টাকা দরে বিক্রি হওয়া এক কেজি আলুর দাম এখন ২৫ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি কেজি কাঁচামরিচ এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। কয়েক দফা উত্থান-পতনের পর বাজারে পেঁয়াজের কেজি এখনও ৭৫ টাকা। তিন মাস ধরে নিত্যপণ্যের বাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে চরম বেকায়দায় নির্দিষ্ট আয়ের সাধারণ ক্রেতা। নিম্ন আয়ের লোকজন এরই মধ্যে সবজি কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। মধ্যম আয়ের লোকজনও মাসের বাজারের হিসাব মেলাতে পারছেন না। অনেকেই অতীতের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন শুধু সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায়। শুক্রবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে এমনি চিত্র উঠে এসেছে।

রমজান মাসজুড়ে রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোতে বেগুনের ছিল বিশেষ কদর। ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ বেগুনির অনিবার্যতায় এর দাম ওঠানামা করছিল ৬০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে। রোজার পর বেগুনের দাম যথারীতি ৩০ থেকে ৪০ টাকায় নেমে আসার কথা ছিল। কিন্তু হয়েছে বিপরীত। বাজারে শুক্রবার প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। রমজানের চেয়েও কেজিতে ২০ টাকা বেশি এখন বেগুনের দাম। বেগুন ছাড়াও সব ধরনের সবজির দাম বাড়ছে একের পর এক অজুহাতে। দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ভারতে দাম বাড়ার অজুহাতে। সবজির দাম বাড়ানো হচ্ছে টানা বৃষ্টিতে ফসলহানি আর সরবরাহ ঘাটতির কথা বলে। ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধিতে দেখানো হচ্ছে মিলগেটে দাম বৃদ্ধির অজুহাত। ডিমের দামের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে বছরের শুরুতে তিন মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার বিষয়টি। এক কথায় কোনো না কোনো অজুহাতে বাজারে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম।

রাজধানীর সবচেয়ে বড় কাঁচাবাজার হিসেবে পরিচিত কারওয়ানবাজারে শুক্রবার প্রতি কেজি কাঁচামরিচ বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে বেশিরভাগ সবজি। শীতের আগে থেকে কাঁচাবাজার নিম্নমুখী হওয়ার কথা থাকলেও এক সপ্তাহের ব্যবধানে বন্যার অজুহাতে ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি দরে। বাজারে নতুন আসা শিম বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি দরে। এছাড়া প্রতি কেজি শালগম ৬০ থেকে ৭০ টাকা, করলা ৭০, টমেটো ১০০ থেকে ১২০, গাজর ৮০, মুলা ৫০, শসা ৭০, বরবটি ৮০ থেকে ৯০, ঢেঁড়শ ৯০ থেকে ১০০, কচুরলতি ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, রাজধানীর কাঁচাবাজারের প্রতিটি দোকানেই থরে থরে সাজানো রয়েছে সবজি। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার বাজারে ক্রেতার সংখ্যাও অনেক। তবে খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, সবজির বেচাকেনা স্বাভাবিক সময়ের অর্ধেকে নেমে এসেছে। তারা জানিয়েছেন, গরিবের অবলম্বন হিসেবে পরিচিত সবজি এখন আর গরিবের নাগালে নেই। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সামর্থ্য নেই পছন্দমতো সবজি কেনার। কারওয়ানবাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা হাবিবুর রহমান জানান, ক্রেতার সংখ্যা বাড়লেও বাজারে বেচাকেনা কমেছে। চাহিদা থাকলেও বেশি দামের কারণে অনেকেই প্রয়োজনীয় সবজি কিনতে পারছেন না। তবে সবজির দাম সহসাই কমে আসার কোনো লক্ষণ দেখছেন না ব্যবসায়ীরাও। এ বিষয়ে কারওয়ানবাজারের আড়তদার শফিকুল ইসলাম বলেন, সারা দেশে বন্যার কারণে সবজির সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। তাছাড়া সম্প্রতি গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে পরিবহন ভাড়াও। শীতের সবজি আসা শুরু হলে দাম কমে আসবে বলে আশা করেন এ ব্যবসায়ী।

তবে সরকার আন্তরিক হলে কাঁচাবাজারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সম্ভব বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি হেলাল উদ্দিন। আলোকিত বাংলাদেশকে তিনি বলেন, সবাই মিলে কাজ করলে পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি জানান, ৫০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে আধা কেজি করে সবজি কিনতে হয়। তবে বাস্তবতা হলো অধিকাংশ পরিবারের দৈনিক বাজেট থাকে ১০০ টাকার মধ্যে। তিনি মনে করেন, ভোক্তারা স্বস্তিতে নেই। সরকার অনেক ক্ষেত্রেই উন্নতি করছে। জিএসপি নিয়ে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে। এর এক শতাংশ মনযোগ দেয়া হলেও বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তবে কয়েক দিনের মধ্যেই বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল হোসেন। প্রাকৃতিক কারণে চাহিদা ও জোগানের পরিবর্তন হলে দাম কমতে ও বাড়তে পারে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলে সবজির সরবরাহ বাড়বে। তিনি বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর মোড়কজাত, টিনজাত, প্যাকেটজাত পণ্যের বাজার পর্যবেক্ষণ করে। এসব পণ্যের দাম খুব বেশি বাড়েনি বলে তিনি জানান।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, রমজানের শুরুতেই ২৮০ টাকার গরুর মাংসের দাম ওঠে ৪০০ টাকায়। রোজা শেষ হওয়ার দেড় মাসের মধ্যেও পণ্যটির দাম আর কমেনি। বাজারে খাসির মাংসের কেজি এখন ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা, তবে ব্রয়লার মুরগির দাম নেমে এসেছে ১৪০ টাকার মধ্যে। সবজি ও মাংসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাড়ছে মাছের দামও। রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। বরাবর ১২০ টাকা দরে বিক্রি হলেও তেলাপিয়ার কেজি এখন ১৬০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। চাষের কৈ বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২২০ টাকা কেজি দরে। মাঝারি আকারের ইলিশ এখন আর হালি দরে বিক্রি হয় না। ক্রেতার পকেটের অবস্থা বুঝতে পেরে বিক্রেতারা দাম হাঁকছেন পিস হিসেবে। ৮০০ গ্রাম ওজনের একটি ইলিশ এখন ১ হাজার টাকার ওপরে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, হঠাৎ বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত, সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষ বেকায়দায় পড়ছেন। সর্বোচ্চ আয়ের মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হয়তো এ কারণে কমবে না। এর বাইরে সব শ্রেণীর মানুষ আগের চেয়ে কম পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আয় সীমার নিচের দিকে থাকা অন্তত অর্ধেক মানুষ জীবনধারণের প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, বন্যার কারণে পণ্যের দাম বৃদ্ধি সাময়িক। কয়েক দিনের মধ্যে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। সরকারি চাকুরেদের নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর হলে আরেক দফা নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে পারে। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদে বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নতি প্রয়োজন। দেশে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় দুর্বলতা রয়েছে। চাহিদা ও উৎপাদন বিবেচনা করে পণ্য আমদানি করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের বড় দায়িত্ব রয়েছে।

অবশ্য সিন্ডিকেটের কারণে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে বলেও মনে করেন অনেকেই। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২২ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ১৯ লাখ টন। ভারত থেকে হয়তো ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টনের মতো পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। মাত্র ১ লাখ টনের কারণে পেঁয়াজের বাজার অস্থির হতে পারে না। প্রত্যেক ব্যবসায়ীর কাছেই পেঁয়াজ মজুদ রয়েছে। সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছেন তারা।