Dr Khondaker Golam Moazzem on RMG wage

Published in Prothom Alo on Tuesday, 4 February 2014.

মজুরি না দিলেও মজুরি বাড়ানোর কথা বলে সরকারি সুবিধা ঠিকই নিয়েছেন পোশাক মালিকেরা
৩৮% পোশাক কারখানা নতুন মজুরি দেয়নি

রোজিনা ইসলাম ও শুভংকর কর্মকার

তৈরি পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ নিজেই বলছেন ঢাকা ও এর আশপাশের ৩৮ শতাংশ কারখানা এখনো নতুন মজুরিকাঠামো কার্যকর করেনি। আর চট্টগ্রামে নতুন কাঠামো অনুযায়ী মজুরি দেয়নি ৬০ শতাংশ কারখানা।

তবে শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, বর্ধিত মজুরি বাস্তবায়ন করেনি এমন কারখানার সংখ্যা আরও অনেক বেশি। বেশি মজুরি দিতে মালিকেরা গড়িমসি করছেন বলে শ্রমিকনেতাদের অভিযোগ। তাঁরা বলছেন, ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কারখানা নতুন মজুরি দিয়েছে। অনেক মালিক দিচ্ছি, দেব বলে শেষ পর্যন্ত জানুয়ারি মাসে শ্রমিকদের বর্ধিত মজুরি দেননি। আবার খরচ কমানোর অজুহাতে শ্রমিক ছাঁটাই ও নিয়োগ বন্ধ রেখে বর্ধিত মজুরির দাবিতে শ্রমিক আন্দোলন বন্ধ করার কৌশল নিয়েছেন কিছু মালিক।

নতুন মজুরি পুরোপুরি বাস্তবায়নে বিজিএমইএ নিজেদের সদস্যদের কোনো চাপ দেয়নি। যদিও ৭৬ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক অস্তিরতায় কোটি কোটি টাকা ক্ষতির পরিসংখ্যান দেখিয়ে কারখানার মালিকদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নিয়েছে সংগঠনটি। জানা যায়, খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলে আইনি বাধ্যবাধকতায় বড় ধরনের ছাড় ও ১ শতাংশ কম সুদহারে রপ্তানি উন্নয়ন সহায়তা ঋণের (ইডিএফ) অর্থ নিচ্ছেন পোশাক মালিকেরা। এ ছাড়া আরেক দাবি, পোশাকশিল্পের উৎসে কর হার শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন।

নিম্নতম মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ও জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার ও বিজিএমইএর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের তদারকি না থাকার কারণেই শ্রমিকেরা নতুন মজুরিকাঠামোর সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তদারকি ছাড়া শতভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব না।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মজুরিকাঠামো পুরোপুরি বাস্তবায়নে সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের সমন্বয়ে পর্যবেক্ষণ কমিটি করা দরকার।’

তৈরি পোশাকশ্রমিকদের নতুন মজুরিকাঠামো গত ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। জানুয়ারি থেকেই বর্ধিত মজুরি পাওয়ার কথা। তৈরি পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি এখন পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। ৫ ডিসেম্বর নতুন মজুরিকাঠামোর গেজেট প্রকাশিত হয়।

বিজিএমইএর অসম্পূর্ণ তথ্য: কতগুলো কারখানা নতুন মজুরিকাঠামো বাস্তবায়ন করেছে, আর কতগুলো করেনি—কারও কাছে এর সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে ঢাকা ও এর আশপাশের এক হাজার ২০০ কারখানার ওপর একটি জরিপ চালিয়েছে বিজিএমইএ (গত ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত)। এর মধ্যে ৭৪৪টি কারখানার (৬২ শতাংশ) শ্রমিকেরা বর্ধিত মজুরি পেয়েছেন। তবে বাকি ৪৫৬ কারখানায় নতুন মজুরি দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ ৩৮ শতাংশ কারখানায় নতুন মজুরিকাঠামো বাস্তবায়িত হয়নি।

চট্টগ্রামে আরও খারাপ অবস্থার তথ্যই দিয়েছে পোশাকমালিকদের এই সংগঠন। ২৪৭টি কারখানার তথ্য দিয়ে সংগঠনটি বলছে, এর মধ্যে ১৪৮টিই দিতে পারেনি। বাস্তবায়ন করেছে মাত্র ৯৯ কারখানা। অর্থাৎ প্রায় ৬০ শতাংশ কারখানায় বর্ধিত মজুরিকাঠামো বাস্তবায়িত হয়নি।

বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁদের দেওয়া এ তথ্য কারখানাগুলোর মজুরি দেওয়া নিয়ে সমস্যা। এর বাইরেও অনেক কারখানা আছে। ফলে এটি প্রকৃত চিত্র নয়।’ তিনি বলেন, ৩৮ শতাংশ কারখানার মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে সমঝোতা করে আগের চেয়ে ৫০০, ৭০০ ও এক হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

সিরাজুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ‘গত দুই-তিন মাসে অন্তত পাঁচ হাজার শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে। ছাঁটাইকৃতদের মধ্যে নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে যাঁরা আন্দোলন-সংগ্রাম করতেন, এমন শ্রমিকদের সংখ্যাই বেশি। নতুন নিয়োগ বন্ধ। তাই বর্ধিত মজুরি না পেলেও মূলত চাকরি হারানোর ভয়েই শ্রমিকেরা সোচ্চার হচ্ছেন না।’

অবশ্য শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বিষয়ে শহিদুল্লাহ আজিম কিছু জানেন না বলে মত দেন। বাস্তবায়ন বিষয়ে বিজিএমইএ কী করছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে সব কারখানারই খারাপ অবস্থা। কার্যাদেশ কম। তাই আমরা চাপ দিচ্ছি না। আশা করছি আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যেই সব কারখানায় নতুন মজুরি বাস্তবায়ন হয়ে যাবে।’

শঙ্কা ছিল, তবু পদক্ষেপ নেই: জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে শিল্প পুলিশ আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম এলাকার ৪৮৪টি কারখানার একটি তালিকা তৈরি করে। এসব কারখানায় প্রায় এক লাখ ১৫ হাজার ৭২৭ জন শ্রমিক কাজ করেন। অবশ্য ১৫৭ কারখানার শ্রমিকসংখ্যা উল্লেখ ছিল না।

এসব কারখানায় নতুন মজুরিকাঠামোয় বেতন-ভাতা প্রদান সমস্যা হতে পারে—এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে শিল্প পুলিশের মহাপরিচালক আব্দুস সালাম ৬ জানুয়ারি লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনটি অবহেলাতেই পড়ে থাকে।

তবে এই তালিকা ধরে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে নারায়ণগঞ্জের দশটি কারখানায় গত ২১ ও ২২ জানুয়ারি খোঁজখবর নেওয়া হয়। প্রথম আলোর নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ফতুল্লার আলী অ্যাপারেলস, টেক্স মার্ট, ইস্ট কস্ট নিটওয়্যার, আশাহী নিট অ্যাপারেলস, ম্যাপল নিটওয়্যার, এসএমএস অ্যাপারেলস ও জেএম নিটওয়্যার বর্ধিত মজুরি বাস্তবায়ন করেনি। শুধু ট্রিকট ফ্যাশন ও ডিডিএল ডিডিস ডিস্টিনেশন বাস্তবায়ন করেছে। তবে ইইসি বাংলা অ্যাপারেলস বন্ধ পাওয়া গেছে।

হয়রানির শিকার শ্রমিকেরা: মিরপুরের সাকিব গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা নতুন মজুরিকাঠামোয় বেতন পাননি। এমনকি গ্রেড অনুযায়ী শ্রমিকদের পদমর্যাদাও নির্ধারণ হয়নি। গত ২২ জানুয়ারি শ্রমিকেরা বিজিএমইএ ভবনের সামনে বর্ধিত মজুরির দাবিতে বিক্ষোভ করেন।

কারখানাটির অপারেটর শিল্পী আক্তার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘তিন ধরে মজুরি দেওয়ার কথা বললেও মালিক দিচ্ছেন না। গত মাসে আমি ২৩ ঘণ্টা ওভারটাইম করেছি।’ আরেক শ্রমিক মোমেনা অভিযোগ করেন, মালিকের লোকজন আগের মজুরি নিতে চাপ দিচ্ছেন।

ওই দিন সাকিব গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা বিজিএমইএর কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। তাৎক্ষণিকভাবে মালিক মালেক আকন্দ মজুরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি বলে সেখানকার শ্রমিক নেতারা নিশ্চিত করেছেন।

খিলক্ষেত নামাপাড়া এলাকার অরুনা ফ্যাশনে কাজ করতেন সুফিয়া খাতুন (কার্ড নম্বর ৬৪৬)। রোববার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, ব্যয় কমাতে গত ১৫ জানুয়ারি তাঁকেসহ চারজনকে ছাঁটাই করে মালিকপক্ষ। কারখানার কোনো শ্রমিককেই নতুন মজুরি দেওয়া হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক-কর্মচারী লীগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, স্টার গার্মেন্টস, এবিসি গার্মেন্টস, কটন হারভেস্ট ও দি রোজ গার্মেন্টস ডিজাইনারসহ ঢাকার অনেক কারখানার শ্রমিকেরা বর্ধিত মজুরি পাননি।

গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরাম সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, আশুলিয়া ও গাজীপুরে ছাড়া সব জায়গাতেই নতুন মজুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। শ্রমিকেরা অসচেতন হওয়ায় অনেক মালিক গ্রেড নিয়েও জালিয়াতি করছেন। সরকার শক্ত অবস্থান নিলে শ্রমিক ঠকানোর এই তৎপরতার বন্ধ হবে।