Op-Ed: What’s required in the FY2015 Budget and Why – Fahmida Khatun

Published in The Ittefaq on Thursday, 5 June 2014.

এবারের বাজেট কি চাই, কেন চাই

ড. ফাহমিদা খাতুন

আজ জাতীয় সংসদে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করা হবে। বর্তমান সরকারের শাসনামলে এ বছর নির্বাচনের পর এটি তাদের প্রথম বাজেট। সেদিক থেকে হয়তো অনেকেই তাকিয়ে রয়েছেন বাজেটে কি থাকছে। তবে বাজেটের আকার, আয়-ব্যয়, খাতভিত্তিক প্রাধান্য এমনকি বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ওপর কি হারে কর আরোপ করা হবে সে রকম অনেক তথ্য আমরা ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে জানতে পেরেছি। চলতি ২০১৪ অর্থবছরের চাইতে ২০১৫ অর্থবছরের আকার শতকরা ষোল ভাগ বড় হবে এবং এর পরিমাণ হবে ২,৫০,৫১০ কোটি টাকা। অগ্রাধিকার প্রাপ্ত খাতগুলোর মধ্যে অবকাঠামো অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

আসন্ন বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে ইতিমধ্যেই আলোচনা হচ্ছে। আর্থিক কাঠামো এবং বাজেটের বাস্তবায়ন—দু’টি বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিভাত হচ্ছে। যে অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ২০১৫ অর্থবছরের বাজেটটি প্রণীত হয়েছে সেটির মূল লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং বাজেট ঘাটতি কম রাখা। তবে বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা যাই থাকুক সুচারুভাবে বাস্তবায়নই বড় কথা। প্রতি অর্থবছরের শেষে বাজেটের বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো নিম্নমুখী সামঞ্জস্য বিধান করা একটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বাজেটের সরকারি ব্যয়, রাজস্ব আহরণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে যে হিসাব-নিকাশই বাজেটে উপস্থাপন করা হোক না কেন তা এখন অনেকটাই আবেদন হারিয়ে ফেলেছে, যেহেতু অর্থবছরের শেষে এসে সেই সংখ্যাগুলো বদলে যায়। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে অংকের হিসেবে গরমিল হতেই পারে। কিন্তু তার পরিমাণ কতখানি? দ্বিতীয় বিষয়টি হলো ক্রমান্বয়ে লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে আসার ফলে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে যে লক্ষ্যগুলো নির্ধারণ করা হয় সেগুলোর অর্জনও পেছাতে থাকে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে শতকরা আট এবং তার ওপরে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এখনো আমরা শতকরা ছয় শতাংশের মধ্যে আটকে রয়েছি। ২০১৪ অর্থবছরের প্রথমভাগে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে উত্পাদন, পরিবহন এবং সেবাখাতের কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দ্বিতীয়ভাগে এসে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ প্রেক্ষিতে আমাদের অর্থনীতির যে সমস্ত শক্তির দিকগুলো রয়েছে সেগুলো কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ত্বরণ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। সরকারি বিনিয়োগ ক্রমান্বয়ে বাড়লেও ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগে গতি সৃষ্টি হচ্ছে না। অন্যদিকে সরকারি বিনিয়োগের গুণগতমানও সবসময় নিশ্চিত করা যায় না। কেননা অনেক প্রকল্প অর্থনৈতিক বিবেচনায় নেয়া হয় না। অবকাঠামোগত দুর্বলতা তো রয়েছেই। রাস্তাঘাট, ব্রীজ, গ্যাস ও বিদ্যুতের অপ্রতুলতা এখনো বিরাজমান। কিন্তু বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে বেশি যেটি প্রয়োজন তা হলো বিনিয়োগ করার জন্য আস্থা। ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগে গতিময়তা না থাকার ফলে বর্ধিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রতিবছর বিশ লাখ নতুন শ্রমশক্তি প্রবেশ করছে। এই বিশাল শ্রমশক্তিকে শুধু রাষ্ট্রীয় খাতে নিয়োগ দেয়া সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করে বিশাল কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি। কর্মসংস্থানের অভাব হলে তা একদিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হরাস করে এবং ব্যক্তিখাতের ভোগ কমে যায়। যার ফলে তা জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে প্রকারান্তরে ব্যাহত করে। অন্যদিকে বেকারত্বের সংখ্যা না কমালে দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব নয়, আয় বৈষম্য ঘুচানো সম্ভব নয়। কর্মহীন, আয়হীন জনগোষ্ঠী হতাশাগ্রস্ত হয়ে অনেকসময় নেতিবাচক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ে যা সামাজিক শৃংখলা নষ্ট করে। অন্যদিকে বিশাল জনগোষ্ঠী অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে উত্পাদনশীল ও আয়বর্ধক কাজে নিয়ে আসতে হলে প্রচুর বিনিয়োগ দরকার। তাছাড়া যে সমস্ত সামাজিক সূচক অর্জনের জন্য আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চাঙ্গা না থাকলে সেগুলো অর্জনও বাধাগ্রস্ত হবে। মানসম্মত শিক্ষার হার বাড়ানো, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, মাতৃমৃত্যু হার কমানো, স্বাস্থ্যসেবার আওতা ও মান বৃদ্ধি ইত্যাদি ক্ষেত্রে অগ্রগতি লাভ করলে তা অর্থনৈতিক উন্নয়নেও অবদান রাখবে। আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই করতে হলে সামাজিক সূচকগুলোর উন্নয়ন অপরিহার্য। তদুপরি রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করা। যার জন্য প্রয়োজন অর্থ ও প্রযুক্তি। যদিও এর জন্য উন্নত বিশ্বের দায়বদ্ধতা রয়েছে এবং অর্থ ও প্রযুক্তি আন্তর্জাতিক উত্স থেকেই আসতে হবে কিন্তু আমাদের নিজেদেরও পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এসব দিক বিবেচনা করলে বাজেটের সংখ্যা নিয়ে যুক্তিতর্ক করাটা অর্থহীন। কেননা বাজেটে একটি অর্থবছরের যে হিসাব দেয়া হয় তার আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করা। সেটি করতে হলে মানসম্মতভাবে বাজেটের বাস্তবায়ন অপরিহার্য। কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য যদি বাজেটের আকার ছোট রাখতে হয় তাহলে ক্ষতি কি? অভীষ্ট লক্ষ্য যদি হয় সুচারুরূপে বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনীতিতে গতিশীলতা বজায় রাখা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, সামাজিক সুরক্ষা সৃষ্টি করা, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সামাল দেয়া—তাহলে বাজেটের মানটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক :অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)