ট্যানারি পল্লী বাস্তবায়ন কাজ সমন্বিতভাবে হচ্ছে না – মোস্তাফিজুর রহমান

Interview with Professor Mustafizur Rahman on tanneries and leather industry, published in Shokaler Khobor on Sunday, 19 April 2015.

ট্যানারি পল্লী বাস্তবায়ন কাজ সমন্বিতভাবে হচ্ছে না

মোস্তাফিজুর রহমান

রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরের কাজ চলছে। সাভারের হেমায়েতপুরে নতুন আঙ্গিকে ট্যানারি পল্লী গড়ে তোলা হলেও এর বাস্তবায়ন কাজ সমন্বয়হীনভাবে হচ্ছে বলে মনে করছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান। সকালের খবরকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, নতুন ট্যানারি পল্লীতে ট্যানারি মালিক, শ্রমিক এবং এর সহযোগী শিল্প মালিকরাও যাতে যেতে পারে এবং সমান সুবিধা পেতে পারে সেভাবেই বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু এখন সেভাবে করা হচ্ছে না। এর ফলে ট্যানারি শিল্পের স্থানান্তর কাজ আরও বিলম্বিত হচ্ছে। এ বিষয়ে তিনি আরও অনেক কথা বলেছেন। তার সাক্ষাত্কারের বিশেষ অংশ নিচে দেওয়া হল। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন সকালের খবরের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এসএম আলমগীর।

সকালের খবর : রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে। কিন্তু ১২ বছর আগে এ প্রকল্প নেওয়া হলেও আজও স্থানান্তর কাজ সম্পন্ন হয়নি। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

মোস্তাফিজুর রহমান : ট্যানারি শিল্প বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। কিন্তু শিল্পটি পরিবেশসম্মত না হওয়ায় অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিল্পটির যেভাবে বিকাশ ঘটার দরকার ছিল সেভাবে হয়নি। অনেক সমালোচনা এবং বিদেশি ক্রেতাদের চাপে পড়ে সরকার ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরে প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু শুরু থেকেই এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরে কাজ হয়েছে। এখনও একই অবস্থা বিরাজ করছে। যদিও গত কয়েক বছরের তুলনায় ইদানীং সাভারের ট্যানারি পল্লী প্রকল্পের কাজে কিছুটা গতি এসেছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ট্যানারি পল্লী বাস্তবায়ন কাজ সমন্বিতভাবে হচ্ছে না। আমরা যতটা জানি, ট্যানারি পল্লী প্রকল্প যখন গ্রহণ করা হয় তখন এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার কথা বিবেচনা করেই প্রকল্প নেওয়া হয়। অর্থাত্ ট্যানারি মালিক, ট্যানারি শ্রমিক এবং এ খাতের সহযোগী ব্যবসায়ীদের জন্যও সেখানে জায়গা দেওয়ার কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখানে কেবল ট্যানারি মালিকদের জন্য প্লট দেওয়া হয়েছে। সুতরাং সেখানে সমন্বিতভাবে কাজ করা হচ্ছে না। যা শিল্পের স্থানান্তর কাজ আরও বাধাগ্রস্ত করবে।

সকালের খবর : শুধু ট্যানারি মালিকদের প্লট দেওয়ায় ট্যানারি শ্রমিক এবং সহযোগী শিল্প মালিকরা কী ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে বলে আপনি মনে করেন?

মোস্তাফিজুর রহমান : ট্যানারি শ্রমিক বা সহযোগী শিল্প মালিকরা কতটা ক্ষতির মুখে পড়বে তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ পুরো ট্যানারি শিল্প। কারণ ট্যানারি, ট্যানারি শ্রমিক এবং সহযোগী কেমিক্যালসহ অন্য ব্যবসায়ীরা একে অপরের পরিপূরক। ট্যানারি পল্লীতে শুধু ট্যানারি মালিকদের পুনর্বাসন করলে তো হবে না। অন্যদের কথাও বিবেচনা করতে হবে। কারণ প্রায় ৩০-৩৫ হাজার শ্রমিক কাজ করে ট্যানারি শিল্পের সঙ্গে। তারা কোথায় যাবে।

সকালের খবর : ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের জন্য সরকার ২৫০ কোটি টাকার সহায়তা তহবিল গঠন করেছে। এই টাকারও পুরোটাই দেওয়া হচ্ছে শুধু ট্যানারি মালিকদের। এ বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

মোস্তাফিজুর রহমান : ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য ট্যানারি মালিকদের অনেক অর্থ ব্যয় করতে হবে। এর জন্য সরকার যে তহবিল রেখেছে সেটার দরকার ছিল। তবে এই তহবিলের অর্থ যাতে সবাই সমানভাবে পায় সেটা নিশ্চিত করা দরকার। বিশেষ করে অনেক ট্যানারি মালিক রয়েছে যারা আর্থিকভাবে কিছুটা দুর্বল। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যেন তাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ ছাড়া ট্যানারি মালিকদের যেমন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে তেমনি শ্রমিক এবং সহযোগী ব্যবসায়ীদেরও ক্ষতিপূরণ দেওয়া দরকার।

সকালের খবর : ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরে দেরি হওয়ার কারণে পুরো ট্যানারি শিল্পে কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

মোস্তাফিজুর রহমান : সবচেয়ে বড় বিষয়, ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরে দেরি হওয়ায় বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পের বাজার হাতছাড়া হচ্ছে। আমার জানা মতে, ইউরোপের বেশ কয়েকটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগে থেকে সতর্কবার্তা দিয়ে যাচ্ছে। তারা বলেছে, পরিবেশবান্ধব ট্যানারি না হলে ইউরোপের কোনো দেশ বাংলাদেশ থেকে চামড়া নেবে না। তারা ২০১৪ সালের মধ্যে ট্যানারি সরানোর সময় বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু সে সময়ের মধ্যে করা যায়নি। এ কারণে ইইউ সময় বাড়িয়েছে আরও বছরখানেক। এই সময়ের মধ্যে ট্যানারি স্থানান্তর না হলে তারা হয়তো আর সময় দেবে না। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি বাংলাদেশের বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে সেটা হবে এ শিল্পের জন্য বিশাল আঘাত। আশা করব সরকার এবং ট্যানারি মালিকরা বিষয়টি উপলব্ধি করে দ্রুত ট্যানারি স্থানান্তর কার্যক্রম সম্পন্ন করবে।

সকালের খবর : ট্যানারি শিল্প যদি স্থানান্তর হয়ে যায় এবং সাভারে সম্পূর্ণ পরিবেশসম্মতভাবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উত্পাদন হয় তাহলে এ শিল্পের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন আপনি?

মোস্তাফিজুর রহমান : আমি তো মনে করি ট্যানারি শিল্প হতে পারে গার্মেন্ট শিল্পের মতো বাংলাদেশের আরেকটি বৃহত্ খাত। কেননা সাভারে পুরো দমে ট্যানারির কাজ শুরু হলে সেখানে এবং এই ট্যানারি পল্লীকে ঘিরে প্রচুর বিনিয়োগ হবে। লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। শুধু দেশি বিনিয়োগকারী নয়, অনেক বিদেশি বিনিয়োগও আসবে এ খাতে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, দেশের রফতানি আয়ে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় জায়গা দখল করতে পারবে চামড়া খাত। এই অপার সম্ভাবনার সুযোগ কাজে লাগাতে হলে দ্রুত ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তর করা দরকার।