Dr Khondaker Golam Moazzem on RMG export and raw material import

Published in Naya Diganta on Sunday, 12 January 2014.

প্রবৃদ্ধি হলেও আগামীতে রফতানি ধরে রাখা কঠিন হবে : ব্যবসায়ীসমাজ
বায়াররা চলে যাচ্ছে ভারত ও ভিয়েতনামে

হামিদ সরকার

পুরনো অর্ডারগুলো দিতে পারার কারণে রফতানি খাতের প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ইতিবাচক রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নতুন করে অর্ডার আসা কমে গেছে। অনেক বায়ার বাংলাদেশ থেকে তাদের অর্ডার আপাতত ভারত ও ভিয়েতনামকে দিয়ে দিচ্ছে বলে রফতানিকারকরা জানিয়েছেন। এমনকি আফ্রিকার দেশগুলো ও চায়নাতেও চলে যাচ্ছে তৈরী পোশাক খাতের বায়াররা। পোশাক রফতানিকারকরা জানান, এ শিল্পের পরিস্থিতি অনেক করুণ। দ্বিগুণ ব্যয় করে কারখানা চালু রাখতে হচ্ছে। কিন্তু এটা কত দিন ধরে রাখা সম্ভব হবে সেটা বলা যাচ্ছে না। তবে গত তিন মাস ধরে ব্যাংকে খেলাপিদের হার বাড়ছে। অন্য দিকে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের ক্রেতাদের কব্জাবন্দী করতে ভারত পৃথক ওয়েবপোর্টাল খুলেছে। তাতে ক্রেতাদেরকে ভারতে পোশাক শিল্পের অর্ডার দিতে আহ্বান জানাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক এই পরিস্থিতি আমাদের রফতানির জন্য একটা অশনিসংকেত। নির্বাচনের পর আমেরিকা ও ইইউর বক্তব্য আমাদের জন্য ইতিবাচক কিছু বহন করছে না।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, পুরনো অর্ডারের কারণে রাজনৈতিক চরম অস্থিরতার পরও চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রফতানি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬.৫৬ শতাংশ। ছয় মাসে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪২৪ কোটি ৬৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার। এর বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ১৪৬৮ কোটি ৫৮ লাখ ১০ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩.০৮ শতাংশ বেশি। রাজনৈতিক অস্থিরতা মূলত সেপ্টেম্বর থেকেই শুরু হয়। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ছিল ২১.২৮ শতাংশ। নভেম্বরে এসে তা দাঁড়ায় ১৮.০২ শতাংশ। আর ডিসেম্বরে এসে সেটা ১৬.৫৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ডিসেম্বরে এসে প্রাথমিক পণ্যে প্রবৃদ্দি ১৭.৪৩ শতাংশ এবং উৎপাদিত পণ্যে ১৬.৬২ শতাংশ। প্রধান প্রধান পণ্যের বেশির ভাগই ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে পাট ও পাটজাত পণ্যে (১৭.১০%)।

তৈরী পোশাক রফতানি বাড়লেও পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি আয় গত কয়েক মাসের মতোই নি¤œমুখী রয়েছে। আলোচ্য সময়ে এই খাত থেকে ৪১ কোটি ৬৪ লাখ ডলার রফতানি আয় হয়েছে, যা ল্যমাত্রার চেয়ে ২৩.৩৭ ও গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম। এর মধ্যে কাঁচাপাট পাঁচ কোটি ৯০ লাখ ডলার, পাটের সুতা ২৪ কোটি ৮২ লাখ ডলার ও পাটের ব্যাগে আট কোটি ৬১ লাখ ডলার আয় হয়েছে। এ ছাড়া হিমায়িত খাদ্যে ৩৭ কোটি ৭৪ লাখ ডলার, হোম টেক্সটাইলে ৩৫ কোটি ডলার, কৃষিজাত পণ্যে ২৬ কোটি ডলার, চামড়ায় ২৩ কোটি ৯৪ লাখ ডলার, চামড়াজাত পণ্যে ৯ কোটি ৪৯ লাখ ডলার, প্লাস্টিক পণ্যে তিন কোটি ডলার, টেরিটাওয়ালে তিন কোটি ৮০ লাখ, প্রকৌশল পণ্যে ১৭ কোটি, বাইসাইকেলে চার কোটি, পাদুকায় ২৮ কোটি ও সিরামিক পণ্যে দুই কোটি ৪৩ লাখ ডলার রফতানি আয় হয়েছে।

বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি মো: ফজলুল হকের বিশ্লেষণ হলো, অনেক কাঠখড়ি খরচ করে আমাদেরকে ১৬.৫৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে শ্রমিকদের গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসতে হচ্ছে। তাদের খাবার দিতে হচ্ছে। ওভারটাইম করাতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন খাতে অনেক বেশি ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু এটা ধরে রাখা আগামী দিনগুলোতে কতটা সম্ভব হবে সেটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ আমরা ভেবেছিলাম জানুয়ারিতে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু পরিস্থিতি আরো নেতিবাচক আবহাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সমস্যার কারণে আমাদের বায়াররা সরে যাচ্ছে। আর বায়াররা যে চলে যাচ্ছে তার অন্যতম চিত্র হলো ভারতের রফতানি প্রবৃদ্ধি ৩০ শতাংশ।

বিকেএমইএ’র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, দু-তিন মাস পর থেকেই আমরা রফতানি আয়ের ল্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে যেতে শুরু করব। এমন পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে কমপে আরো এক বছর আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা না গেলে রফতানি আয়ের ধস ঠেকানো যাবে না।

বিজিএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি নাসিরউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর মতে, আমাদের অর্ডারগুলো আসে বছরের প্রথম দিকে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্রেতারা অন্যত্র চলে যাচ্ছে। আর এই সুযোগে বায়ারদের ভারত, আফ্রিকার দেশগুলো ও চায়না নিজের দেশে টানছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের ক্রেতাদের কব্জাবন্দী করতে ভারত পৃথক ওয়েবপোর্টাল খুলেছে। তাতে ক্রেতাদেরকে ভারতে পোশাক শিল্পের অর্ডার দিতে আহ্বান জানানো হচ্ছে। বাংলাদেশের নাম উল্লেখ না করলেও তারা বলছে, তাদের দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা পণ্য সরবরাহ করতে পারবে।

তিনি জানান, তিন মাসের পণ্য আমাদেরকে ৫ মাসে উৎপাদন করতে হয়েছে। উৎপাদন অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে গত ২০১৩ সালের শেষ তিন মাসে। আমাদের এই উৎপাদিত পণ্যের শিপমেন্ট হয় জাহাজে বা ফ্রি। কিন্তু সেটা আমরা করতে পারিনি। ফলে কোটি ডলার ব্যয় করে বিমানে শিপমেন্ট করতে হয়েছে। এতে করে শিল্পের মালিকদের লোকসান হয়েছে। এটা করা হয়েছে শুধু ক্রেতাকে ধরে রাখার জন্য। তিনি বলেন, যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত থাকে তাহলে ক্রেতাদের ধরে রাখা কঠিন হবে। অর্ডার কমে গেলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যাংক ঋণের কিস্তির জন্য ব্যাংকগুলো থেকে চাপ দেয়া হবে।

রফতানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদীর মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত এয়ারশিপমেন্টে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার মতো। আমাদের রফতানি খাতের সব চেইন ভেঙে পড়েছে। তার পরও আমরা উদ্যোক্তারাই রফতানি ধরে রেখেছি। আমাদের ড্যামারেজ চার্জ অনেক গুণ বেড়েছে। তিনি বলেন, আমাদের অর্ডারগুলো চিশ্চিত হয় ৬ মাস আগে। কিন্তু এখন যে অস্থিরতা চলছে তাতে অর্ডার নিয়েও আমরা শঙ্কিত। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান না হলে ফেব্রুয়ারিতে আমাদের রফতানি কমে যাবে। ফলে শ্রমিকরা কর্ম হারাবে। তিনি বলেন, এখন থেকে আগামী দুই বছর আমাদের জন্য অনেক খারাপ যাবে। এ জন্য সরকারের উচিত হবে ঢাকার বাইরে এই শিল্পের জন্য ইউটিলিটি সহায়তা বাড়াতে হবে।

অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলামের বিশ্লেষণ হলো, রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের অর্থনীতির জন্য একটা অশনিসংকেত, যা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান খাত রফতানি খাতের জন্যও অশনিসংকেত। নিঃসন্দেহে ক্ষতিকারক। ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডের অর্ডারগুলো আমরা পেয়ে থাকি। তাদের বড় দিনের উৎসবের জন্য এসব অর্ডার আসে জুলাইতে। কিন্তু গত জুলাই থেকেই আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। কিন্তু এটা চরম আকার ধারণ করে অক্টোবর থেকে। তিনি বলেন, সামনে রফতানি আরো কমে যাবে। বিজিএমইএ বলছে, তাদের অর্ডার কমে গেছে। ক্রেতারা ভারত, ভিয়েতনাম ও চায়নাতে চলে যাচ্ছে। তবে আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি না হলেও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে থাকতে পারে।

তিনি বলেন, আমাদের বড় বাজার হলো আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু এবারের নির্বাচনে পরে তারা যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে তা আমাদের জন্য ইতিবাচক কোনো ইঙ্গিত বহন করে না। এর একটা প্রভাব বাজারে পড়বে। তাদের সাথে আমাদের রফতানি ও বৈদেশিক সহায়তার বিষয় জড়িত।

সিপিডির পরিচালক (গবেষণা) ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের বিশ্লেষণ হলো, সাম্প্রতিক সময়ে কাঁচামাল আমদানি কম হয়েছে। সার্বিক রফতানিতেও রাজনৈতিক অস্থিরতার একটা প্রভাব পড়েছে। তবে রফতানি মূল্যে প্রভাব পড়েনি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সমস্যার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে এয়ারশিপমেন্ট অনেক বেশি হয়েছে। এতে করে রফতানিকারকদের লাভের পরিমাণ কমে যাওয়ার কথা। রফতানিকারকদের প্রাপ্যলাভের উপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর রাজনৈতিক অস্থিরতা যদি আরো দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে অর্ডার কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটা আশঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, ক্রেতাদের বাংলাদেশ থেকে অর্ডার অন্যত্র দেয়ার ক্ষেত্রে একটা বিবেচনায় থাকে। বড় অর্ডার অন্য দেশে চলে যাবে তা নয়। তবে ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের মানোন্নয়নে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আস্থার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। আরো নির্ভর করে, দেশে ব্যবসার পরিবেশ কতটা বিনিয়োগবান্ধব থাকবে তার উপরও।