CPD study on women’s contribution to the economy cited

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) যৌথ গবেষণা ‘জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান নিরূপণ :বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ এ তথ্য উঠে এসেছে। সিপিডির গবেষক ড. ফাহমিদা খাতুনের এ প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ১৫ বছরের বেশি বয়সী একজন নারী গড়ে প্রতিদিন একই বয়সী পুরুষের তুলনায় প্রায় তিন গুণ সময় জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না এমন কাজে নিয়োজিত থাকেন।

Published in Samakal on Wednesday, 28 October 2015.

নারীর মজুরিহীন শ্রম – ১
গৃহস্থালির কাজই বছরে ১০ লাখ কোটি টাকার
নারীর এসব শ্রম অর্থনীতির হিসাবে আসে না

রাজীব আহাম্মদ

উদয় থেকে অস্ত, নারীকে ঘরের কাজে থাকতে হয় ব্যস্ত। তারপরও শুনতে হয়, ‘সারাদিন তুমি করোটা কী?’ সংসারে দিনভর খাটুনির পরও নারীর শ্রমের মজুরি নেই। সংসারে পুরুষের তুলনায় তিন গুণ বেশি কাজ করলেও এর কোনো মূল্য নেই। চোখের আড়ালেই থেকে যায় সব। এই শ্রমকে টাকায় হিসাব করলে অঙ্কটি বিস্ময়-জাগানো। বাংলাদেশের নারীরা বছরে গৃহস্থালির কাজ করেন ১০ লাখ ৩১ হাজার ৯৪১ কোটি টাকার, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরের দেশজ মোট উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ!

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) যৌথ গবেষণা ‘জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান নিরূপণ :বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ এ তথ্য উঠে এসেছে। সিপিডির গবেষক ড. ফাহমিদা খাতুনের এ প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ১৫ বছরের বেশি বয়সী একজন নারী গড়ে প্রতিদিন একই বয়সী পুরুষের তুলনায় প্রায় তিন গুণ সময় জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না এমন কাজে নিয়োজিত থাকেন। প্রতিদিন একজন নারী এ ধরনের কাজে গড়ে ৭ দশমিক ৭ ঘণ্টা ব্যয় করেন।

অন্যদিকে, এ ধরনের কাজে একজন পুরুষের গড়ে সময় ব্যয় হয় মাত্র ২ দশমিক ৫ ঘণ্টা। গ্রাম ও শহর সর্বত্রই এ ব্যবধান স্পষ্ট। একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১২ দশমিক ১টি এমন কাজ করেন, যা জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয় না। পুরুষের ক্ষেত্রে এ ধরনের কাজের সংখ্যা ২ দশমিক ৭টি।

গবেষণায় গৃহস্থালির ১২ ধরনের কর্মকাণ্ডের ৫৪টি কাজ বিবেচনায় আনা হয়েছে। এমজেএফের ‘মর্যাদায় গড়ি সমতা’ প্রচারাভিযানের সমন্বয়ক বনশ্রী মিত্র নিয়াগি জানান, ১২ ধরনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে রান্না, শিশুকে বড় করা, শিশু শিক্ষা, গৃহকর্ম, বয়স্ক সেবা, কৃষি প্রভৃতি। রান্নাকাজকে আবার মসলাবাটা, পানি আনা, তরকারি কাটাসহ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সারাদেশে ১৩ হাজার ৬৪০ জনের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্যানুযায়ী, এক নারী প্রতিদিন গড়ে এই ৫৪টি কাজের মধ্যে ১২ দশমিক ১টি কাজ করেন।

নারীর শ্রমের মূল্য অভিজাত কি প্রত্যন্ত এলাকা_ কোথাও নেই। গত শুক্রবার বান্দরবানের আলীকদমের প্রত্যন্ত এলাকায় থিংকুপাড়া বাজারে কথা হয় ম্রো নারী নি অয় লা ম্রোর সঙ্গে। সবে সন্ধ্যা নেমেছে। জুমের ক্ষেত থেকে কাজ শেষে বাজারে স্বামীর দোকানে সহায়তা করতে এসেছেন। কোলে শিশুপুত্র। কথা হয় তার সঙ্গে। ভাঙা ভাঙা বাংলায় রোজকার দিনলিপি জানান। সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকেই ওঠেন নি অয়। বেরিয়ে পড়েন ঝাড়ূ হাতে। ঘরদোর ঝাড়ূ দিয়ে রান্না করেন স্বামী-সন্তানের জন্য। ঢালের ঘর থেকে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পানি আনেন। সেখান থেকে পানি আনা খুবই শ্রমসাধ্য কাজ। এরপর রান্নার লাকড়ি সংগ্রহ করতে হয়।

স্বামীর ছোট্ট মনিহারি দোকান থাকায় জুম চাষ আর জীবিকা অর্জনের প্রধান মাধ্যম নয় নি অয় লার পরিবারের। তার পরও পরিবারের খোরাকির জন্য চাষবাস করতে হয়। এ কাজও করতে হয় এই নারীকে। দুপুরে ফিরে সন্তানদের গোসল করিয়ে খেতে দেন। সকালের খাবার ফুরিয়ে গেলে রান্নাও করতে হয়। এর পর দোকানেও আসেন স্বামীকে সহায়তা করতে। দিন শেষে আবার রাতের রান্না। সন্তানদের ঘুম পাড়িয়ে নিজে ঘুমান সব শেষে। পরের দিন একইভাবে দিন কাটে নি অয় লার। জুমের ফসল পরিবারের খোরাকিতেই চলে যায়। পেঁপে, কলা বাড়তি কিছু পেলে দোকানে বিক্রি হয়। এই ম্রো নারী উদয়-অস্ত শ্রম দিলেও তার মজুরি পান না। কখনও সেভাবে ভাবেনওনি।

কথা হয় নি অয় লার স্বামী মুই প্রু ম্রোর সঙ্গে। স্ত্রীর দিনলিপি তিনিও পাশে বসেই শোনেন। এত কাজ করে তার স্ত্রীও যে পরিবারে অর্থনৈতিক অবদান রাখছে, তা কখনও ভেবেও দেখেননি। তার উত্তর, তার স্ত্রী যেসব কাজ করেন, পাহাড়ের আর সব নারী একই কাজ করেন। তার জন্য কেউ মজুরি পায় না। নারীর জন্মই হয়েছে সংসারের কাজ করার জন্য।

এর একদিন আগে গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের দোহাজারীতে সড়ক ও জনপথের (সওজ) আঞ্চলিক কার্যালয় চত্বরে কথা হয় দুই নারী শ্রমিকের সঙ্গে। সড়ক সংস্কারে মাটি টানার কাজ করেন তারা। প্রায় ৩৫ বছর বয়সী এ দুই নারীর নাম রোকেয়া ও পারভিন। অনেক দিন ধরেই তারা মাটি কাটার কাজ করেন। এ ছাড়া আর কোনো কাজ করেন কি-না? এ প্রশ্নে দু’জনই জানান, না, আর কোনো কাজ তারা করেন না। ঘরে সংসারের সব কাজ তাহলে কে করে? এ প্রশ্নে জানান, এগুলো তারাই করেন। কিন্তু এগুলো তাদের চোখেও ‘কাজ’ হিসেবে স্বীকৃত নয়।

তখন সকাল সাড়ে ৮টা বাজে। রোকেয়া জানান, সকালে রান্নাবান্না ও ঘরদোর পরিষ্কার করে স্বামী-সন্তানকে খাইয়ে এসেছেন। দুপুরের রান্নাও সেরে এসেছেন। বিকেলে কাজ শেষে বাড়ি গিয়ে রাতের রান্না করবেন। মাটি টানার জন্য দিনে ৩৫০ টাকা মজুরি পেলেও ঘরের কাজকে ‘কাজ’ নয়, দায়িত্ব ভেবেই করেন বলে জানালেন।

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী সমকালকে বলেন, নারীর গৃহকর্মের শ্রমের মূল্য তো নেই, এসব কাজকে কাজ হিসেবেই দেখা হয় না; বরং এগুলোকে দৈনন্দিন মূল্যহীন মেয়েলি কাজ হিসেবে দেখা হয়।