আরেক অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছি – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

আরেক অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছি

২০১৩ সালে আমরা সম্ভাবনার দেশ থেকে ঝুঁকির দেশে চলে গেলাম কিনা? ঝুঁকির দেশে আমরা স্থায়ী বসবাস করব কিনা তা নির্ভর করছে ২০১৪ সালটা কেমন যাবে আমাদের। তাছাড়া ২০১৩ সালে যে জিনিসগুলো অর্থনীতির বড় ধরনের ক্ষতি করছে, সেগুলো ২০১৪ সালে কত মাস অব্যাহত থাকবে, তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে। কারণ এটা দিয়েই সিদ্ধান্ত হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি কত দ্রুত আবার প্রবৃদ্ধির উচ্চ মাত্রার দিকে ধাবিত হবে।
অর্থনীতির দিক থেকে বর্তমান সরকারের প্রথম দুই বছর খুব ভালো ছিল। তৃতীয় বছরের দ্বিতীয় অংশ থেকে ২০১২ সালের জানুয়ারির পর থেকে অর্থনীতির ভেতরে প্রথম দিকের যে ইতিবাচক উত্তেজনাটা ছিল, সেটা আস্তে আস্তে প্রশমিত হয়ে যায়। ২০১২ সালের শেষ এবং ২০১৩ সালের শুরুর দিকে দেশ আবার প্রাক-নির্বাচনী সঙ্কটের ভেতরে চলে যায়। সে জন্য ২০১২ সালের শেষের দিক থেকে ২০১৩ সালজুড়ে সবচেয়ে বড় যে জায়গাটাতে সমস্যা হয়েছে, সেটা হলো বিনিয়োগের পতন। বিশেষ করে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের পতন। বিনিয়োগের পতনের প্রকাশ হলো, প্রবৃদ্ধি দুর্বল হয়ে যাওয়া। ৬ শতাংশ থেকে আস্তে আস্তে নামতে থাকা। সে সময়টাতে বিনিয়োগহীন প্রবৃদ্ধি দেখা দিচ্ছিল। এর ফলে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ দেশজ আয়ের শতকরা কমে গেল। এখনও আমরা সেটাই দেখছি। লক্ষ্যমাত্রা, মুদ্রানীতির তুলনায় বছরজুড়ে ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহ কম হয়েছে। ব্যক্তি খাতে আমদানি কম হয়েছে। বিশেষ করে পুঁজি পণ্য। ওখানেও ঋণ প্রবাহের ভেতরে শিল্পঋণ কিছুটা মার খেয়েছে। আমরা দেখেছি যে, ঠিকমতো ঋণ না পাওয়ায় এবং সঠিক লোকের ব্যবসা ঠিকমতো না চলার কারণে তফসিলকৃত মন্দ ঋণের শতকরা হার বেড়েছে। এটা বাংলাদেশের অর্থনীতির মৌলিক সমস্যার মতো সৃষ্টি হয়েছে। আমরা মনে করেছি, অবকাঠামো, সেবার উন্নতি হলে হয়তো পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ, গ্যাস, নিষ্কণ্টক জমি এ খাতগুলোর উন্নতি হবে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সামান্য কিছু উন্নতি হলেও বিদ্যুৎ সংযোগ এবং নতুন গ্যাস সংযোগ, শিল্প-কারখানার জন্য জমি পাওয়া সংক্রান্ত সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে শিল্প সম্পর্কের ওপর নতুন চাপ। বিশেষ করে গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা এবং বেঁচে থাকার মতো মজুরি পাওয়াকে কেন্দ্র করে অসন্তোষ। রফতানিতে জিএসপি সুবিধা বাতিল হওয়ার কারণে এ অর্থবছরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিবেশকে আরও জটিল করেছে। বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারের জন্য যে জিএসপি সার্টিফিকেট দেয়া হয়, সেটা এরই মধ্যে নেতিবাচক হয়ে গেছে। অর্থাৎ জিএসপি সার্টিফিকেট ইস্যু করার পরিমাণ কমে গেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমের পরিবেশ উন্নতি করার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক নজরদারি বৃদ্ধি পাওয়া বিনিয়োগের পরিবেশকে জটিল করেছে।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ নিঃসন্দেহে বেড়েছে। প্রথম দিকে বাড়ার কারণ হলো, রফতানি, রেমিট্যান্স ভালো ছিল, বৈদেশিক সাহায্যও অনেক এসেছে। কিন্তু এখন আমরা দেখছি, বৈদেশিক বিনিয়োগ একই জায়গায় আছে, রেমিট্যান্সের ধারার পতন হচ্ছে, বৈদেশিক সাহায্য কমে যাচ্ছে। বৈদেশিক আয়ও যে খুব স্বস্তির মধ্যে আছে, তা নয়। বর্তমান অর্থবছরে রাজনৈতিক সহিংসতা এবং নির্বাচনী অনিশ্চয়তা বিনিয়োগ পরিবেশকে আরও জটিল করে তুলছে। এখন বারবার যে প্রশ্নটা উঠছে সেটা হলো, বাংলাদেশ কি আমদানির জন্য আদৌ নির্ভরযোগ্য উৎস কিনা? বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ জায়গা কিনা? মাঝে এ প্রশ্নগুলো কেটে গিয়েছিল। বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়ে লোকে আলাপ করছিল কিছুদিন আগ পর্যন্ত। এখন আবার হঠাৎ করে বাংলাদেশে ঝুঁকির বিষয়গুলো চলে এসেছে। অর্থাৎ ২০১৩ সালে আমরা সম্ভাবনার দেশ থেকে ঝুঁকির দেশে চলে গেলাম কিনা? ঝুঁকির দেশে আমরা স্থায়ী বসবাস করব কিনাÑ তা নির্ভর করছে ২০১৪ সালটা কেমন যাবে আমাদের। তাছাড়া ২০১৩ সালে যে জিনিসগুলো অর্থনীতির বড় ধরনের ক্ষতি করছে, সেগুলো ২০১৪ সালে কত মাস অব্যাহত থাকবে, তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে। কারণ এটা দিয়েই সিদ্ধান্ত হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি কত দ্রুত আবার প্রবৃদ্ধির উচ্চ মাত্রার দিকে ধাবিত হবে। এ অর্থবছরে বিনিয়োগের জায়গা বাদ দিলে তুলনামূলকভাবে কৃষি ভালো ছিল। বোরো একটু নরম ছিল; কিন্তু আমন ধানের ফলন ভালো হয়েছে। বারবারই ঘুরে-ফিরে যে প্রশ্নটা আসছে সেটা হলো, কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে কিনা? কৃষি বিশেষ করে ধান চাষ লাভজনক থাকবে কিনা? আমরা এ সময় দেখেছি, অনেকে কৃষি থেকে জমি নিয়ে গিয়ে অকৃষি বা শস্যের বাইরে অন্য উৎপাদনে চলে গেছে। সেটার ফল বাংলাদেশে ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তার কী হবে এ আলোচনাগুলোও কৃষির ক্ষেত্রে নতুনভাবে নিয়ে আসছে।
আমরা এ সময়কালে রফতানিকে একটা উজ্জ্বল জায়গায় দেখেছি। কিন্তু রফতানি আবার বিভিন্ন প্রশ্ন ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এখন ২৫ শতাংশ রফতানির যে পরিমাণ দেখানো হয়েছে, সেটা গত বছরের রফতানির নেতিবাচকের ওপর হিসাব করা হয়েছে।
আবার রেমিট্যান্স প্রবাহ বছরের শুরুর দিকে যতটা উচ্চ ছিল, বছরের শেষে এসে এটার পতন ঘটেছে। কারণ, গত অর্থবছরের চেয়ে মানুষের বিদেশে যাওয়ার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তাই আগের মতো বৈদেশিক হিসাবে ভারসাম্য আনতে রেমিট্যান্স যেভাবে সমর্থন দিয়েছে, সেটা বজায় রাখতে পারবে কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দিচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে এসেছিল; কিন্তু বছরের শেষে এসে এটা আবার বাড়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এখনও মূল্যস্ফীতি মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উপরে (৮-এর ওপরে, ৯-এর কাছাকাছি) রয়েছে। অবরোধ ও হরতালের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা, পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
এ অর্থবছরে সরকার ট্যাক্স আদায়ও খারাপ করেনি। কিন্তু আদায়ের হার আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। আগের বছরগুলোর তুলনায় আদায় বৃদ্ধির হার কমে গেছে।
যেহেতু অর্থবছর এখন দু’ভাগ হয়ে গেছে, গত অর্থবছরের প্রথম ভাগে বৈদেশিক সাহায্য ভালো এসেছে। বৈদেশিক প্রকল্প সাহায্য ভালো আসাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বিনিয়োগের পরিবেশও অন্যান্য দেশের (অনেকের চেয়ে) তুলনায় ভালো হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন বাস্তবায়নের হারও ভালো ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ভাগে এসে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় বৈদেশিক সাহায্যের পতন ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে কোনো কোনো মাসে আশার চেয়ে নিট গেছে বেশি। যার ফলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও নতুন বছরের প্রথম ভাগে যত ভালো ছিল শেষে এসে একটু দুর্বল হয়ে গেছে।
রাজস্ব ব্যয় বেড়েছে। এখন উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় যে বাড়ল, তার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যাদের জন্য এ ব্যয় করা প্রকৃতই তাদের কাছে পৌঁছল কিনা? যে পরিমাণ টাকায় এ প্রকল্পগুলো করা হচ্ছে, তার প্রকৃত সুবিধাও সে পরিমাণ কিনা? এবারের প্রশ্নটা অনেক বড়। পরিমাণের থেকে গুণগত মানের প্রশ্নটা অনেক বড় হয়ে উঠছে।
রিজার্ভ বাড়ার একটা প্রধান কারণ ছিল, রেমিট্যান্সের টাকা এবং আমদানি অনেক কম ছিল। আগামী দিনে যদি এই আয়গুলোতে বড় ধরনের কোনো সমস্যা হয়, তবে টাকার মূল্যমানের ওপর বড় ধরনের পতন ঘটবে। তখন সে ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদকে ব্যবহার করার একটা সুযোগ আসবে। এটা একটা ইতিবাচক দিক যে, নীতিপ্রণেতারা টাকাকে ঠেকা দেয়ার সুযোগটা পাবেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উত্তরণের পথ কী? উত্তরণের পথ একটাই, অর্থনীতিকে রাজনৈতিক উত্তাপ থেকে দূরে রাখা। কিন্তু সেটার ব্যাপারে রাজনৈতিক উদ্যোগ বা ব্যবসায়ীদের চেষ্টা কোনোটাই সফল হয়নি এখন পর্যন্ত। বরং এখন যে অবস্থায় গেছে সেটা হলো, অর্থনীতিকে পঙ্গু করার মাধ্যমে সরকারকে বিকল করা। যেহেতু শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জায়গাটা সঙ্কুচিত হয়ে গেছে, এর সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ অন্যান্য বিষয় যুক্ত হয়ে আরও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। সেহেতু শেষে যেটা দাঁড়িয়েছে, অর্থনীতিকে বিকল করার মাধ্যমে রাজনীতিকে নতজানু করার চেষ্টা চলছে। আমরা আত্মঘাতী রাজনীতির ভেতরে ঢুকে গেছি। এই আত্মঘাতটা একটা রাজনৈতিক দল বা সরকারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। কারণ, আমার হিসাবে এটি একটি মধ্যবর্তী সঙ্কটে ঢুকে যায়, তাহলে এখান থেকে বের হতে এবং অর্থনীতিকে আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে ৪-৫ বছরের বেশি সময় লেগে যাবে। যারা এখন অর্থনীতিকে অচল করার চিন্তা করছে, তারাই কিন্তু সরকারে যেতে চায়। যদি তারা ক্ষমতায় আসে, তারা একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতির ভেতর ক্ষমতায় আসবে। এই রাজনীতিতে কারোরই জয় নেই। এ রাজনীতিতে অর্থনীতি, দেশ সবারই ক্ষতি। কারণ, ২০১৩ সালে অর্থনীতির যে ঝামেলাগুলো সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো ২০১৪ সালেও অব্যাহত থাকবে। আমি এখনও কোনো উত্তরণের পথ দেখছি না। ৫ জানুয়ারির পর যে সরকার আসবে তাদের ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলো, এ সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা হয়তো থাকবে, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা হয়তো থাকবে; কিন্তু এর রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ও নৈতিক বৈধতা দুটোর ক্ষেত্রেই যৎসামান্য হবে। রাজনৈতিক বৈধতা, গ্রহণযোগ্যতা হবে খুবই সঙ্কুচিত। আর নৈতিক বৈধতা হবে খুবই সঙ্কীর্ণ। এ রকম একটি রাজনৈতিক, নৈতিক বৈধতার স্বল্পতায় আক্রান্ত সরকার যে খুব কর্মক্ষম সরকার হতে পারবে, তা কিন্তু আমার মনে হয় না। তারা জোর দিয়ে কোনো অর্থনৈতিক সংস্কার করতে পারবে না, কর আদায়ের ক্ষেত্রে তাদের নমনীয় হতে হবে, তাদের বৈদেশিক সাহায্য, দেশীয় সম্পদ পাওয়া, রফতানির সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা অনেক বেশি বাধার মুখোমুখি হবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ব্যয় করার ক্ষেত্রে, প্রকল্প কার্যকারিতার ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রশাসন কতখানি আগ্রহ নিয়ে কাজ করবে সেটাও খুব নিশ্চিত নয়। আর যদি দেশের ভেতরে রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহতই থাকে এ সরকার গঠনের পর, তাহলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগকারী এগিয়ে আসবে না। তারা অপেক্ষা করে থাকবে আবার কে মন্ত্রী হয় দেখি। সবাই ধরে নিয়েছে, যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তা পূর্ণ মেয়াদে আসবে না। যারা খুব বেশি আশাবাদী তারাও তিন বছরের বেশি বলতে সাহস করে না। যে সরকার পূর্ণ মেয়াদে থাকবে না, সে সরকার অর্থনীতিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করাবে, নতুন পথ দেখাবে আমি তো তা দেখি না।
– ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য – অর্থনীতিবিদ, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।