CPD study on women’s contribution to economy cited

Published in Bhorer Kagoj on Monday, 4 August 2014.

অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রয়োজন নারী উদ্যোক্তা

ভোরের কাগজ

বাঙালি গৃহবধূ বলতে চোখের সামনে যে চেহারা দেখা যায় তার চেয়ে তিনি আলাদা। তবে চিরচেনা বাঙালি নারীর মতোই তিনি সহজ-সরল এবং মার্জিত। কিন্তু তার মধ্যে রয়েছে বিশেষ গুণ। তিনি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন, আবার সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি যেমন সংগ্রামী তেমনি পরিশ্রমী। এই পরিশ্রম করে তিনি শুধু নিজেই সফল হননি, সাড়ে ৩শ দরিদ্র নারী-পুরুষের সংসারে অভাব দূর করেছেন। তাদেরও দেখাচ্ছেন সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। সেই সফল নারীর নাম জেসমিন বেগম।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বড়রেডাইত গ্রামের মোঃ আকবর হোসেনের মেয়ে জেসমিন বেগমের বিয়ে হয় মোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে। স্বামী রেজিস্ট্রি অফিসে মোক্তারি করেন। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে জেসমিন তিন সন্তানের মা হন। অল্প শিক্ষিত এই নারীর মনে কষ্ট ছিল, নিজে বেশি পড়ালেখা করতে পারেননি বলে। তিনি চিন্তা করেন নিজে যা অর্জন করতে পারেননি, তা তিন সন্তানদের দিয়ে অর্জন করবেন। অর্থাৎ সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। এর জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। স্বামীর উপার্জিত টাকা দিয়ে সংসার চালিয়ে তা সম্ভব হবে না। তাই ভাবতে থাকেন তারও কিছু করা প্রয়োজন। কিন্তু কি করবেন, বেশি লেখাপড়া তো জানেন না। তার পক্ষে ভালো চাকরি জোগানো সম্ভব নয়। বাবার বাড়িতে কিছু সেলাইয়ের কাজ শিখেছিলেন। তা কাজে লাগিয়ে মেয়েদের পোশাক তৈরি করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। এর জন্য চাই মূলধন। কোথায় পাবেন সেই মূলধন। চিন্তায় পড়ে যান তিনি। এক পর্যায়ে মূলধন সংগ্রহের আশ্বাস দিলো একটি বেসরকারি সংগঠন। তাদের সহযোগিতায় ২০০৫ সালে তিনি ৩০ হাজার টাকা ঋণ নেন।

ঋণের টাকা ও নিজের জমানো কিছু টাকা দিয়ে ৫টি সেলাই মেশিন নিয়ে মেয়েদের পোশাক তৈরি করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে তার তৈরি পোশাকের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসার পরিসর বাড়াতে তিনি তাদের কাছ থেকে ২য় দফায় ১ লাখ টাকা ঋণ নেন। আবার ৩য় দফায় ২ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করে নিজেদের জমিতে গার্মেন্টস দেন। তার সেই স্বপ্নের গার্মেন্টসের নাম দেন ‘মনিকা ফ্যাশন গার্মেন্টস’। কাজের স্বচ্ছতা ও মান বজায় রাখার কারণে তার প্রতিষ্ঠানের বেশ সুনাম হয়। ফলে বড় বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কাছ থেকে সাব-কন্ট্রাক্ট কাজের প্রস্তাব পান তিনি। এ সুযোগ তিনি কাজে লাগিয়ে জনবল বৃদ্ধি করেন। তার প্রতিষ্ঠানে এখন সাড়ে ৩শ জন অভাবী ও দরিদ্র মানুষ কাজ করে। তার মধ্যে ৯০ ভাগ নারী।জেসমিন বেগমের তিন মেয়ে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। পূরণ হচ্ছে তার স্বপ্ন। তার বড় মেয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজিতে মাস্টার্স শেষ করছে। দ্বিতীয় মেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ছে। তৃতীয় মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছে।

জেসমিন বেগম বলেন, নারীরা অবলা-অসহায় এবং অন্যের ওপর নির্ভরশীল এ কথা ঠিক নয়। কারণ নারীরাও পুরুষের পাশাপাশি পরিশ্রম করতে জানে। তারা একটু সুযোগ পেলে স্বাবলম্বী হতে পারে। তিনি এখন নিজেকে পরিপূর্ণ সফল নারী হিসেবে মনে করেন।

এরকম সফল নারীর কাহিনী বাংলাদেশে সর্বত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নারী উদ্যোক্তাদেরও সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা শুধু শহরে নয়, গ্রামেও। সরকারি ও বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার কাছ থেকে স্বল্প সুদে জামানত ছাড়া ঋণ পাওয়ায় নারী উদ্যোক্তা বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৩ অর্থাৎ-৪ বছরে সেবা খাতে ৬ হাজার ৯৮৪ জন নারী উদ্যোক্তা ৯১৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। ব্যবসা খাতে ৬৩ হাজার ৭০২ জন নারী উদ্যোক্তা ঋণ নিয়েছেন ৫ হাজার ৮৩২ কোটি ১০ লাখ টাকা। শিল্প খাতে ১৮ হাজার ৩৩২ জন নারী উদ্যোক্তা ২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৪ বছরে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ২১৫ দশমিক ১০ শতাংশ। নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির উপরোক্ত চিত্র আশাবাদ সঞ্চার করলেও নারীদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার সংখ্যা খুবই কম। একবিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলাদেশে নারীর অগ্রগতি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। কেননা কর্মজীবী নারীর সিংহভাগ কর্মজীবী। বর্তমানে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী কর্মক্ষেত্রে রয়েছে। সেক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা খুব কম বলা চলে। যথাযথ লেখাপড়া, ঘরের বাইরে যাওয়া, ব্যবসার পুঁজি জোগান, সমাজ ও পরিবারের সঠিক সহযোগিতা একজন উদ্যোক্তার জন্য জরুরি। সেক্ষেত্রে নারীরা নানাভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। যোগ্যতা প্রমাণের পরিপূর্ণ সুযোগ না পেলেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শ্রমিক থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চতর পর্যায়ে রয়েছে নারীর বিচরণ। চাকরির পাশাপাশি উদ্যোক্তা হয়ে অনেক নারী গড়ে তুলছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি গবেষণাপত্র- ‘অর্থনীতির মূল ধারায় নারীর অংশগ্রহণ’- এ উল্লেখ করা হয়েছে অতিদ্রুত অর্থনীতিতে বিশেষভাবে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য অংশগ্রহণকারী নারীর সংখ্যা বাড়ছে। স্মরণযোগ্য যে বর্তমান সরকারের ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন করতে হলে, নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে আরো অংশগ্রহণ দরকার। এ লক্ষ্যে সরকারের আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন। বার্ষিক বাজেটে এবার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য মাত্র ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ বরাদ্দ যে খুবই স্বল্প তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি করতে এনজিওগুলো কমবেশি কাজ করছে। কিন্তু তাদের প্রদত্ত ঋণের সুদের হার বেশি হওয়ায় নারী উদ্যোক্তাদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি আর্থিক সহযোগিতা। বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য টাকার পরিমাণ আরো বাড়ানো প্রয়োজন।

এম আর পাটোয়ারী