Professor Mustafizur Rahman on US economy and remittance influx

Published in The Daily Janakantha on Monday, 4 August 2014.

স্থিতিশীল বিনিময় হারে অর্থনীতি সুস্থির
গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫১৫ কোটি ডলার কিনেছে

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখলেও বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে। আর এতে অর্থনীতি সুস্থির অবস্থায় রয়েছে। স্থিতিশীল বিনিময় হারের মাধ্যমে অর্থনীতির এই সুস্থির অবস্থা বজায় রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কেনা অব্যাহত রেখেছে।

গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ৫১৫ কোটি ডলার কিনেছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি।

এর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ৪৭৯ কোটি ডলার কিনে নিয়েছিল। টাকা ও ডলারের বিনিময় হার ‘স্থিতিশীল’ রাখতেই বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, গত অর্থবছরে যে পরিমাণ রফতানি আয় ও রেমিটেন্স এসেছে, সেই অনুপাতে আমদানি ব্যয় হয়নি। ফলে দেশে ডলারের মজুদ বেড়েছে। এ কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মুদ্রা বাজার থেকে ডলার কিনতে হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে তিন হাজার ৩১৮ কোটি ৫০ লাখ (৩৩ দশমিক ১৮ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে সাড়ে ১০ শতাংশ বেশি।

অন্যদিকে ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, সদ্যসমাপ্ত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রফতানি আয় হয়েছে ৩ হাজার ১৮ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি। আর প্রবাসীরা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট এক হাজার ৪২২ কোটি ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছেন।

বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে গিয়ে টাকার মান শক্তিশালী হতে থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক রফতানি ও প্রবাসী আয়ের স্বার্থে বাজার থেকে ডলার কিনে দাম ধরে রাখে।

২০১৩-১৪ অর্থবছর শেষে প্রতি ডলারের বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ৭৭ দশমিক ৬৩ টাকা। আগের অর্থবছর শেষে এই পরিমাণ ৭৭ দশমিক ৭৬ টাকা ছিল।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রবাসীরা মোট ১৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন (এক হাজার ২৪২ কোটি) ডলার রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছে, যেখানে আগের অর্থবছরে পাঠিয়েছিল ১৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণ হলো দেশের প্রধান প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত প্রভৃতি দেশ থেকে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ (রেমিটেন্স) কমে যাওয়া। তবে এ সব দেশ থেকে রেমিটেন্স কমলেও বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

মন্দার ধকল থেকে আমেরিকার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোয় সে দেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশীরা বেশি অর্থ দেশে পাঠানোয় রেমিটেন্স বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকররা।

গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৩২ কোটি ৩৩ লাখ (২ দশমিক ৩২ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি।

২০১২-১৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশীরা ১৮৬ কোটি (১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ এ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে গত কয়েক বছর ধরে যে মন্দা চলছিল তা কেটে গেছে। বেকারত্ব কমেছে। নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে অবস্থানকারী লোকজনের আয় বেড়েছে। ফলে প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও আয় বেড়েছে। তাই তারা এখন বেশি অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন।’

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখতও ছাইদুর রহমানের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের আয় বাড়ার কারণেই রেমিটেন্স বেড়েছে। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মূলত প্রবাসী শ্রমিকরা কাজ করেন। তবে বিভিন্ন সময়ে ডিভি ভিসায় যারা যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন তারাও মোটামুটি ভাল চাকরি করেন। এ ছাড়া অন্যান্য পেশায়ও সেখানে প্রবাসীরা যুক্ত আছেন।

তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে সেখানে অবস্থানরত প্রবাসীদের আয়-খরচ দুটোই বেশি। মন্দার কারণে কিছুদিন তারা বেশি অর্থ দেশে পাঠাতে পারেননি। এখন অবস্থা ভাল হওয়ায় বেশি পাঠাচ্ছেন।’

বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানও মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে চাঙা ভাব ফিরে আসায় সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বাজার স্থিতিশীল থাকার কারণেও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা দেশে বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন বলে মনে করছেন তিনি।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিভিন্ন দেশে প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশী অবস্থান করছেন। তাদের সিংহভাগই শ্রমিক, যারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে আছেন এক লাখের কিছু বেশি।

দেশভিত্তিক রেমিটেন্স তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বরাবরই সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স দেশে আসে। গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে এবার আগের অর্থবছরের চেয়ে কম রেমিটেন্স এসেছে। প্রতি বছরই সৌদি আরব থেকে রেমিটেন্স বাড়লেও গত অর্থবছরে তা কমেছে।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে ৩১১ কোটি ৮৮ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছে, যেখানে তার আগের অর্থবছরে ৩৮৩ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছিল। এ হিসাবে সৌদি আরব থেকে গত অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে ১৯ শতাংশ রেমিটেন্স কম এসেছে।

এর আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে ৩৪২ কোটি ডলার রেমিটেন্স আসে। তার আগের অর্থবছরে আসে ৩২৯ কোটি, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৬৮ কোটি এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে আসে ৩৮২ কোটি ডলার।

আকামা পরিবর্তনসহ ভিসা জটিলতার কারণে সৌদি আরব থেকে রেমিটেন্স কমেছে বলে মনে করছেন সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবে আকামা পরিবর্তনের (পেশা পরিবর্তন বা নবায়ন) জন্য সেখানকার শ্রমিকদের বেশ ভাল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। সে কারণে দেশটি থেকে গত অর্থবছরে রেমিটেন্স কম এসেছে।’

শুধু সৌদি আরব নয়, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকেও রেমিটেন্স কমেছে। এসব দেশ থেকে রেমিটেন্স প্রবাহ কমায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ রেমিটেন্স কম এসেছে। অথচ তার আগের বছরে অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরে রেমিটেন্স বেড়েছিল ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে কাতার, কুয়েত, ইরান, যুক্তরাজ্য, জাপান, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও হংকং থেকেও কম রেমিটেন্স এসেছে।

আরব আমিরাত থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে এসেছিল ২৮৩ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে এসেছে ২৬৮ কোটি ডলার। কাতার থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে এসেছিল ২৮ কোটি ডলার, গত অর্থবছরে তা কমে ২৫ কোটি ডলারে নেমে এসেছে।

কুয়েত থেকে গত অর্থবছরে এসেছে ১১১ কোটি ডলার, যেখানে আগের অর্থবছরে এসেছিল ১১৮ কোটি ডলার। ইরান থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে এসেছিল ২৬ লাখ ডলার। সেখানে গত অর্থবছরে এসেছে মাত্র ৪ লাখ ডলার। একইভাবে যুক্তরাজ্য থেকেও রেমিটেন্স প্রবাহ কমেছে। এ দেশ থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৯৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার এসেছিল। গত অর্থবছরে এসেছে ৯০ কোটি ডলার।

জাপান থেকেও প্রবাসী আয় কমেছে ৪০ লাখ ডলার, সিঙ্গাপুর থেকে ৭ কোটি ডলার, অস্ট্রেলিয়া থেকে ৬০ লাখ ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ৩০ লাখ ডলার ও হংকং থেকে ২০ লাখ ডলার কমেছে।