বাংলাদেশে বিদেশি সাহায্যের ভূমিকা – ফাহমিদা খাতুন

Dr Fahmida Khatun writes about the role of Foreign Aid in Bangladesh, published in The Daily Ittefaq on Thursday, 3 April 2014.

বাংলাদেশে বিদেশি সাহায্যের ভূমিকা

ড. ফাহমিদা খাতুন

অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশি সাহায্যের ভূমিকা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। বলা হয় বিদেশি সাহায্য সেসব দেশেই কার্যকর যেখানে ভাল আর্থিক, মুদ্রা ও বাণিজ্য নীতিমালা রয়েছে। অন্য পক্ষের বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, বিদেশি সাহায্য কার্যকর হওয়ার সাথে গ্রহীতা দেশের অর্থনৈতিক নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই। এ কথা অবশ্য ঠিক যে, দরিদ্র দেশগুলোর প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং নীতিমালা প্রণয়নের সক্ষমতা কম থাকার কারণে তারা বিদেশি সাহায্যের দাতাদের সাথে আলাপ-আলোচনা, এর ব্যবস্থাপনা এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে দুর্বল থাকে। কিন্তু সাহায্যের কার্যকারিতার সাথে গ্রহীতা দেশের নীতিমালার দক্ষতাকে সম্পর্কিত করলে সাহায্য ব্যবস্থার অন্যান্য দুর্বলতাগুলো ঢাকা পড়ে যায় এবং সব ব্যর্থতার দায় গিয়ে পড়ে সাহায্য গ্রহীতা দেশের ওপর। যার ফলে সাহায্য বরাদ্দের ক্ষেত্রে দাতাদের অগ্রাধিকার, সাহায্যপ্রবাহ এবং গ্রহীতা দেশের প্রয়োজনের মধ্যে ফারাক, সাহায্যপ্রবাহে অনিশ্চয়তা, দাতা ও গ্রহীতার একই পর্যায়ের জবাবদিহিতা না থাকা, বিশ্ব সাহায্য ব্যবস্থার গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়গুলো দৃষ্টির আড়ালে রয়ে যায়।
সাহায্যগ্রহণকারী দেশের নীতিমালার কারণে নয়, বরং দাতারা যেভাবে সাহায্যের প্রয়োজন নির্ধারণ করে ও অর্থ ছাড় করে মূলত সেই প্রক্রিয়াই অকার্যকর সাহায্যের জন্য দায়ী। এটি ২০০৫ সালে প্যারিস ঘোষণায় প্রথমবারের মতো স্বীকার করা হয়েছে। তবে এর আগেও বিভিন্ন ফোরামে বিদেশি সাহায্যের কার্যকারিতা বাড়ানোর ব্যাপারে ঐকমত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা শুরু হয়। ২০০২ সালে মেক্সিকোর মনটেরেতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ‘উন্নয়ন অর্থায়ন’ শীর্ষক সম্মেলনে যে ঐকমত্য হয়েছিল তাতে বিদেশি সাহায্য বাড়ানোর পাশাপাশি এর কার্যকারিতাও জোরদার করার প্রচেষ্টা চালানোর সুপারিশ করা হয়। এ ব্যাপারে আরো মনোযোগ দেয়ার কথা বলা হয় ২০০৩ সালে ইটালীর রোমে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে। এরপরে ২০০৫ সালে প্যারিস ঘোষণাতে বিদেশি সাহায্যের কার্যকারিতা জোরদার করার ওপর আরো বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।
প্যারিস ঘোষণা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের একটি প্রতিশ্রুতি, যেটি বিদেশি সাহায্যের ক্ষেত্রে সংস্কার বিষয়ক মূলনীতি হিসেবে বিবেচিত হয়। ওই ঘোষণায় বিশ্বের একশ’ জনেরও বেশি মন্ত্রী, বিভিন্ন সংস্থার প্রধান ও সংশ্লিষ্ট অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সই করেন। প্যারিস ঘোষণায় সাহায্যদাতা ও গ্রহীতা উভয়পক্ষই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যাতে বিদেশি সাহায্যের বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন সুষ্ঠু, বর্ধিত ও অধিকতর ফলপ্রসূ হয় এবং তা নির্ণয়ে তদারকির ব্যবস্থাও থাকে। বিদেশি সাহায্যের কার্যকারিতা সংক্রান্ত এই ঘোষণার মূল্যায়ন ও অগ্রগতি সাধনে পরবর্তীতে আরো কয়েকটি মাইলফলক অর্জিত হয় ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে ঘানার আক্রায় এবং ২০১১ সালের নভেম্বরে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে। এই দু’টি বৈঠকে বিদেশি সাহায্য দেয়া-নেয়ার ক্ষেত্রে প্যারিস ঘোষণার আলোকে বৃহত্তর ঐকমত্যের ওপর জোর দেয়া হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বিদেশি সাহায্য কার্যকরী হয় না? এর পেছনে প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সাহায্য প্রদান ও ব্যবহার, উভয় ক্ষেত্রেই সক্ষমতার অভাব এবং চিরায়ত দাতা-গ্রহীতা সম্পর্ক বিদ্যমান, গতানুগতিকভাবেই দাতা-গ্রহীতা সম্পর্ক অসম হয়, যেখানে একপক্ষ শক্তিশালী ও অন্যপক্ষ বেশ দুর্বল থাকে। এক্ষেত্রে দাতা দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ও স্বার্থই বেশি জোরালো থাকে। যে কারণে সাহায্যগ্রহীতা দেশের সামনে পছন্দের স্বাধীনতা খুবই কম থাকে। উপরন্তু বিভিন্ন সময়ে বিদেশি সাহায্য ব্যবস্থায় নানা ধরনের সংস্কার হচ্ছে। কিন্তু ওইসব সংস্কারে সাহায্যগ্রহণকারী দেশের মতামত খুব কমই প্রতিফলিত হয়েছে। যে কারণে গ্রহীতা দেশে বিদেশি সাহায্যের কার্যকারিতাও জোরদার হতে পারছে না। সাহায্য ব্যবস্থায় দাতাদের দিক থেকে সাহায্যগ্রহণকারী দেশগুলোর সম্পৃক্ততাকে তেমন একটা উত্সাহিত না করাটাও এজন্য আংশিকভাবে দায়ী। তবে এটিও সত্য যে, আন্তর্জাতিক সাহায্য ব্যবস্থায় গ্রহীতা দেশগুলো অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেও নিজেদের মতামত তেমনভাবে তুলে ধরতে পারছে না। সাহায্যের কার্যকর ব্যবহারের প্রশ্নে তাদের সক্ষমতার অভাব রয়েছে। তবে শুধু গ্রহীতাদেরই নয়, দাতাদের মধ্যেও প্রতিশ্রুতি পূরণের ক্ষেত্রে সক্ষমতার দুর্বলতা আছে। দাতারা কোনো দেশকে সাহায্য দেয়ার সময়ে সেখানকার স্থানীয় ব্যবস্থার কথা বিবেচনা করে না। যে কারণে দাতাদের সদর দপ্তরের নীতিমালার সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতায় অনেক তফাত্ থেকে যায়।

বাংলাদেশে বিদেশি সাহায্যপ্রবাহের ধারা ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিবর্তনটা শুধু সাহায্যের উত্স ও পরিমাণেই ঘটছে না, খাতভিত্তিক বরাদ্দ এবং ব্যবহারের দিক থেকেও তা হচ্ছে। বিগত প্রায় দুই যুগে বিশ্ব অর্থনীতির সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্পৃক্ততা জোরদার হয়েছে। আমদানি, রপ্তানি, বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রবাসী আয়ের বর্ধিত অংশ সেটিই ইঙ্গিত করে। যার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিদেশি সাহায্যের আনুপাতিক অংশ অনেক কমে গিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮১ সালে মোট দেশজ উত্পাদনে (জিডিপি) বিদেশি সাহায্যের অংশ ছিল শতকরা ৫.৮ ভাগ, ২০১৩ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২.২ শতাংশ। বিদেশি সাহায্যের অংশ অর্থনীতিতে কমে আসলেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে এর অংশ দেশীয় উত্স থেকে অর্থায়নের প্রায় সমান। মোট সাহায্যের সিংহভাগই আসে প্রকল্প সাহায্য বাবদ। বাংলাদেশে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন এবং সামাজিক খাতের উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিদেশি সাহায্যের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
তবে বিদেশি সাহায্যের ভূমিকা ও কার্যকারিতা নিয়ে বাংলাদেশেও বিতর্ক এবং দ্বিধা রয়েছে। যার ফলে বিদেশি সাহায্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ও দারিদ্র্য বিমোচনে প্রকৃত অর্থে কতখানি ভূমিকা রাখছে তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। কখনো কখনো সাহায্যদাতাদের উপস্থিতি অর্থনৈতিক নীতিমালার সাথে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও বিস্তৃত হয়। বাংলাদেশের সুশাসন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নে দাতাদের বক্তব্য এখন নিয়মিত ব্যাপার। একদিকে শর্তের বেড়াজাল, অন্যদিকে সাহায্যপ্রবাহ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণার অভাব, দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সমন্বয়হীনতা ইত্যাদি কারণে সাহায্যের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে সাহায্য বরাদ্দের ক্ষেত্রে দারিদ্র্য ও উন্নয়ন প্রাথমিক মাপকাঠি নয়। বরং রাজনৈতিক, কৌশলগত এবং উন্নয়নের উদ্দেশ্য বিবেচনা করেই সাহায্য দেয়া হয়। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অনেক সময় দাতাদের হস্তক্ষেপের প্রবণতা থাকে। বিশ্ব অর্থনীতিতে অর্থায়নের উত্স হিসেবে অন্যান্য খাত যেমন অভ্যন্তরীণ সম্পদ সঞ্চালন, রেমিটেন্স, বিদেশি বিনিয়োগ ইত্যাদির তুলনায় বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ ইতিমধ্যেই কমে এসেছে। অপরদিকে যুদ্ধ-সংঘাতে জর্জরিত দেশগুলোর আর্থিক চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। এই প্রেক্ষিতে একদিকে বিদেশি সাহায্যের প্রবাহ বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে সংকুচিত হয়ে আসবে। অন্যদিকে সাহায্য ব্যবহারের ওপর নজরদারি ও কর্তৃত্ব বাড়বে। এরকম পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে বিদেশি সাহায্যের বাইরে অন্যান্য আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে সম্পদ সঞ্চালন করার প্রয়াস জোরদার করতে হবে।

লেখক :অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)