Govt should focus on strengthening capacity to implement big budget: Dr Debapriya Bhattacharya

Published in কালের কন্ঠ  on Thursday, 2 June 2016

বাস্তবায়ন হয় না তবু বড় বাজেট

আবুল কাশেম ও আরিফুর রহমান  

১৯৮২ সালে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) তৈরির দায়িত্বে ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন ৫৩৩ জন। গত ৩৪ বছরে এডিপির বরাদ্দ বেড়েছে ৩৭ গুণ। কিন্তু ইকোনমিক ক্যাডারে পদসংখ্যা একজনও বাড়েনি। এই তিন যুগে প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্পৃক্ত কর্মকর্তার সংখ্যাও বাড়েনি। যাঁরা আছেন, তাঁদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা উইংও নেই। ফলে প্রকল্প অনুমোদনে দেরি হয়, মানসম্মত প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি হয় না। এই ৫৩৩ কর্মকর্তার ওপর এডিপি বাস্তবায়নের সাফল্য-ব্যর্থতা অনেকাংশেই নির্ভর করে। তাঁদের ওপর ভর করেই আজ জাতীয় সংসদে পেশ হতে যাওয়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরের এডিপিতে এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন করতে প্রতিদিন একজন কর্মকর্তাকে গড়ে ২০৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকার প্রকল্প তৈরি, সংশোধন, অনুমোদন ও নজরদারির প্রক্রিয়া করতে হবে। ফলে উন্নয়নকাজের গুণগত মান নিশ্চিত হয় না, পুরো টাকাও খরচ করা যায় না। এ জন্য প্রতিবছরই প্রস্তাবিত বাজেট কমিয়ে সংশোধন করা হয়। তাও খরচ না হওয়ায় প্রকৃত বাজেটের আকার আরো কমছে। এ তথ্য পরিকল্পনা বিভাগের সচিব তারিক-উল ইসলামের।

এ অবস্থার মধ্যেই আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তিন লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। এটি চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৪৫ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা বেশি। প্রতিবছরই বিপুল আশা নিয়ে আগের বছরের চেয়ে বড় অঙ্কের বাজেট দেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু অর্থবছর শেষে বাস্তবায়ন না হওয়ায় তা দুই দফায় কাটতে হয় তাঁকে। চলতি অর্থবছরে দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন, বাস্তবায়ন করতে না পারায় গত মাসে তা কমিয়ে দুই লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। আর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে প্রকৃতপক্ষে বাস্তবায়ন হয়েছে এক লাখ চার হাজার ২৩১ কোটি টাকা। ফলে নতুন যে বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী, সেখানেও অবধারিতভাবে অর্থবছর শেষে উল্লেখযোগ্য অংশ কাটতে হবে। তাতে সংশোধিত বাজেট বা প্রকৃত খরচের আকার তিন লাখ কোটি টাকার ঘরে নেমে আসবে বলে মনে করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ঘোষিত বাজেট যে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, তা জানেন বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত মন্ত্রী ও আমলারা। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বাহবা নেওয়ার জন্য প্রতিবছরই বাজেটের আকার বিপুল হারে বাড়ানো হচ্ছে। একইভাবে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাও ধরা হচ্ছে আকাশছোঁয়া। চলতি অর্থবছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) এক লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। তা সম্ভব না হওয়ায় গত মাসে কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকা। তা সত্ত্বেও আগামী অর্থবছরের জন্য বড় বাজেট দিতে গিয়ে এনবিআরকে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে দুই লাখ তিন হাজার ১৫২ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন না হওয়ায় চলতি অর্থবছর ৯৭ হাজার কোটি টাকার এডিপি মে মাসে ৯১ হাজার কোটিতে নামানো হয়েছে। নতুন অর্থবছরে সেখানে বরাদ্দ রাখা হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

বড় বাজেট দেওয়ার পর তা বাস্তবায়ন না হওয়া সত্ত্বেও পরের বছর বাজেটের আকার আরো বাড়ানোর পেছনে যুক্তি রয়েছে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের। তিনি বলেন, বাজেট শতভাগ বাস্তবায়ন না হলেও প্রায় ৯০ শতাংশ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এক লাখ টাকার বাজেটের ৯০ শতাংশ বাস্তবায়ন আর তিন লাখ কোটি টাকার বাজেটের ৯০ শতাংশ বাস্তবায়ন এক কথা নয়। শতাংশ হিসাবে বাস্তবায়নের হার একই সমান হলেও টাকার অঙ্কে বাস্তবায়ন বাড়ছে। উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বড় বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির যে পরিধি, তার সঙ্গে তুলনা করলে বাজেটের আকার বড় কিংবা উচ্চাভিলাষী নয়, বরং ছোট। বাজেটের আকার আরো বড় হওয়া উচিত। কিন্তু বাজেট বাস্তবায়ন যদি না হয়, তাহলে বড় আকারের বাজেট ঘোষণা করে লাভ কী। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও মনে করেন, বাংলাদেশে বাজেটের আকার আরো বড় হওয়া উচিত। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তিনি স্বীকার করেন, বাজেট বাস্তবায়নে এখনো সক্ষমতা বাড়েনি।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের মতো একটি অনুন্নত দেশের বাজেটের আকার হওয়া উচিত মোট দেশজ উৎপাদনের ২০ শতাংশের ওপরে। কিন্তু এখন বাজেটের আকার জিডিপির মাত্র ১৭ শতাংশ। এটি আরো বাড়ানো উচিত। কিন্তু শুধু বাজেটের আকার বাড়ালে তো হবে না, সেই টাকা খরচ করার সক্ষমতা থাকতে হবে।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখতে হবে। একই সঙ্গে রাজস্ব আহরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদেরও প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে এডিপি বাস্তবায়নের হার ও গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ের হারও বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, যেটা অর্জন করা সম্ভব নয়, সেটা প্রাক্কলন না করাই ভালো। বৈদেশিক অর্থের ব্যবহার বাড়ানো, রাজস্ব আহরণ ও এডিপি বাস্তবায়নে জড়িতদের প্রণোদনা দেওয়া এবং এসব বিভাগে সংস্কার আনতে পারলে বাজেট বাস্তবায়ন বাড়বে।

অর্থ বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে দেশে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ছিল দেড় হাজার কোটি টাকা। চার দশকের ব্যবধানে সেই আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ৪০ বছরে এডিপিতে বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় ১০০ শতাংশ। তবে আকার বাড়লেও যেসব মন্ত্রণালয় ও কর্মকর্তারা এডিপি বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতে কোনো সরকারই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বাড়েনি জনবল। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো একটি বড় প্রকল্প তৈরিতে হিমশিম খেতে হয় কর্মকর্তাদের; সহযোগিতা নিতে হয় উন্নয়ন সহযোগীদের। দিনের পর দিন এমনকি বছরও পেরিয়ে যায় একটি প্রকল্পের ডকুমেন্ট তৈরিতে। যুগোপযোগী করা হয়নি মান্ধাতা আমলের চিন্তা-চেতনায় তৈরি করা ১৯৮২ সালের ভূমি অধ্যাদেশ। ভূমি অধ্যাদেশ সংশোধন না করায় মাঠপর্যায়ে যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হয় সরকারকে। ফলে প্রতিবছর বড় আকারের এডিপি ঘোষণা করে সরকার আত্মতৃপ্তিতে থাকলেও বছর শেষে মুখের হাসি ফিকে হয়ে যায়। কোনো বছরই এডিপির পুরো টাকা খরচ হয় না। বছর শেষে টাকা ফেরত যায়।

রাজস্ব আহরণের চিত্র আরো করুণ। বাংলাদেশে রাজস্ব আদায়ের হার এখন মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ১১ শতাংশ; যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। এমনকি নেপাল ও ভুটানের মতো দেশের কর আদায় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। প্রতিবছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বড় আকারের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। বছরের মাঝামাঝি সময়ে তা সংশোধন করা হয়। বছর শেষে দেখা যায়, সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয় না। রাজস্ব আদায়ের হার বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। নির্বাচন ও ভোটের হিসাব কষতে গিয়ে করের পরিধি বাড়ানোর কাজে হাত দেয় না কোনো সরকার। রাজস্ব আদায়ে অটোমেশন, কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বাড়ানো, কর ফাঁকি রোধে জোরালো ভূমিকা না নেওয়ার কারণে প্রতিবছরই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য থেকে অনেক পেছনে থাকে সরকার।

বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারেও অদক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৬০০ কোটি ডলার করে বৈদেশিক ঋণ ছাড় হওয়ার কথা; কিন্তু সেখানে ছাড় হয় মাত্র ৩০০ কোটি ডলার। ফলে প্রতিবছর বৈদেশিক ঋণের অর্থও ফেরত চলে যায়। মন্ত্রণালয়গুলো কাঙ্ক্ষিত হারে অর্থ খরচ করতে না পারায় বৈদেশিক ঋণের পাইপলাইনে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। সরকার সেই টাকা খরচ করতে পারছে না।

একটি দেশ কতটা স্বচ্ছতার মাধ্যমে বাজেট প্রণয়ন করে কিংবা সেই বাজেট কতটা অংশগ্রহণমূলক হয়, তা নিয়ে প্রতিবছর একটি র্যাংক করে ইন্টারন্যাশনাল বাজেট পার্টনারশিপ (আইবিপি)। বাজেট বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, নিরীক্ষা ও অংশগ্রহণমূলক বিবেচনায় গত বছর ৯২টি দেশ নিয়ে যে র্যাংক করা হয়েছে, তাতে প্রথম অবস্থানে আছে নিউজিল্যান্ড। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৩১তম। যদিও ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। এ তালিকায় ভারতের অবস্থান ৫২তম ও পাকিস্তান ৬২ নম্বরে।

গত পাঁচ অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিবছরই বাজেটের আকার বেড়েছে। কিন্তু খরচ করতে না পারার আশঙ্কায় বছরের মাঝামাঝি সময়ে গিয়ে সে বাজেট সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু বছর শেষে দেখা গেছে, সংশোধিত বাজেটের ধারেকাছেও যেতে পারেনি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মূল বাজেট ছিল দুই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার। ফেব্রুয়ারিতে তা সংশোধন করে করা হয় দুই লাখ ৩৯ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে দেখা যায়, খরচ হয়েছে দুই লাখ চার হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। এর আগের বছর বাজেটের আকার ছিল দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। সংশোধন করে করা হয় দুই লাখ ১৬ হাজার ২২২ কোটি টাকা। আর বছর শেষে খরচ হয় এক লাখ ৮৯ হাজার তিন কোটি টাকা।

পাঁচ অর্থবছর ধরে বাজেটে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) খাতে তিন হাজার কোটি টাকা করে রেখে আসছে অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু কোনো অর্থবছরই এক টাকাও খরচ করতে পারেনি পিপিপি অফিস। শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে এ বছর পিপিপিতে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ কমিয়ে দেন। অবশ্য নতুন অর্থবছরে এ খাতে তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখতে যাচ্ছেন তিনি। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য দুই অর্থবছর ধরে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সেই টাকাও খরচ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, থোক বরাদ্দও রাখা হয় প্রতিবছর বাজেটে। কিন্তু সেই টাকাও বছর শেষে ফেরত যায়।