CPD study on women cited

CPD study on women cited in news reports published on Sunday, 8 March 2015.

Published in Kaler Kantho

আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ
বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে চলেছে নারী

ফারজানা লাবনী

pic-22_196168

অনেক প্রতিবন্ধকতা জয় করেই এগিয়ে চলেছে এ দেশের নারীরা। আকাশে বিমান ওড়াচ্ছে নারী। হিমালয়ের চূড়ায় উঠছে নারী; বন্দুক কাঁধে যুদ্ধেও যাচ্ছে। নারীর নিয়োগ বাড়ছে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে। ছোট-বড় ব্যবসায় নামছে নারী। শিক্ষায় বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে রপ্তানি আয়ের চাকা পর্যন্ত ঘুরাচ্ছে নারীরা। রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরতদের ৮০ শতাংশেরও বেশি নারী। আর বলা বাহুল্য, দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, জাতীয় সংসদের স্পিকার থেকে শুরু করে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলটির প্রধান পদেও রয়েছেন নারী।

তবে এ দেশে নারীর এই অগ্রযাত্রা মসৃণ নয়; অনেক বাধার পাহাড় ডিঙোতে হচ্ছে তাদের; চালাতে হচ্ছে কঠিন যুদ্ধ। ভয়কে জয় করে, বাধাকে ডিঙিয়ে, সব প্রতিবন্ধকতাকে ‘না’ বলেই নারীর পথ চলতে হচ্ছে। কেউ তার আসার বা এগোনোর পথ তৈরি করে দেয়নি। এ পর্যায়ে আসতে এবং টিকে থাকতে নারীকে সাহস দেখাতে হয়েছে।

আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও এবার ‘নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবতার উন্নয়ন’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে দিবসটি পালিত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে।

বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে চলেছে নারী

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম কালের কণ্ঠকে বলেন, নারী নিজের ও পরিবারের প্রয়োজনে শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে। গত দুই দশকে এ দেশের নারীর ঈর্ষণীয় উন্নয়ন, অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু তাদের এখনো বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। ব্যবসা, চাকরি, শিক্ষাসহ যেকোনো খাতে সুবিধা বা সফলতা পেতে পুরুষের তুলনায় নারীকে বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে। নারীর চলার পথ মসৃণ হয়নি।

বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, গত ১০ বছরে শিক্ষার সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। প্রাথমিক স্তরে ছেলে ও মেয়েদের শিক্ষার হার সমান হলেও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা মাত্র ৩ শতাংশ পিছিয়ে। তবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা ৬ শতাংশ এগিয়ে মাধ্যমিক স্তরে। পেশাগত এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও ছেলেদের চেয়ে পিছিয়ে। পেশাগত শিক্ষায় নারী ৩৮ শতাংশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় ৩৩ শতাংশ।

একসময় বাংলাদেশে শিক্ষিত নারীর চাকরি মানে ছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষিকা বা হালকা পরিশ্রমের কিছু। স্বামী-সন্তান-সংসার সামলিয়ে যদি সময় মেলে তবেই পরিবার থেকে তা করার অনুমতি জুটত। সরকারি চাকরিতে দু-চারজনকে দেখা গেলেও বেসরকারি চাকরিতে নারীর উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। অন্যদিকে নিজস্ব উদ্যোগে ব্যবসা করছে এমন নারীর দেখা মিলত কালেভদ্রে।

দিন বদলেছে। করপোরেট হাউস, মোবাইল কম্পানি, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউস, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল- কোথায় নেই নারী!

বার্জার পেইন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, আজ থেকে ১০ বছর আগেও অনেক করপোরেট হাউসে নারী কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া যেত না। আর এখন নিয়োগ পরীক্ষায় অনেক সময় নারীদের আবেদনপত্র পুরুষদের তুলনায় বেশি থাকে। নারীরা নিজেদের যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারছে বলেই করপোরেট হাউসের ছোট বড় পদে তাদের দেখা যাচ্ছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লে নারীর এগিয়ে চলার পথে প্রতিবন্ধকতা কমবে।

সরকারি চাকরিতেও নারীদের অংশগ্রহণ ধীরে হলেও বাড়ছে। সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তথ্যানুসারে, বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া সুপারিশকৃতদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ২৯তম বিসিএসে ২৮.৪৬ শতাংশ, ৩০তমতে ৩১.৪৩ শতাংশ এবং ৩৩তমতে ৩৮.২২ শতাংশ।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ আছে, অর্থনীতিতে অতিদ্রুত বিশেষ করে চাকরি, ব্যবসায় নারীর সংখ্যা বাড়ছে। মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ১৯৯৫-৯৬ সালে ১৫.৮ শতাংশ, ২০০২-০৩ সালে ২৬.১ শতাংশ, ২০০৫-০৬ সালে ২৯.২ শতাংশ এবং ২০১১-১২ সালে ৩৯.১ শতাংশ।

পরিকল্পনা কমিশনের সিনিয়র সদস্য শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০০৫ সালে সরকারি কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ২৯ শতাংশ। ২০১০ সালে এ হার বেড়ে হয়েছে ৩৬ শতাংশ। এ হার বাড়লেও আশানুরূপ নয়। উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লে কর্মক্ষেত্রেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের অংশগ্রহণ প্রায় সমান। কারণ এসব দেশে উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বেশি। উচ্চশিক্ষায় পুরুষ ও নারীর অংশগ্রহণ ভারতে ১০০ঃ৭৩, শ্রীলঙ্কায় ১০০ঃ১৯২। অথচ বাংলাদেশে এ হার এখনো ১০০ঃ৬৬। তবে প্রতিবেশী দেশ দুটির তুলনায় কম থাকলেও গত ১৫ বছরে উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ দ্বিগুণ বেড়েছে এ দেশে, জানান এ কর্মকর্তা।

পর্যাপ্ত না হলেও নারী উন্নয়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বেড়েছে। নির্যাতিত নারীদের সেবা দিতে পুলিশ আলাদা বিভাগ খুলেছে। যেখানে সব কর্মকর্তা নারী। আবার ২৮টি মন্ত্রণালয়ে নারীদের জন্য আলাদা বাজেট দেওয়া হচ্ছে। নারী উন্নয়নে সরকারি সহায়তা বাড়লেও তা আশানুরূপ নয় জানিয়ে শামসুল আলম বলেন, নারীর এগিয়ে নেওয়ার কথা বিবেচনায় রেখেই এখন উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হয়। তবে এসব পরিকল্পনায়ও কিছু সমস্যা আছে।

নারীদের নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প আরো বাড়াতে হবে, যুগোপযোগী করতে হবে। উদাহরণ দিয়ে কর্মকর্তা বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় ১৯৫টি খাতে টাকা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তার মাত্র ১৩টির সরাসরি উপকার ভোগী নারী।

নারীর উপার্জনে পরিবারে সচ্ছলতা এলেও এখনো নারী বৈষম্যের শিকার। কর্মক্ষেত্রে মজুরি কম পাচ্ছে নারী। নানা সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। এখনো এ দেশে সংসার এবং পরিবারের জন্য নারীর কাজ শ্রম হিসেবে বিবেচিত হয় না। কর্মক্ষেত্রে একই কাজ করেও একজন পুরুষের তুলনায় অনেক সময় কম মজুরি পায় নারী।

সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষণায় পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, কর্মক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর কাজে মনোযোগিতা বেশি। অথচ একজন নারী শ্রমিক যেখানে ২৭৪ টাকা পায়, সেখানে একজন পুরুষ শ্রমিক পাচ্ছে ৩৬১ টাকা।

আয়শা মেমোরিয়াম হাসপাতালের চেয়ারম্যান প্রীতি চক্রবর্তী কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন যেসব নারী প্রতিষ্ঠানের-রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আছেন, তাঁরা অনেক কষ্ট করে সেখানে পৌঁছেছেন। এসব সফল নারীদের এমন ভূমিকা রাখা উচিত যাতে অন্য নারীদের এগিয়ে চলার পথ সহজ হয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে একটি কাঠামো তৈরি করতে হবে। নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নারীদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারকে নজর দিতে হবে।

নানা রকম ব্যবসায় নারীর অংশগ্রহণ এখন চোখে পড়ার মতো। স্বাবলম্বী হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়, সংসারে সচ্ছলতার জন্য নিজের জমানো অল্প কিছু অর্থর্ নিয়েই গ্রামের অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত একজন নারী ব্যবসা শুরু করার সাহস দেখাচ্ছে।

তুলশি চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘পল্লীবধূ’র চেয়ারম্যান মনোয়ারা তালুকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গাইবান্ধার খামার পীরগাছা গ্রামের একজন সাধারণ গৃহবধূ ছিলাম। প্রথমে জমানো কিছু টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। আজকে আমার প্রতিষ্ঠানের চা অনেক দেশে রপ্তানি হচ্ছে। আমি যখন ব্যবসা শুরু করি, তখন ব্যবসার লাইসেন্স জোগাড় থেকে ব্যাংক ঋণ পেতে যে হয়রানির শিকার হয়েছি তা এখনকার নারীদের হতে হয় না। তবে প্রতিবন্ধকতা এখনো দূর হয়নি। এখনো অনেক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে নারীর কর্মদক্ষতার চেয়ে স্বামীর আয়কে গুরুত্ব দেয় বেশি।’

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রথম সহসভাপতি মনোয়ারা হাকিম আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, এসএমই থেকে বড় মাপের সব ব্যবসায় নারীরা সফলতা পাচ্ছে। তবে এখনো নারীদের প্রতিষ্ঠিত হতে পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে হচ্ছে। এখনো অনেক পরিবার মনে করে, মেয়েরা উপার্জন করলে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যাবে। স্বামী-সন্তানসহ পরিবারের প্রতি মনোযোগী থাকবে না। এসব ধারণা-বৈষম্য দূর হলে মেয়েরা আরো এগিয়ে যাবে।

দুই দশক আগেও নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার দৌড়ে পরিবারের সহায়তা পাওয়া ছিল ভাগ্যদেবীর করুণা। এখন অনেক পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। পরিবারের সদস্যরাও নারীকে আত্মনির্ভশীল হতে সাহস জুগিয়ে থাকে। একজন নারী স্বাবলম্বী হলে সংসারে সচ্ছলতা আসে।

তবে নানা ক্ষেত্রে নারীর উন্নয়ন হলেও ক্ষমতায়নে এখনো পিছিয়ে, যদিও সমাজের বিধি-নিষেধ সত্ত্বেও রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।

শহরের তুলনায় গ্রামের নারীরা সুবিধাবঞ্চিত বেশি। শিক্ষায়ও গ্রামের নারীরা পিছিয়ে। তবে এগিয়ে যাওয়ার যুদ্ধে সেখানকার নারীদের জীবনযাত্রায় এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন।

কর্মবৈচিত্র্যে গ্রামের মেয়েরা অনেক এগিয়েছে, এমন মত জানিয়ে মাইডাস ফাইন্যান্সিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রোকেয়া আফজাল রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, গ্রামের নারীদের মধ্যে কর্মবৈচিত্র্য এসেছে। গ্রামের একজন নারী স্বামীর বা পরিবারের পুরুষ সদস্যের সহযোগিতা ছাড়াই তরকারি বিক্রি করছে, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালছে, ডিম বিক্রি করছে। ছোট ব্যবসা থেকে বড় বড় ব্যবসায় অংশ নিচ্ছে। বেশির ভাগ সময় গ্রামের একাধিক নারী একসঙ্গে কাজ করে। এতে একসঙ্গে অনেক পরিবারে সচ্ছলতা আসে। পরিবারের পুরুষ সদস্যের ওপর অর্থনৈতিক চাপ কমায় নারীদের এসব কাজে তারা আপত্তি করছে না। এসব নারীকে নিয়ে কাজ করতে সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকলে গ্রামের অর্থনীতিতে অতিদ্রুত বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী কালের কণ্ঠকে বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পের কারখানায় ৮০ শতাংশের বেশি নারী কাজ করছে। তারা এখানে শুধু শ্রমিক হিসেবে নয়, কর্মকর্তা হিসেবেও সফলতা পাচ্ছে।

নারীরা এখন শুধু ছোট পরিসরে কাজ না করে কর্মসংস্থানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মী হিসেবেও যাচ্ছে। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিএমইটি সূত্র মতে, ২০১১ সালে ৩০ হাজার ৫৭৯ জন, ২০১২ সালে ৩৭ হাজার ৩০৪ জন, ২০১৩ সালে ৫৬ হাজার ৪০০ জন নারীকর্মী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। চলতি বছর জানুয়ারিতে কর্মসংস্থান হয়েছে ছয় হাজার ২২৬ এবং ফেব্রুয়ারিতে সাত হাজার ৫৩৬ জনের।

প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, নারীরা এখন পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে আসছে। বিদেশে গিয়ে কাজ করার প্রতি নারীদের আগ্রহ বেড়েছে। সরকার এ বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আশা করছি, এবারে নারীকর্মীর বিদেশ গমনের সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়বে, যা এ দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়তা করবে।


Published in The Daily Ittefaq

অর্থনীতির চাকা ঘুরাতে বিশেষ ভূমিকায় নারী

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস

রাবেয়া বেবী

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ বছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘নারীর ক্ষমতায়ন মানবতার উন্নয়ন’। ৬৮টি নারী ও মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংস্থার প্লাটফর্ম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি এবছর প্রতিপাদ্য করেছে সম্পদ-সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমতা নারীর মানবাধিকারের নিশ্চয়তা। আমাদের দেশে নারীর মানবাধিকারের নিশ্চয়তা আজও সামগ্রিকভাবে অর্জিত না হলেও তারা দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছেন। দেশের অর্থনীতির তিনটি প্রধান খাত- গার্মেন্টস শিল্প, কৃষি এবং বিদেশে শ্রমিক কাজ করে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করছে সাধারণ নারী। সহস্রাব্দের লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ যে সকল সূচকে এগিয়ে বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে, সেখানে নারী শিক্ষার অগ্রগতি বিশেষভাবে সমাদ্রিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে বাংলাদেশে পুরুষের চেয়ে নারী বেশি পরিশ্রম করছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ এক জরিপে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীর প্রতিদিন ১২.১টি কাজ জাতীয় অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না বলে প্রকাশ করে।

এবছর বেইজিং চতুর্থ বিশ্ব সম্মেলন ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনার বিশ বছর পূর্তি হবে। তাই নারীর ক্ষমতায়নে আমাদের অবস্থা বিশেষ এক গুরুত্ব বহন করে। ১৯৯৫ সালে বেইজিং কনভেনসনের যাত্রা শুরু হয়।

শ্রমশক্তি জরিপ তথ্যমতে ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী মানুষ যারা কাজ করছে, কাজ খুঁজছেন এমন অংশকেই শ্রমশক্তি হিসাবে ধরা হয়। সরকারি তথ্যানুযায়ী গত এক দশকে ১ কোটি ২০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে কৃষি, বন ও মত্স্য খাতেই যুক্ত হয়েছে ৩০ লাখ  কর্মসংস্থান। শ্রমশক্তির সংজ্ঞানুযায়ী ২৯ শতাংশ নারীই কেবল শ্রমশক্তির অংশ হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। এর বাইরে আছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীর অংশ গ্রহণ।

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীশ্রম : বিবিএস-এর জরিপে বলা হয়, নারী ঘরের বাইরে পরিশ্রমের সাথে সাথে গৃহস্থালি কাজে পুরুষের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করছে। অন্যদিকে কর্মহীন পুরুষও নারীর চেয়ে তিনগুণ কম সময় গৃহস্থালি কাজে ব্যয় করছে। শুধু তাই নয়, পুরুষ কর্মে নিয়োজিত থাকুক বা নাই থাকুক তারা সকল পর্যায়ে নারীর চেয়ে বেশি সময় অবসর ও বিনোদন সুবিধা লাভ করছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, একজন কর্মে নিয়োজিত পুরুষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্থের বিনিময়ে কাজে ৬ দশমিক ৯ ঘণ্টা ও মহিলারা ৫ দশমিক ২ ঘণ্টা ব্যয় করে। কর্মজীবী মহিলা গৃহস্থালির কাজে পুরুষের চেয়ে ৩ গুণ বেশি সময় ব্যয় করে। এ ক্ষেত্রে পুরুষ ১ দশমিক ৪ ঘণ্টা ও মহিলা ৩ দশমিক ৬ ঘণ্টা কাজ করে। কর্মজীবী পুরুষ ১ দশমিক ১ ঘণ্টা অবসর অর্থাত্ খেলাধুলা ও বিনোদনে ব্যয় করলেও একই কাজে মহিলা মাত্র শূন্য দশমিক ৮ ঘণ্টা ব্যয় করে। অন্যদিকে কর্মে নিয়োজিত নয় এমন পুরুষ অবসর ও বিনোদনে ২ দশমিক ২ ঘণ্টা ও মহিলা ১ দশমিক ৩ ঘণ্টা ব্যয় করে। কর্মে নিয়োজিত নয় এমন পুরুষের চেয়ে মহিলা ৫ গুণ বেশি গৃহস্থালি কাজে সময় ব্যয় করছে। ব্যক্তিগত পরিচর্যায়ও মহিলার চেয়ে পুরুষ ৪ ঘণ্টার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করে।

গত বছর অক্টোবরে সিপিডি নারীর গৃহকর্মে কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন নিয়ে এক গবেষণায় প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়- একজন নারীর প্রতিদিন ১২ দশমিক ১টি কাজ জাতীয় অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। পুরুষের ক্ষেত্রে যার পরিমাণ ২ দশমিক ৭টি। গবেষণা পত্রে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, জরিপ অনুসারে প্রতিস্থাপন পদ্ধতি বা কাজের দ্বারা মূল্য ব্যবহার করে দেখা যায়- নারীর কাজের যে মূল্য অন্তর্ভুক্ত হয় না তার পরিমাণ ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে জিডিপির প্রায় ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ।

গার্মেন্টস : আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে মোট ৪০ লাখ মানুষ কাজ করেন । যার ৮০ শতাংশই নারী। সে হিসাবে দাঁড়ায় ৩২ লাখের অধিক। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব মতে গত অর্থ বছরে দেশের শিল্পের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ২ হাজার ৪শ ৫০ কোটি ডলার। আর বিজেএমই ২০২১ সালের মধ্যে এই রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য মাত্রা নিধারণ করে ৫ হাজার কোটি ডলার। এই লক্ষ্য পূরণ করতে গার্মেন্টস নারী নেতৃ লাভলী বায়াস মিন বলেন, শ্রমিদের শ্রম আইন অনুযায়ী অধিকার দিতে হবে। মাতৃত্বকালীন ছুটি আর সরকার ঘোষিত নিম্নতম মজুরির নিশ্চয়তা দরকার। সহযোগিতা করে আরো এগিয়ে নিতে নারী অধিকার কর্মী আয়শা খানম তাদের নিরাপত্তার জন্য আবাসস্থল। বেতনসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং শিশুসহ কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে দিবা-যত্ন কেন্দ্রের গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, তারা আমাদের দারিদ্র্য দূর করলেও তাদের দারিদ্র্য দূর হয় না।

কৃষি : একটি কৃষি পণ্য বপন করা থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত ২২টি কাজ করা হয়। যার মধ্যে নারী কৃষক ১৮টির সাথে সরাসরি যুক্ত বলে জানান কর্মজীবী নারীর নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া রফিক।

তারপরও দেশের কৃষকের সুনির্দিষ্ট সংখ্যার তথ্য থাকলেও নারীর কোনো সংখ্যার তথ্য কৃষি সম্প্রারণ অধিদপ্তরের কাছে নেই। রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার অংশ হিসাবে প্রদত্ত ১ কোটি ৩৯ লাখ কৃষককে কার্ড বিতরণ করা হলেও কতজন নারী এ ‘কৃষক কার্ড’ পেয়েছে তা জানা যায় নি।

২০০৮ সালে বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কৃষি খাতে নিয়োজিত পুরুষের চেয়ে নারীর অবদান শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ বেশি। দেশে গত এক দশকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাড়তি শ্রমশক্তির ৫০ লাখই নারী শ্রমিক। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী। তারপরও আছে পারিশ্রমিক বৈষম্য। পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে নারী শ্রমিকরা কাজে বেশি মনোযোগী হওয়ায় এবং মজুরি কম হওয়ায় গৃহস্থরা নারী শ্রমিকের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছেন। তারপরও পুরুষ যেখানে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন, সেখানে নারী শ্রমিক বেশি কাজ করেও ৮০ থেকে ১০০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন।


Published in The Daily Janakantha

মৌলবাদ উপেক্ষা করেই এগিয়ে চলেছে নারী

এমদাদুল হক তুহিন

কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পচ্ছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী দেশে নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৬৮ লাখ। এর মধ্যে পোশাক শিল্পে কাজ করেন এমন নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৩২ লাখ। আর্থিক মানদ-ে বিবেচনা করা হয় না এমন কাজেই নারী শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সিপিডির এক গবেষণার তথ্য মতে নারীরা ঘরে কাজ করেন এমন কাজের আর্থিক মূল্য মোট দেশজ উৎপাদনের ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ। কাজের বড় অংশটিই জাতীয় আয়ের অন্তর্ভুক্তির বাইরে থেকে গেলেও নানা প্রতিকূল পরিবেশকে তুড়ি মেরে উন্নয়নের অর্ধাঙ্গীরা স্বমহিমায় এগিয়ে চলেছেন। নারীরা এখন আর শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও কাজ করছেন। অভিবাসী নারীরা বিদেশে কাজ করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন। তবে এত কিছুর পরও তারা কর্মক্ষেত্রে অবহেলিত। অর্থনৈতিক বৈষম্য ছাড়াও মানসিক ও যৌন হয়রানির স্বীকার হচ্ছেন প্রায়শই। মানুষে মানুষে সমতা এই নীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে একদল নারী নিজের সাধ্যাতীত পরিশ্রম করছেন। মৌলবাদী অপশক্তির রক্তচক্ষুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এগিয়ে চলেছেন এ দেশের নারী সমাজ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ২০১৩ সালের প্রকাশিতব্য শ্রমশক্তি জরিপ সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৬৮ লাখ নারী কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত আছেন। বিবিএস পরিচালিত ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায় দেশে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত ছিলেন। আর ২০০৬ সালে ওই সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৩ লাখ। মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে প্রায় ৪৯ লাখ নারী শ্রমবাজারে প্রবেশ করে, যা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে কর্মক্ষেত্রে ক্রমশ নারীর উপস্থিতি বেড়ে চলেছে। অবদান বাড়লেও এখনও কর্মক্ষেত্র নরাীদের অধিকার তেমনভাবে সুরক্ষিত হয়নি, নানা কারণে প্রায়শই বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। সুস্পষ্টভাবে আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অবদান এখনও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।

মজুরি দেয়া হয় না বা স্বীকৃতি নেই গৃহস্থালির এমন কাজে নারীদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। রান্না, বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পরিবারের সদস্যদের পরিচর্চা ও সন্তান লালনসহ নানা কাজে নারীর অবদান আর্থিক মানদ-ে বিবেচনা করা হয় না। বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, নারী ঘরে কাজ করেন এমন কাজের আর্থিক মূল্য মোট দেশজ উৎপাদনের ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি মূল্যে টাকার অঙ্কে যা ছিল ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। স্থায়ী মূল্যে তা ৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ। ‘অর্থনীতিতে নারীর অবদান নিরূপণ : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক ওই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয় গত বছরের ২৬ অক্টোবর। ওই গবেষণায় স্পষ্ট হয়ে উঠে পুরুষের তুলনায় কোন কোন ক্ষেত্রে নারী অধিক কাজ করে গেলেও তাদের ও সব কর্মের অবদান জাতীয় আয়ে অন্তর্ভুক্ত হয় না, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বলে অভিহিত করা হয়।

অন্যদিকে কৃষিক্ষেত্রে নারীর অপরিসীম অবদান থাকা সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রেও তারা অবহেলিত। কিষানী হিসাবেই এখনও তেমনভাবে স্বীকৃতি মেলেনি। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী কৃষিতে নারীর অবদান গড়ে ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ। বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত জায়গা নারীর হাতের আলতো স্পর্শেই শাকসবজি, সিম, কুমড়ো, লাউ, শসা ইত্যাদির ফলন হয়ে থাকে। যা ওই পরিবারের শাকসবজির প্রাথমিক চাহিদা পূরণ করে, এমনকি অনেক সময় বাড়তি অংশটুকু বিক্রি করে বাড়তি আয় করাও সম্ভব হয়ে থাকে। এছাড়াও দেশের অনেক এলাকায় নারীরা বপন, রোপণ, নিড়ানিসহ ফসল পরিচর্চার কাজে সরাসরি নিয়োজিত আছেন। ১৯৯৫-৯৬ সালে নারীকে প্রথমবারের মতো নারী যে কৃষক তার স্বীকৃতি দেয়া হয়। তবে এত বছর পরও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) তাদের অবদান অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। কিষানীদের নিয়ে আলাদা কোন পরিসংখ্যান নেই। কৃষি ক্ষেত্রে কর্মরত নারীর শ্রমমূল্য পুরুষের অর্ধেক! আবার একই সময়ে নারীর প্রদত্ত শ্রম ঘণ্টার পরিমাণও বেশি হয়ে থাকে। অর্থাৎ তারা উভয় ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার।

এ প্রসঙ্গে মজিরন নামের এক নারী শ্রমিক বলেন, ‘ধানের খোলায় নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করি। পুরুষকে আট থেকে দশ হাজার টাকা দেয়া হলেও আমাদের দেয়া হয় মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা।’

দেশের পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, একই সঙ্গে এই খাতেই অবহেলা ও বঞ্চনাও বেশি। সরকারী বেসরকারী হিসাবে পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকে সংখ্যা প্রায় ৩২ লাখের ওপর। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারী ও রফতানিকারকদের সংগঠনের (বিজিএমইএ) তথ্য মতে, এ খাতে মোট ৪০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। যার ৮০ শতাংশই নারী। ১৯৭৮ সালে এদেশে পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকেই এখাতে নারীর অবদান বাড়তে থাকে। বদলে যেতে লাগে তাদের জীবনধারণের বৈশিষ্ট্য। পোশাক শিল্পের কারণেই দেশ থেকে ‘কাজের মেয়ে’ প্রথার বিলুপ্তি ঘটেছে, একই সঙ্গে সমাজের অর্থনৈতিক পট পরিবর্তনেরও সূচনা শুরু হয়। দাবি করা হয়ে থাকে, পোশাক শিল্পের বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জনের প্রায় সবটাই নারীদের হাত ধরে। তবে ওই খাতেই নারীরা সবচেয়ে অবহেলিত। গত কয়েক বছরে গার্মেন্টস সেক্টরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের আশানুরূপ পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও এখনও নানাভাবে বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা ঘটে চলছেই! অর্থনৈতিক বঞ্চনার সঙ্গে সঙ্গে যৌন নিপীড়নের ঘটনা তো আছেই।

বনানীতে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন সখিনা। তিনি প্রতিষ্ঠানের নাম জানাতে অস্বীকার করে বলেন, ফ্লোর ইনচার্জ নানাভাবে গালাগালি করে। কাজ ঠিকভাবে করলেও তাদের মন রক্ষা করে চলতে হয়। বিশ্রিভাষায় নানা অঙ্গভঙ্গি করে। তবে আগের চেয়ে এই প্রবণতা কমে এসেছে।

নারী শ্রমিকরা কর্মসংস্থানের খোঁজে শুধু দেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিচরণ করছেন। তারা বিভিন্ন দেশে নানা কাজে নিয়োজিত হয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিবমেইটি) এক তথ্য মতে ১৯৯১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২ লাখ ৬ হাজার ৫২৫ নারীকর্মী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নে অভিবাসী নারীরা অবদান রেখে চললেও কাজ করার ওই সময়টি হচ্ছেন নানাভাবে প্রতারিত। বিদেশ গমনের সময় কিংবা পরবর্তী সময়েও তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ছিনিয়ে নেয় আদম ব্যবসায়ীরা। কম মজুরি, গৃহকর্মের নামে যৌনদাসত্ব, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়েও বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়ে দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত আছেন তারা। হাইকমিশন ও দেশের পক্ষ থেকে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা সময়ের দাবি।

সরকারী-বেসরকারী ও স্বায়ত্তশাষিত প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে নারীর উপস্থিতি চোখে পড়ে না। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পসহ নানা রকম কুটির ও বণিক শিল্পে সমান দক্ষতা রেখে চলেছে। নারী শিল্প উদ্যোক্তার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিকূল পরিবেশেও নারীরা তাদের সক্ষমতার ছাপ রেখে চলেছে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে।

মানবাধিকার নেত্রী এলিনা খান জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে জিডিপিতে নারীর অবদান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীরা পরিশ্রম করে আয় করলেও নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তা ব্যয় করতে পারছেন না। পারিবারিকভাবে কখনও বাবা ও বড় ভাই দ্বারা প্রভাবিত হতে হয়। বিয়ের পর স্ত্রীরা তার অর্জিত অর্থ স্বাধীনভাবে ব্যয় করতে পারেন না। তবে সব ক্ষেত্রেই এমনটি নয়, উপার্জন করে নিজের মতে ব্যয় করতে না পারলে কিসের স্বাধীনতা! কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষে বৈষম্য প্রসঙ্গে এই নেত্রী বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। একই কাজে পুরুষকে ১০০ টাকা দেয়া হলে নারীকে দেয়া হয় ৬০ টাকা। পারিশ্রমিক বৈষম্য ছাড়াও কর্মক্ষেত্রে নারীদের বৈষম্যের শিকার হতে হয়। নারীদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে মানবিকবোধ জাগ্রত করা প্রয়োজন, নারী-পুরুষে কোন ভেদাভেদ হতে পারে না।