More on WTO MC-10 in Nairobi from CPD: Mustafizur Rahman

Published in প্রথম আলো on Wednesday, 30 December 2015

বিশ্ববাণিজ্য আলোচনা

সিপিডির আরও কিছু কথা – মোস্তাফিজুর রহমান

 

নাইরোবিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলন বিষয়ে সিপিডির আলোচনা l ছবি: সিপিডি
নাইরোবিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলন বিষয়ে সিপিডির আলোচনা l ছবি: সিপিডি

 

সম্প্রতি নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের দশম সম্মেলনের একটি মূল্যায়ন সিপিডির পক্ষ থেকে ২৩ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছিল। বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুতে সিপিডি তার গবেষণালব্ধ বক্তব্য এ ধরনের সংবাদ সম্মেলনে নিয়মিত উপস্থাপন করে থাকে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত সিপিডির মূল্যায়নের ভিত্তি ছিল নাইরোবিতে সিপিডির গবেষকদের সরকারি প্রক্রিয়ার সমান্তরালে অনুষ্ঠিত সিভিল সোসাইটি ও থিংক ট্যাংকসমূহের বিভিন্ন কার্যক্রমে ব্যাপক অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা, সম্মেলনের প্রাতিষ্ঠানিক সরকারি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় এবং সম্মেলনের ফলাফলসংবলিত নাইরোবি ঘোষণার বিচার-বিশ্লেষণ। সরকারি প্রতিনিধিদলের অন্তর্ভুক্ত না হলেও বাংলাদেশ ও অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতো একটি প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া ও ঘোষণা দলিলের পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করার দায়িত্ব ও অধিকার সিপিডির আছে।

সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ও স্বল্পোন্নত দেশসমূহের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে যে মূল্যায়ন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে কিছু সমালোচনামূলক বক্তব্য বিভিন্ন মিডিয়ায় এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন বলে মনে করি। সিপিডি তার গঠনমূলক সমালোচনার জবাবে বিভিন্ন সরকারের কাছ থেকে বিরূপ মন্তব্য শুনে অভ্যস্ত। আর বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য সিপিডির গবেষণাধর্মী পরামর্শ ও যেকোনো উন্নয়ন ইস্যুতে জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াসের প্রমাণ তার দুই দশকের কর্মকাণ্ড। তাই, এ নিবন্ধে শুধু বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নাইরোবি প্রক্রিয়া ও ঘোষণায় বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোর ওপর আলোচনা সীমিত রাখা হলো।

সিপিডি স্বল্পোন্নত দেশসমূহের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুসমূহ তুলে ধরার উদ্দেশ্যে নাইরোবিতে পাঁচটি আলোচনা অনুষ্ঠান করে এবং আরও বেশ কয়েকটি আলোচনায় অংশগ্রহণ করে, যেখানে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কর্মকর্তা ও আন্তর্জাতিক এনজিওসমূহের প্রতিনিধিরা চলমান বাণিজ্য আলোচনা সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত সিপিডির মূল্যায়ন ছিল নাইরোবির অভিজ্ঞতার আলোকে। সিপিডির মূল্যায়নে বাংলাদেশ ও স্বল্পোন্নত দেশসমূহের অর্জনের বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হয়, নাইরোবি ঘোষণার আলোকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর দাবি ও অর্জনের পার্থক্য শনাক্ত করা হয়, আগামীর সম্ভাব্য কৌশল নিয়ে মতামত উপস্থাপন করা হয়। সিপিডির মূল্যায়নে বলা হয়, স্বল্পোন্নত দেশ-সম্পর্কিত ইস্তাম্বুল ঘোষণা (২০১১) ও সর্বসম্প্রতি গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) আলোকে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের যে প্রত্যাশা ছিল, তার সঙ্গে নাইরোবিতে যে ফলাফল এসেছে, তা যথোপযুক্ত হয়নি।

নাইরোবি সম্মেলনে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের কিছু অর্জনের অন্যতম ছিল স্বল্পোন্নত দেশসমূহকে বিশেষ সুবিধা প্রদানকারী রপ্তানির উৎসবিধির (রুলস অব অরিজিন) সহজীকরণের সিদ্ধান্ত। সিপিডি তার সংবাদ সম্মেলনে এ সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছে। তবে লক্ষণীয়, এ আলোচনা জেনেভাতে একটি পরিপক্ব অবস্থাতেই আসে, যা পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে নাইরোবি ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত হয়। অপরদিকে নাইরোবি সম্মেলনের আগেই জেনেভায় অনুষ্ঠিত ট্রিপস্ কাউন্সিলে ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্যের ব্যাপারে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বিশেষ সুবিধা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত (৬ নভেম্বর ২০১৫) গৃহীত হয়। নিঃসন্দেহে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন, বিশেষত বাংলাদেশের জন্য। তবে এটিও জেনেভাতেই চূড়ান্ত হয় এবং এ কারণেই নাইরোবি ঘোষণার ২২ নম্বর ধারায় সিদ্ধান্তটিকে ‘স্বাগত’ জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশের অন্যতম স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় হিসেবে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে প্রদত্ত সেবা খাতের ছাড়বিষয়ক নাইরোবি ঘোষণা সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যখন ২০০৭ সালে জেনেভায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বেশ কিছু দেশের সহযোগিতায় ও নরওয়ের মধ্যস্থতায় সেবা খাতের ছাড়-এর আলোচনার সূত্রপাত করেন, যার ফলে পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালে এ বিষয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নাইরোবিতে কেবল ছাড়ের সময়সীমা ২০২৬ থেকে ২০৩১ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, যদিও এ ছাড় বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও চাহিদা ছিল, যা অপূর্ণ থেকে গেছে।

সিপিডি বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত বাজারসুবিধা লাভের লক্ষ্যে গবেষণা ও বিশ্লেষণধর্মী কর্মকাল ধারাবাহিকভাবে করে এসেছে, যা নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ী নেতারা বিভিন্ন বাণিজ্য আলোচনায় ব্যবহার করেছেন। শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত বাজারসুবিধা যেন বাণিজ্যিকভাবে অর্থপূর্ণ হয়, সে বিষয়ে ঘোষণাপত্রে ‘প্রতিশ্রুতি’ ব্যক্ত করা হয়েছে। অনুরূপ ভাষার ব্যবহার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হংকং (২০০৫) ও বালি (২০১৩) ঘোষণায়ও আমরা লক্ষ করেছিলাম। ঘোষণার ২৪ নম্বর ধারা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশ এ সিদ্ধান্তের আলোকে দুরূহ হবে; বরং ঘোষণায় শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত বাজার প্রবেশের সিদ্ধান্তহীনতায় আফ্রিকান দেশগুলো প্রকাশ্যে উল্লাস প্রকাশ করেছে। স্মর্তব্য যে, ২০০৮ সালের জুলাই মাসে জেনেভায় অনুষ্ঠিত মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায় বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট পণ্যতালিকা ধরে আফ্রিকার স্বল্পোন্নত দেশসমূহ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সমঝোতার কাছাকাছি উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছিল। যদিও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সেই সভা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতভিন্নতার কারণে ভেঙে যাওয়ায় এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি।

নাইরোবির আগে ২০১৩ সালে বালিতে গৃহীত ‘এলডিসি প্যাকেজ’-এ অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ইস্যুর ওপর পরবর্তী সময়ে জেনেভায় অনুষ্ঠিত আলোচনার মাধ্যমে তেমন কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়নি। যেমন শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত সিদ্ধান্তের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষি এবং এ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ও রোডম্যাপ; সেবা খাতের ক্ষেত্রে ছাড়-এর সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নের পথে উন্নত দেশসমূহে বিরাজমান প্রতিবন্ধকতাগুলোর অপসারণ বা স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য বিশেষ ও বিভাজিত সুবিধার (স্পেশাল অ্যান্ড ডিফারেন্সিয়াল ট্রিটমেন্ট) বাস্তবায়ন নিরীক্ষার জন্য যে ‘মনিটরিং মেকানিজম’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তাকে কার্যকর করার লক্ষ্যে স্বল্পোন্নত দেশের সুনির্দিষ্ট দাবি। নাইরোবিতে এ পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নির্দেশনা আছে যৎসামান্যই। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, জেনেভায় যেসব আলোচনা অসম্পূর্ণ রয়ে যায় এবং বিভিন্ন দেশের ট্রেড-নেগোশিয়েটররা যে বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি, মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সম্মিলিত চাপে সেসব বিষয়ে হয়তো কিছু ইতিবাচক ফল আসবে। মূলত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার উন্নত সদস্যদেশসমূহের বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি।

মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের পাশাপাশি মন্ত্রীরা দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও গ্রুপভিত্তিক আলোচনা করে থাকেন। তবে মূল আলোচনা হয় ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে। অভূতপূর্বভাবে এ আলোচনা এবার ছিল বিশেষ কয়েকটি দেশের (যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, ব্রাজিল ও ভারত) কুক্ষিগত। সেসব আলোচনায় এলডিসির সমন্বয়ক হিসেবে বাংলাদেশকে এলডিসি-সংক্রান্ত প্যারা ২৪-এর বাইরে আর কোনো আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, স্বাগতিক দেশ কেনিয়া বা আফ্রিকার দেশগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এর ফলে স্বল্পোন্নত দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুসমূহ জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত বাধার সৃষ্টি হয়, যার ফলে দোহা উন্নয়ন এজেন্ডার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের সম্ভাবনা বহুলাংশে অনিশ্চিত হয়ে গেছে। উপরন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বজনীন মতৈক্যের বিপরীতে সীমিত সমঝোতার (প্লুরিল্যাটারেল) পদ্ধতিটি ভবিষ্যতে প্রাধান্য পাবে বলে মনে হয়, যা বাস্তবে রূপ নিলে স্বল্পোন্নত দেশগুলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় আরও চাপে পড়বে। এসব বাস্তবতার নিরিখে ভবিষ্যতে বাণিজ্য আলোচনায় কী কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে, সে বিষয়ে সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে বিকল্প পরামর্শ ও কৌশল তুলে ধরা হয়।

নাইরোবি আলোচনা সম্পর্কে যে সংযত সমালোচনা সিপিডি করেছে, সে-সংক্রান্ত সব দায়দায়িত্ব বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধিদলকে কেন নিতে হবে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। এটি ছিল একটি বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে শক্তির ভারসাম্যের প্রকাশ। উল্লেখ্য, যেসব দেশ তুলনামূলকভাবে নাইরোবিতে বেশি অর্জন করেছে, তারাও নাইরোবি ঘোষণা নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে, যেমন ভারত। উপরন্তু সীমিত প্রাপ্তিতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ ভবিষ্যতে আমাদের অবস্থানকে কৌশলগতভাবে দুর্বল করে দেবে। আমরা যদি সবই পেয়ে থাকি, তাহলে ভবিষ্যতে দাবি করার কিছু থাকে না এবং এটা বাস্তব পরিস্থিতিরও প্রতিফলন নয়।

 

মোস্তাফিজুর রহমান: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ।