FY2015 Budget: Revenue collection target challenging – Mustafizur Rahman

Published in Shokaler Khobor on Sunday, 8 June 2014.

রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে – মোস্তাফিজুর  রহমান

প্রস্তাবিত ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার এবং রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েই বেশি কথা হচ্ছে। বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জন কঠিন হবে। প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নও কঠিন হবে সরকারের জন্য। বাজেট বাস্তবায়নে সামনে বেশ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে সরকারকে। বাজেটে আয়-ব্যয়ের যে বিষয়গুলো সন্নিবেশ করা হয়েছে তা বাস্তবভিত্তিক নয়। বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জিত হবে কি না সন্দেহ রয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যয়ের আকার বা বাজেটের আকার সর্বকালের সবচেয়ে বড়। একইভাবে বাজেটে আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটিও একটি রেকর্ড। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দুটি ক্ষেত্রেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। তবে দুটিই যদি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো হবে। বাজেটে আয়-ব্যয়ের বিষয়গুলো এমনভাবে করা হয়েছে, যা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। চলতি অর্থবছর এনবিআরের মোট রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকা কম হতে পারে। এ অবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এনবিআরকে ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। এ বছর দেশের রাজস্ব আদায় এক ধরনের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। কর-বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ও কম হয়েছে। আয়করের ওপর এবার গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে করব্যবস্থা দাঁড়ানো উচিত।

বাজেটে ৬৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক ও বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার কথা বলেছে। ঘাটতি মোকাবেলায় বৈদেশিক অনুদান ও সাহায্যের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪০০ কোটি ডলার। নিট হিসাবে পেতে হবে ৩০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনই ৪০০ কোটি ডলার পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় নতুন এই অর্থায়নটা কীভাবে হবে, তা আশ্চর্য মনে হচ্ছে। ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার পর ও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করার পর যেটুকু বাকি থাকে সেই হিসাব মেলানো হয়েছে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রায়। বর্তমানে ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলার বৈদেশিক সাহায্য পাইপলাইনে আছে। এগুলো প্রতিশ্রুত অর্থ। ব্যবহারের হার যদি বাড়ে, তাহলে এই টাকাও বেশি পাওয়া যাবে। তবে অভিজ্ঞতা বলে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যখন ভালো থাকে তখনও পাইপলাইনের ১৭-১৮ শতাংশ পর্যন্ত বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যায়। কিন্তু সরকার বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার যে লক্ষ্য ঠিক করেছে, তা অর্জন করতে হলে পাইপলাইনে থাকা সাহায্যের ২২ শতাংশ পেতে হবে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতি বাড়িয়ে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া নিয়ে তাই সংশয় থাকা যৌক্তিক। এটা অর্জন করা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হবে।

ভর্তুকির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে অনুসরণ করছে সরকার। মোট ভর্তুকি বরাদ্দ কমানো হয়েছে ১৮ দশমিক ২ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে ভর্তুকি ধরা হয়েছে জিডিপির ২ শতাংশ। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরে এ হার ছিল জিডিপির ২ দশমিক ৭ শতাংশ। কৃষি ভর্তুকি ৯ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কম থাকায় এ পরিমাণ অর্থ ব্যবহার করতে হবে। ফলে কৃষি ভর্তুকি ৪ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা ব্যবহার হতে পারে।

বাজেটে প্রবৃদ্ধির ৭ দশমিক ৩ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে বেশি প্রয়োজন বিনিয়োগ। সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ পতনের ধারায়। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের হার এখন ২১ শতাংশ। প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য সেটাকে ২৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। এ জন্য আরও ৪-৫ শতাংশ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এই বিনিয়োগের পরিমাণ হবে টাকার অঙ্কে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এই বিনিয়োগ কীভাবে হবে? দেশে যেখানে এক বছরে কখনই দেড় থেকে দুই শতাংশের বেশি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়নি। এমন নয় যে, গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই দেশে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কমেছে। এই অবস্থা শুরু হয়েছে ২০১২-১৩ অর্থবছরের শেষ ছয় মাস থেকে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে উত্সাহী করতে উদ্যোগ দেখা যায়নি। আগামী অর্থবছরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকবে কি না তা-ও অনিশ্চিত। যদিও অর্থমন্ত্রী ধরে নিয়েছেন দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকবে। এসব কারণেই সিপিডি বেশ কিছুদিন ধরেই সমঝোতামূলক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কথা বলে আসছে।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে। এখানে শৃঙ্খলা না আনা গেলে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দের সুফল সাধারণ মানুষ পাবে না। পরিকল্পনা কমিশন ৩০৫টি প্রকল্পকে চলতি অর্থবছরে শেষ করা হবে বলে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু সেখানকার ১১০টি প্রকল্প শেষ হয়নি। আগামী অর্থবছরেও এর কাজ চলবে। এডিপির মোট বরাদ্দের অর্ধেকই ৩৫২টি প্রকল্পে দেওয়া হয়েছে। এডিপির প্রকল্পগুলোর মূল্যায়ন হয় ব্যয় হল কী হল না এর ভিত্তিতে। কিন্তু এই খরচের ফলে জনগণের কোনো উপকার হল কি না, তার ভিত্তিতে মূল্যায়ন হচ্ছে না।

কালো টাকায় অর্থমন্ত্রীর নীরবতা : কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। যদিও বাজেটপরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আর থাকছে না। দ্রুত পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করাই সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ করলে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ পড়বে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষিসহ অন্যান্য অগ্রাধিকার খাতে বরাদ্দ কমে যাবে। এ সরকার বা আগামী সরকারকে অবশ্যই বন্ড ছেড়ে ও পুঁজিবাজার থেকে পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

অর্থমন্ত্রী বাজেট ঘোষণার আগে একবার বললেন, আগামী অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে না। এর কিছু দিন পর তিনিই আবার সুযোগ থাকার কথা বললেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, প্রস্তাবিত বাজেটে এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। তিনি নীরবতা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সমর্থন দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। একদিকে কর ও এর আওতা বাড়ানো হবে, অন্যদিকে কালো টাকার মালিকদের বিশেষ সুযোগ দেওয়া হবে-এটা অন্যায় ও অনৈতিক।

প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বাজেটে সরকার ৭.৩ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত এ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে যে পরিমাণ বিনিয়োগ ও পুঁজির উত্পাদনশীলতা দরকার, তা নেই। গত কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ একই স্থানে অর্থাত্ জিডিপির ২৫ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। এটাকে ৩১ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। কিন্তু সে চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া আগামী বছর মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু এই হার ৭ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জই হবে। অন্যদিকে উন্নয়ন সহযোগী থেকে ঋণ পাওয়া কঠিন হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে শুধু জিডিপি নয়, আমদানি ও রফতানির যে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন করাও কঠিন হবে। তিনটি ক্ষেত্রেই বর্তমান বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে থেকে হঠাত্ করে কীভাবে গতি বাড়বে, তা বোধগম্য নয়।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা, বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতি এবং বাজেট বাস্তবায়নের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা- এসবের আলোকে কোনো এক সময়ে গিয়ে এ বাজেট সংশোধন করতে হবে। এ বাজেটের অনেক অংশই আছে, যা থেকে মনে হয়েছে এ বাজেট লক্ষ্য-বিলাসের বাজেট। আয়ও আছে, ব্যয়ও আছে, কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন না-ও হতে পারে। বাস্তবতার নিরিখে এ বাজেটকে সংশোধন করতে হবে। তবে বাজেটের কিছু পদক্ষেপ ভালো বলেও উল্লেখ করেন তিনি। করমুক্ত আয়সীমা ২ লাখ টাকা থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টাকার প্রস্তাবটি ভালো দিক।

বাজেট বাস্তবায়নে সমঝোতামূলক রাজনৈতিক আবহ তৈরি করতে হবে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বিশ্বব্যাংকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশের অন্তত ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যর্থ হলে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। এ জন্য বিনিয়োগকারীদের আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিদ্যমান কারখানার জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়লেও নতুন শিল্প-কারখানার জন্য মেয়াদি ঋণ বাড়ছে না।

লেখক : সিপিডির নির্বাহী পরিচালক