Interview: Dr Fahmida Khatun speaks to Samakal

Dr Fahmida Khatun was interviewed as regards economic development, published in Samakal on Wednesday, 2 October 2013.

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : অজয় দাশগুপ্ত
সমকাল :প্রবৃদ্ধি, রেমিট্যান্স, রিজার্ভ, খাদ্যশস্য উৎপাদন_ অর্থনীতির অনেক সূচক ইতিবাচক। তারপরও অর্থনীতি নিয়ে বিশ্লেষকদের হতাশাই বেশি ব্যক্ত হচ্ছে কেন? উদ্যোক্তারাও কেন হতাশ?
ফাহমিদা :গত ১০ বছরে বাংলাদেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশ, যা উৎসাহব্যঞ্জক। তবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলিত হারের চেয়ে কম। যেমন ২০১৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ২%। অর্জনের হার ৬ দশমিক ০৩ %। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি ছিল ১৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। ২০১৩ অর্থবছরে রফতানি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার কিছু কম হলেও এই হার দুই অঙ্কের ওপরে। জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে শ্লথগতির কারণে সম্প্রতি রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির হার নেতিবাচক। তবে অর্থনীতির বেশ কিছু সূচকের গতি-প্রকৃতি ভালো হলেও হতাশার দিকটি হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বেগবান করতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার, সেটি অর্জনে ব্যর্থতা। সাম্প্রতিককালে সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও ব্যক্তি খাত ও বিদেশি বিনিয়োগ আশাব্যঞ্জক নয়। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অপর্যাপ্ততা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ইত্যাদি কারণে বিনিয়োগ-জিডিপি হার ২৫ শতাংশের মধ্যেই আটকে রয়েছে। তার ওপর রয়েছে দুর্নীতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতি এবং সুশাসনের অভাব। এসব কারণে সম্ভাবনাময় ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়বেন_ এটিই স্বাভাবিক।
সমকাল : নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা বলছেন, তাদের ঋণ পাওয়া কঠিন। ব্যাংকে তারল্য পরিস্থিতি ভালো। কিন্তু এটা কি ঋণ গ্রহণ কঠিন হয়ে ওঠার কারণে?
ফাহমিদা :সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্টম্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার ফলে ব্যাংক ঋণের সুদহার অনেক বেশি। এটি উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করছে। তাছাড়া বেশ কিছু বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানে কিছুটা সতর্ক। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে উদ্যোক্তারাও সতর্কমূলক অবস্থান নিচ্ছেন।
সমকাল : তৈরি পোশাকশিল্প সমস্যায় বলে উদ্যোক্তারা দাবি করছেন। আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর শঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। অন্যদিকে, শ্রমিকরা মজুরি বাড়ানোর দাবিতে সোচ্চার। চায় কাজের পরিবেশের উন্নতি। এ শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে কি অনিশ্চয়তা রয়েছে?
ফাহমিদা : তৈরি পোশাকশিল্প খাতে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি এবং তাদের কর্ম-পরিবেশ উন্নয়নের দাবি অনেক দিনের। রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর এই দাবি শক্তিশালী হয়েছে। এ খাতকে প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারে টিকতে হলে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি কারখানা মানসম্মত হতে হবে। এতে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা হারানোর যে ভয় করা হচ্ছে তা অনেকটাই মেটানো যাবে শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে। শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণের প্রতি অবশ্য খুব একটা নজর নেই। বর্তমানে বিভিন্ন মহল থেকে যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত এবং পরিপালিত হচ্ছে কি-না সেজন্য তদারকি ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে।
সমকাল :খেলাপি ঋণ নিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলো সমস্যায়। তাদের পরিচালনা পরিষদের কাজ নিয়ে প্রশ্ন আছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারি থেকে সরকারি ব্যাংকগুলো কি যথাযথ শিক্ষা নিয়েছে? বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি কেমন?
ফাহমিদা :রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আমাদের দেশে একটি চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাংকগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একদিকে যেমন দরকার দক্ষ ও গতিময় মানবসম্পদ, আধুনিক প্রযুক্তি এবং জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা, তেমনি প্রয়োজন যোগ্য, সৎ এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিচালনা পর্ষদ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করাটা অনেকাংশেই রাজনৈতিক পুরস্কার দেওয়ার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দলীয় আনুগত্যের ঊধর্ে্বর্ উঠে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা তাদের পক্ষে কষ্টকর হয়। এই সুযোগে বিভিন্ন ধরনের বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। আরও দুঃখজনক হচ্ছে, এই ঘটনাগুলোর সঠিক তদন্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের দ্বৈত তদারকি বন্ধ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শাসন ব্যবস্থা বাড়ানোর কথা আলোচিত হয়েছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে অনিয়ম দেখলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু তার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চাকরিচ্যুত করার ক্ষমতা লাভ করেছে কিছুদিন আগে। কিন্তু ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সদস্যদের সরাতে পারবে না। সেটির দায়িত্ব সরকারের হাতে থাকবে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বস্তুত তদারকি ব্যবস্থা জোরদার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে অনিয়ম রোধ করা সম্ভব নয়।
নতুন ব্যাংকগুলোর সম্ভাবনার ব্যাপারে দুটি কথা বলব_ এক. আমাদের আর্থিক বাজারের যে আকার এতে নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন ছিল না। বিদ্যমান ব্যাংকগুলোরই অনেকটার অবস্থা ভালো নয়; দুই. এখন যখন নতুন ব্যাংক এসেই গেল তখন তাদেরকে বাজারে প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকার চেষ্টা করতে হবে। তারা গ্রাহকদের কী ধরনের সেবা দেবে, নতুন নতুন কী ধরনের ব্যাংকিং পণ্যসামগ্রী বাজারে নিয়ে আসবে, ঝুঁকি সামলানোর ক্ষমতা কতটুকু ইত্যাদির ওপরই নির্ভর করবে তাদের টিকে থাকা-না থাকার বিষয়। তবে ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে এখনও বিরাট জনগোষ্ঠী রয়ে গেছে। তাদেরকে আর্থিক সেবা খাতের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত করা যায় সেটিই হওয়া উচিত এখন মূল লক্ষ্য।
সমকাল :সাধারণ নির্বাচন সামনে থাকায় বিনিয়োগ উদ্যোগে কি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে?
ফাহমিদা :তা তো অবশ্যই। যেটি আগেই বলেছি, নির্বাচনের বছরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বিনিয়োগকারীরা অনাগ্রহী থাকে। তখন বিদ্যুৎ, গ্যাস, রাস্তাঘাটের চাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় তাদের অর্থের নিশ্চয়তা ও সম্পদের নিরাপত্তা। তদুপরি বিনিয়োগকারীদের আরেকটি শঙ্কা থাকে যে, সরকার বদল হলে নীতিমালা বদল হবে কি-না, তাতে তাদের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি-না। নীতিমালার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা বিনিয়োগ এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জরুরি।
সমকাল :জিডিপির নতুন ভিত্তি বছর হয়েছে। এতে জিডিপির পরিমাণ ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে। অর্থনীতির প্রতি আস্থ্থা বৃদ্ধিতে এটা সহায়ক হবে কি?
ফাহমিদা :জিডিপি হিসাবের ভিত্তি বছর পরিবর্তন হওয়াটা নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সাল, ১৯৮৪-৮৫ সাল এবং ১৯৯৫-৯৬ সালকে ভিত্তি বছর ধরে জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়েছে। এখন সর্বশেষ ২০০৫-০৬ সালকে ভিত্তি বছর ধরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো নতুন করে জিডিপি প্রাক্কলনের আওতা বৃদ্ধি ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন করেছে। এর পেছনে যুক্তি হচ্ছে যে, বাজারে বিভিন্ন ধরনের নতুন পণ্য ও সেবা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে জনগণের ভোগের পরিবর্তন হয়েছে। তাছাড়া পণ্য ও সেবার মানে পরিবর্তন এসেছে এবং পণ্য ও সেবার তুলনামূলক কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। ফলে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বেড়েছে জিডিপি। আর মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ১০৪৪ মার্কিন ডলার। এতে আমাদের ভালো লাগারই কথা। কিন্তু অর্থনীতির প্রতি আস্থা বৃদ্ধির বিষয়টি এর সঙ্গে জড়িত বলে আমি মনে করি না। এর পেছনে কয়েকটি যুক্তি রয়েছে। প্রথমত, জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলেও এটি অর্থবহ হবে না যদি অর্জিত প্রবৃদ্ধির সুফল সঠিকভাবে বণ্টিত না হয় এবং প্রবৃদ্ধি যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয়। যদি দেশের ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ লোক চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে; যদি ওপরের ৫ শতাংশ লোকের হাতে থাকে দেশের মোট সম্পদের ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ আর নিচের ৫ শতাংশ লোকের হাতে থাকে মাত্র ০ দশমিক ৭৮ শতাংশ, তাহলে মাথাপিছু আয় ১০০ কি ২০০ ডলার বাড়ল কি বাড়ল না তাতে কী এসে যায়? তদুপরি মাথাপিছু আয় হিসাব করার পদ্ধতিটিই যদি হয় ধনী এবং গরিব লোকদের গড় আয় হিসাব করা তাহলে তো সেটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরছে না। দ্বিতীয়ত, অর্থনীতিতে আস্থা আনতে হলে দেখতে হবে বর্ধিত জিডিপির ফলে বিনিয়োগ কতটুকু বাড়ল, কতজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলো, কতজন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ পেল, সামাজিক সুরক্ষার আওতায় কতজনকে আনা গেল ইত্যাদি। তবে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক আস্থা স্থাপন করা। সেটি নিশ্চিত করা গেলে অন্যান্য সমস্যা সমাধান করা সহজতর হবে।
সমকাল :শেয়ারবাজারে যেসব সমস্যা বিদ্যমান তার সমাধানে নতুন মুদ্রানীতি সহায়ক হবে কি? এ বাজার সংস্কারের জন্য তদন্ত কমিটি যেসব সুপারিশ করেছিল, তার কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে?
ফাহমিদা :শেয়ারবাজারে ধসের মাধ্যমে বিদ্যমান নীতিমালার দুর্বলতা এবং প্রচলিত কর্মকাণ্ডের অনিয়ম প্রকাশিত হয়েছে। শেয়ারবাজারে অনিয়ম বন্ধ করা এবং একে চাঙ্গা করার জন্য যে সুপারিশগুলো করা হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা ও প্রশাসনের মধ্যে কর্মকাণ্ড বিভক্তিকরণ, প্রশাসকদের মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর চাহিদা বৃদ্ধি, ইকুইটি ও বন্ডের সরবরাহ এবং চাহিদা বৃদ্ধি করা। এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শেয়ারবাজারে ধসের প্রায় তিন বছর অতিবাহিত হলেও সেখানে কোনো প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসছে না সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতি আশানুরূপ না হওয়ার কারণে। তাই শেয়ারবাজারে যে ধস নেমেছে, তা থেকে সহসা পরিত্রাণ পাওয়া কষ্টকর। এখানে মুদ্রানীতির চাইতেও বড় নিয়ামক হচ্ছে আস্থা। যে প্রক্রিয়ায় গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারবাজারের অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের যে উদ্যোগ ও ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়েছে, তাতে শেয়ারবাজারের ওপর থেকে সবার আস্থা উঠে গেছে। এখানে দৃঢ় রাজনৈতিক সংকল্প না থাকলে কোনো নীতি দিয়েই কিছু হবে না।