Challenges of new industrial policy – Dr Khondaker Golam Moazzem

Published in সমকাল on Monday, 04 January 2016

 

নতুন শিল্পনীতির চ্যালেঞ্জ

ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Dr-Khondaker-Golam-Moazzemখসড়া শিল্পনীতি নিয়ে মতবিনিময় চলছে। শিল্পমন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এসব আলোচনায় উপস্থিত থাকছেন। শনিবার সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন ‘নোয়াব’ এ খসড়া নীতি নিয়ে যে আয়োজন করে তাতে বক্তারা গ্যাস-বিদ্যুৎ, জমির সংকট, সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবার নিম্নমান, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করে বলেছেন_ শিল্পনীতির ভালো ভালো ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য যার প্রতি মনোযোগ প্রদানের বিকল্প নেই। গত রোববার ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ-এর আয়োজনে আরেকটি আলোচনায় বলা হয়েছে, সরকার জাতীয় আয়ে শিল্প খাতের অবদান বর্তমানের ২৯ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে চায়। এ লক্ষ্য অর্জনে মূল ভূমিকা পালন করবে বেসরকারি খাত। সরকারের কাজ হচ্ছে এ জন্য উপযুক্ত নীতি ও কৌশল প্রণয়ন এবং শিল্প স্থাপন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয় শুধু সরকারি কিছু শিল্প-কারখানা দেখভাল করে থাকে। বেসরকারি খাতের সঙ্গে এ মন্ত্রণালয়ের খুব একটা যোগসূত্র নেই। ওই আলোচনায় একাধিক বক্তা বলেছেন, সরকারি শিল্প-বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে অনেক জমি আছে, যার ব্যবহার হচ্ছে না। অথচ উদ্যোক্তারা শিল্প স্থাপন করতে গিয়ে জমির প্রকট সমস্যায় ভুগছেন। আশা করা হচ্ছে, এসব আলোচনায় যে পরামর্শ-সুপারিশ মিলবে তা নীতিনির্ধারকরা বিবেচনায় নেবেন।

এখন যে শিল্পনীতির খসড়া নিয়ে আলোচনা চলছে তাকে আমরা ২০১২ সালে প্রণীত নীতির ধারাবাহিকতা বলতে পারি। এখন দুটি বিষয় দেখতে হবে_ এক. এতে নতুনত্ব কী আছে; দুই. ২০১২ সালের নীতির বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে এবং কী লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। কোথায় কোথায় বাধা এসেছে সেটাও চিহ্নিত করা দরকার। ওই নীতি প্রণয়নে দেশের বাইরের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়া হয়েছে। এবারে পরিবর্তন হচ্ছে_ মন্ত্রণালয় নিজেই উদ্যোগী হয়েছে। তারা ২০১২ সালের কাঠামো পরিবর্তন-পরিমার্জন করছেন। এ কারণে বিদ্যমান নীতির তুলনায় কাজের পরিধি কিছুটা সীমিত। বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনা শেষে এ নীতি চূড়ান্ত হলে বাস্তবায়ন কাজ সহজ হবে। এ জন্য কী কী করণীয়, সেটা জানা থাকলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষে মনিটরিংয়ের কাজ করা সহজ হবে।

বাংলাদেশের শিল্প খাত মনোযোগ পাবে_ এটা সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং সময়ের দাবি। নতুন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও এ লক্ষ্য সামনে রয়েছে। সম্প্রতি প্যারিসে যে জলবায়ু সম্মেলন শেষ হয়েছে, তাতে পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। শিল্পনীতিতে এসব বিষয় কতটা প্রতিফলিত হয়, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকব।

প্রস্তাবিত নীতিতে একটি পরিবর্তন লক্ষণীয়_ বেসরকারি উদ্যোগের বিষয়টি প্রথমে রাখা হয়েছে, পরে স্থান পেয়েছে সরকারি খাতের শিল্প-বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠান। আমাদের অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অবদান ক্রমেই বাড়ছে এবং এই পরিবর্তনে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। এখন প্রত্যাশা_ কেবল শিল্প মন্ত্রণালয় নয়, গোটা সরকারি যন্ত্রের মনোভাবেও একই পরিবর্তন হতে হবে। শিল্প স্থাপন এবং দেশ-বিদেশে উৎপাদিত পণ্যের বিপণন কেবল শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। বহু বছর ধরেই বাংলাদেশে ওয়ান স্টপ সার্ভিস কথাটি চালু। কিন্তু বাস্তবে অনেক মন্ত্রণালয়ের কাছেই উদ্যোক্তাদের যেতে হয় এবং এ প্রক্রিয়া যে মোটেই সহজ নয়, সেটা অনেকেরই জানা। নতুন শিল্পনীতি তাই হতে হবে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের, কেবল শিল্প মন্ত্রণালয়ের নয়। এখন যেসব মতবিনিময় হচ্ছে, সেখানেও সবার উপস্থিতি সঙ্গত কারণেই কাম্য। সব মন্ত্রণালয়ের কাজে সমন্বয় তাই গুরুত্বপূর্ণ। এটা নীতি প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় যেমন চাই, আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাস্তবায়ন পর্যায়ে।

আমাদের শিল্প-বাণিজ্যের উদ্যোক্তারা অভিযোগ করেন যে, সরকার যেসব খাতকে থার্স্ট সেক্টর ঘোষণা দিচ্ছে, তা থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে যথাযথ উদ্যোগে ঘাটতি থাকে। তৈরি পোশাক, তথ্যপ্রযুক্তি, হিমায়িত মাছ, অলঙ্কার_ রফতানি বহুমুখী করার জন্য কত খাতের ওপরেই না আমরা জোর দিই। জাহাজ নির্মাণ শিল্পকেও এখন অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছে। কৃষিপণ্যও এখন আগের তুলনায় গুরুত্ব পাচ্ছে। কিন্তু কথার সঙ্গে কাজের মিল না দেখে উদ্যোক্তারা হতোদ্যম হন এবং তা প্রভাবিত করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও। দেশি বা বিদেশি, সব উদ্যোক্তাই চাইবেন জমি, গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের নিশ্চিত সরবরাহ। কিন্তু সরকার যেসব সুবিধার কথা বলছে, বাস্তবে তা মিলছে না। এটা দূর করা না গেলে নীতি যত ভালোই হোক না কেন, বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হবে না।

আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো চলছে না, সেটা নিয়ে দ্বিমত নেই। ২০১২ সালের নীতিতে এগুলোর ভালোভাবে পরিচালনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। বাস্তবে তা হয়নি। কেন হয়নি? কেন লোকসান কমানো গেল না? এ জন্য দায়দায়িত্ব কি চিহ্নিত হয়েছে? এসব পর্যালোচনা জরুরি। এখন বলা হচ্ছে যৌথ অংশীদারিত্বের কথা। বেসরকারি উদ্যোক্তারা শেয়ার পাবে এবং আধুনিকায়নে অবদান রাখবে। তারা লাভ পাবে শেয়ার অনুযায়ী। কিন্তু বর্তমানে সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেসব সমস্যা রয়ে গেছে তা দূর করায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে যৌথ বিনিয়োগে আগ্রহী ক’জন মিলবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কোথাও শ্রমিক সংখ্যা বেশি, কোথাও শ্রম ব্যয় অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কোথাও মেশিন-যন্ত্রাংশ সেকেলে। এ অবস্থায় উদ্যোক্তারা কেন আকৃষ্ট হবেন? দায়দেনাই-বা কেন নিজেদের কাঁধে চাপাবেন? আরেকটি ইস্যু সম্প্রতি সামনে এসেছে_ সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের অব্যবহৃত জমি শিল্প স্থাপনের জন্য বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছে হস্তান্তর করা। সরকারকে এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বাংলাদেশে এখন অনেক নতুন উদ্যোক্তা এগিয় আসছেন। এটা ভালো লক্ষণ। কিন্তু তারা প্রভূত সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। পদে পদে হয়রানি-ভোগান্তির কথা বলছেন। ব্যবসায়ের পরিবেশ উন্নত করার দাবি আসছে তাদের দিক থেকে। বিদেশি উদ্যোক্তাদের কাছে শুনছি যে, ভারতের শিল্পনীতি বাংলাদেশের তুলনায় তাদের জন্য জটিল। কিন্তু তারপরও সেখানে বিদেশি পুঁজি আকৃষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের তুলনায় বেশি। এর অন্যতম কারণ সেখানের ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া স্বচ্ছ। আমাদের এ ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে এবং তার সমাধান করতেই হবে। এজন্য মনিটরিং গুরুত্বপূর্ণ, যা দুর্নীতি কমাবে। অন্যান্য খাতে ব্যয় কমাবে।

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের সারি থেকে মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে যেতে সচেষ্ট রয়েছে এবং এ লক্ষ্য অর্জনযোগ্য বলেই সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এটা যেমন সুযোগ, তেমনি চ্যালেঞ্জও কম নয়। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মুক্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে কিছু ট্রাডিশনাল বাজার সুবিধা সীমিত হওয়া। উন্নত দেশগুলো আমাদের পণ্যের ওপর শুল্কহার বাড়াবে। অনেক বিদ্যমান সুবিধা কমাবে বা বন্ধ করে দেবে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকবে শর্ত। যেমন, বলা হতে থাকবে কারখানার পরিবেশ ও শ্রমমান উন্নত কর। দুর্নীতি কমাও, স্বচ্ছতা বাড়াও। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ব্যবহার ও মালিকানা মেনে চলার ওপর কড়াকড়ি আরোপ হতে থাকবে। আঞ্চলিক বাণিজ্য জোটগুলোর তরফে চাপ আসবে। কারখানায় কমপ্লায়েন্স গুরুত্ব পাবে। সরকার এসব বিষয়ে যে অমনোযোগী, সেটা বলা যাবে না। শিল্প রাজধানী থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইটিবি চালুর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সব ধরনের শিল্পের জন্যই টেকসই প্রযুক্তি গুরুত্ব পাচ্ছে। তৈরি পোশাকশিল্পে কমপ্লায়েন্স মানা নিয়ে আগের মতো অভিযোগ নেই।

আমাদের উন্নয়ন দর্শনে এতদিন রফতানি খাত বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। আগামীতেও সেটা থাকবে। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, অভ্যন্তরীণ বাজারও ক্রমে বড় হচ্ছে। এ বাজারের অনেক পণ্য দেশে উৎপাদিত হয়। অনেক পণ্য আমদানি করি। আবার এমন অনেক পণ্য দেশে মেলে, যার কাঁচামাল আমদানি করা হয়। ইলেকট্রনিক্স অনেক ধরনের পণ্য কেবল দেশে সংযোজন করা হয়। অথচ এসব পণ্যের ক্রেতা দেশে অনেক এবং তার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এই বাজার ধরার জন্য দেশের যেসব উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করছেন তাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, বিদেশের বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা। এমন অনেক পণ্য দেশে উৎপাদন সম্ভব, যা গুণে-মানে আন্তর্জাতিক মানের; কিন্তু দামের প্রতিযোগিতায় বিদেশি পণ্যের কাছে দেশের বাজারে টিকতে পারবে না। এসব উদ্যোক্তা শুল্ক ও অন্য সুবিধা না পেলে টিকতে পারবে না। আমাদের দেশীয় শিল্প খাত যেন বিশ্ববাজারের পাশাপাশি নিজেদের বাজারেও টিকে থাকতে পারে, তার উপযুক্ত রক্ষাকবচ থাকতে হবে শিল্পনীতিতে। এ জন্য সার্বিকভাবে শিল্প খাতের বিষয়ে যেমন মনোযোগ দিতে হবে, তেমনি খাতওয়ারি কাঠামোও চূড়ান্ত করা চাই।
অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, সিপিডি